
অকল্পনীয় যন্ত্রণা ভোগের ছয় মাস পর ধুঁকে ধুঁকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান তিনি। কিন্তু তার সেই রুদ্রমূর্তি আজও কিংবদন্তী হয়ে আছে পেরুয়া গ্রামে, স্বজনহারা মানুষগুলোর চোখ আজও গর্বে চিকচিক করে ওঠে কনকের কথা বলতে গিয়ে...
পাকিস্তানকে নিয়ে কিছু বললেই ভারত টেনে আনে কিছু মানুষ, কেন ভারতের শোষণ-অবিচার-নির্যাতন নিয়ে কথা বলছি না, কেন শুধু পাকিস্তান নিয়েই পড়ে আছি, প্রশ্নের তোড়ে পৃথিবী উল্টে যাবার উপক্রম। ক্রিকেটে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়। পাকিস্তানকে পচাতে শুরু করলেই ইন্ডিয়ার মালাউনেরা যে আমাদের কত বড় শত্রু, সেইটা বুঝাতে রীতিমত গবেষণা প্রতিবেদন দাখিল করে ওরা। তাদের বেশিরভাগের মতে পাকিস্তান একাত্তরে যা করেছিল ইসলাম রক্ষায় সেটা প্রয়োজনীয় ছিল, রাজাকাররা স্রেফ ইসলাম রক্ষায় কাজ করছে, সুতরাং এতো বছর পরে এই মানুষগুলার আবার বিচার করতে যাওয়াটা খুবই অন্যায়। রাজাকারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার ছড়ানো হয়েছে, বৃদ্ধ মানুষগুলাকে ফাঁসি দিতে চাওয়া মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন...
১৯৭১ সালের শেষদিক। ডিসেম্বরের ছয় তারিখ। শত্রুমুক্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ। পালিয়ে গেছে পাকিস্তানী সেনারা। জেলা শহরের রাস্তায় হাজারো মানুষ বেরিয়ে এসেছে, “জয় বাঙলা” স্লোগানে প্রকম্পিত চারিদিক। কিন্তু জেলা শহর থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে মরা সুরমা নদীর পাড়ে পেরুয়া গ্রাম তখন জ্বলছে। নদীর পাড়ে এক লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে ২৫ জন নিরীহ মানুষকে। চোখ বাঁধা, হাত দুটো পেছনে বাঁধা শক্ত করে। একটু আগে তাদের বাড়িতে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর শ্লোগান দিতে দিতে হামলা করেছিল রাজাকারেরা, যথাসর্বস্ব লুট করবার পর গনিমতের মাল হিসেবে বিবেচ্য গীতা রায়, কনক লতা রায়, মিরা রায়ের মতো হিন্দু ধর্মালম্বি নারীদের উপর চালিয়েছিল বর্বরতম নির্যাতন। তাদের বাবা, স্বামী, ভাই, ছেলেদের বেধে রেখেছিল পাশেই, চোখ দুটো তখনও বাঁধা হয়নি, ইচ্ছে করেই। শিক্ষক উপেন্দ্র রায় চিৎকার করে বলেছিলেন, ধর্মের নামে এতোবড় অধর্ম স্রষ্টাও সইবেন না। রাইফেলের বাট দিয়ে চোয়ালটা ভেঙ্গে দেওয়ায় আর আহাজারি করতে পারেননি বৃদ্ধ...
ইসলামের নাম ব্যবহার করে নিকৃষ্টতম জঘন্য বর্বরতার পর পুরুষদের চোখ বেঁধে দেওয়া হল, তাদের নিয়ে আসা হল নদীর পাড়ে। এরা মালাউন, হিন্দুস্তানি চর, পুরো নয় মাস ওই মুক্তিগুলোকে সাহায্য করেছে, খাইয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। এরা ইসলামের শত্রু, পাকিস্তানের শত্রু। মুহূর্তের মধ্যে এক ঝাঁক বুলেট ছুটে গেল মানুষগুলোর দিকে, শাল্লা উপজেলার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শ্যামারচন্দ্র রামচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রামকুমার রায়, তার ছোট ভাই পল্লি চিকিৎসক রামানন্দ রায়, এলাকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার কাছে ঋষি বলে পরিচিত উপেন্দ্র মাস্টার, সবাইকেই মেরে ফেলা হল। কাউকে কোনোদিন একটা কটু কথা পর্যন্ত বলেননি উপেন মাস্টার, ভদ্র-বিনয়ী, অপরের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়া একজন অসাধারন ব্যক্তি হিসেবেই চিনতো তাকে মানুষ, মরবার সময় তার পরিচয়টা কেবল হিন্দুস্তানী মালাউন শব্দযুগলের মধ্যেই আটকে ফেলল শুয়োরগুলো।
লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ এক নারী উদ্যত দা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজাকারগুলো উপর। ভয়ংকর ক্রোধে কোপাতে থাকলো সামনে যাকে পেল, খুব কাছ থেকে মুখের উপর গুলি করার পর যখন সে পড়ে গেল, ততক্ষণে দুজন রাজাকারের কল্লা দুটো গড়াগড়ি খাচ্ছে, চারজন কাতরাচ্ছে পিঠে-বুকে উপর্যুপরিকোপ খেয়ে। হঠাৎ এক রাজাকার তাকে চিনতে পারল। একটু আগে তার উপরই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা ১০ জন, অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাবার পরেও হার মানেননি কনক লতা রায়, স্বামী রামকুমার রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন উদ্যত দা হাতে।
কনক লতা রায় তখনই মারা যাননি। চোয়ালের একপাশ উড়ে গিয়েছিল তার, সামান্য চিকিৎসার অভাবে একসময় পচন ধরে ক্ষতস্থানে, দেখতে ভয়ংকর লাগতো, কেউ কাছে আসতে চাইত না। অকল্পনীয় যন্ত্রণা ভোগের এক পর্যায়ে ছয় মাস পর ধুঁকে ধুঁকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান তিনি। কিন্তু তার সেই রুদ্রমূর্তি আজো কিংবদন্তী হয়ে আছে পেরুয়া গ্রামে, স্বজনহারা মানুষগুলোর চোখ আজো গর্বে চিকচিক করে ওঠে কনকের কথা বলতে গিয়ে...
তারপরও রাজাকারদের আজ বিশিষ্ট বৃদ্ধ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় নতুন প্রজন্মের কিছু মানুষ, মায়ের ধর্ষণকারীকে নির্দোষ প্রমানের জন্য গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে তারা। আধুনিক প্রজন্মের আপডেটেড এই প্রজন্মের কাছে লাখো শহীদেরা কেবল মিথ্যাচার আর অপপ্রচার মাত্র, লাখো মা-বোনের আর্তচিৎকার আর তাজা রক্তে পাওয়া এই জমিনে দাঁড়িয়ে তারা কেবল চিৎকার করে নিজের জন্ম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে যায়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন