এটি বিদগ্ধ লেখকের মনগড়া কোনো গল্প না, এ গল্পের প্রত্যেকটি ঘটনা, প্রত্যেকটি চরিত্র বাস্তব। যদিও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়টি নিয়ে ভারতে শুরু হয়েছে বিতর্ক...

আমাদের জীবন আসলে অনেক পরিস্থিতির মিলিত জংশন। জীবনের বিভিন্ন, বিচিত্র জংশনে আমাদের আচরণ, বোধ, বিবেক, চিন্তাচেতনা বদলে যায়, পালটে যায়। সাম্যাবস্থায় এক রূপ, সংকটে আরেক রূপ, বিচ্ছেদে অন্য কোনো রূপ। জাপানি প্রবাদ অনুযায়ী, মানুষের তিনটি মুখোশ থাকে। বাস্তবতা অনুযায়ী, মানুষের অজস্র মুখোশ। সে মুখোশ ক্ষণে ক্ষণে রূপ পালটায়। এত আধ্যাত্মিক গৌরচন্দ্রিকা করছি কেন? তার পেছনেও ঠিকঠাক কারণ আছে। একটা গল্প বলবো। বিদগ্ধ লেখকের মনগড়া গল্প না। এ গল্পের প্রত্যেকটি ঘটনা, প্রত্যেকটি চরিত্র বাস্তব। শুরু করি।

ভারতের মানচিত্রের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহর আহমেদাবাদের বাসিন্দা সাহদেভসিন সোলাঙ্কি ও তার পরিবার। সোলাঙ্কি গুজরাট সরকারের বেশ উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা। পরিবারে স্ত্রী, দুই সন্তান। বড় মেয়ের পরে জন্ম ছেলে অভিজিৎ এর। ছেলের বয়স যখন দশ মাস, তখন জানা যায়- অভিজিৎ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। অভিজিৎ এর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম থাকায় মাঝেমধ্যেই তাকে নিয়ে যেতে হতো হাসপাতালে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত  রোগীর রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার কারণে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পায়। এজন্যে রোগীর দেহে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

অভিজিৎ এর ঠিক সে সমস্যাই হচ্ছিলো। তাই তাকে প্রচুর রক্তও দিতে হতো। বিশ-বাইশ দিন পরপরে এই বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হতো। রক্ত দিতে হতো। অভিজিৎ এর বয়স ছয় বছরে পৌঁছানোর আগে তাকে কতবার রক্ত দিতে হয়েছিলো, জানেন? মোট ৮০ বার!

ছোট্ট অভিজিৎ এর জন্যে যেন হাসপাতালই ছিলো ঘরবাড়ি! 

সাহদেভসিন সোলাঙ্কি মেনে নিতে পারছিলেন না নিজের ফুটফুটে সন্তানের এই কষ্ট। তিনি সরকারী চাকুরে, ডাক্তারি জিনিসপত্র তিনি বুঝবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাও তিনি এ বিষয়ে শুরু করলেন পড়াশোনা৷ জানতে পারলেন, এ রোগ থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার একটি চিকিৎসা আছে। সেটি হলো অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। এ বিষয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা শুরু করলেন তিনি আবার।  জানতে পারলেন, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্যে অভিজিৎ এর অস্থিমজ্জার সাথে পরিবারের কারো অস্থিমজ্জা ম্যাচ করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরিবারের কারো অস্থিমজ্জার সাথে অভিজিৎ এর অস্থিমজ্জা ম্যাচ করছে না৷

তখন মিঃ সোলাঙ্কা জানতে পারলেন অন্য আরেকটি পদ্ধতির কথা। তিনি বুঝলেন, এভাবেই তার সন্তান বাঁচবে। পরবর্তী কাজ শুরু করলেন তিনি। পদ্ধতিটি এরকম- অভিজিৎ এর শরীরে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য অভিজিৎ এর দেহের উপযোগী করে আরেকটি সন্তান জন্ম দেওয়া এবং সেই সন্তানের একটি নির্দিষ্ট বয়স পর তার দেহ থেকে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা। এভাবে যেসব শিশুর জন্ম হয়, তাদের "জীবন রক্ষাকারী ভাই বোন" বলা হয়। সর্বপ্রথম এই প্রক্রিয়ার সার্থক প্রয়োগ দেখা দেয় ২০ বছর আগে, আমেরিকায়। অ্যাডাম ন্যাশ নামে একটি শিশুর জন্ম হয় ছয় বছর বয়সী বোনের চিকিৎসার জন্যে।

সন্তান অভিজিৎ-এর চিকিৎসার জন্য সোলাঙ্কা ভাবলেন, এই পদ্ধতিটিই উপযুক্ত। থ্যালাসেমিয়া-মুক্ত ভ্রূণ তৈরির জন্য তখন তিনি উঠেপড়ে লাগলেন। খবর পাওয়া গেলো, অভিজিৎ এর দেহের সাথে ম্যাচ করে এরকম একটি টিস্যুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে। সমস্যা হচ্ছে এই টিস্যুর কারণে যে সন্তানের জন্ম হবে, তার দেহ থেকে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ফলে অভিজিৎ যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে, তার সম্ভাবনা ত্রিশ শতাংশেরও কম! এবং এই টিস্যু আনতে খরচও পড়বে প্রায় এক কোটি রূপি! সোলাঙ্কা তাও বাজি ধরলেন। বললেন, এই পদ্ধতিতেই যাবেন তিনি।

এইভাবে প্রাপ্ত ভ্রুণটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আনা হলো ভারতে। রোগমুক্ত করে ভ্রুনটিকে গর্ভে স্থাপন করে জন্ম দেয়া হলো এক ফুটফুটে মেয়ের। নাম- কাভ্যিয়া। যে প্রক্রিয়ায় এ কাজটি করা হলো, তার ডাক্তারি পরিভাষায় নাম- প্রি-ইমপ্ল্যানটেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস। কাভ্যিয়ার জন্মের পর সোলাঙ্কি পরিবারকে অপেক্ষা করতে হলো আরো ১৬ থেকে ১৮ মাস। অপেক্ষা করতে হলো যাতে কাভ্যিয়ার ওজন বেড়ে ১০/১২ কেজি হয়। নির্দিষ্ট ওজন হওয়ার পরে এ বছরের মার্চ মাসে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর আরো কয়েকমাস অপেক্ষা করা হয় অভিজিৎ-এর শরীর কাভ্যিয়ার অস্থিমজ্জা গ্রহণ করেছে কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর সাত মাস চলে গিয়েছে এখন। আর রক্ত দিতে হয়নি অভিজিৎকে। অভিজিৎ এর শরীরের হিমোগ্লোবিন এখন ১১ এর উপরে। হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনও বেশ স্বাভাবিক। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, অনেকটাই সুস্থ এখন অভিজিৎ। ওদিকে কাভ্যিয়াও সুস্থ আছে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর প্রথম কয়েকদিন ব্যথা ছিলো। যে ব্যথা এখন আর নেই। অভিজিৎ ও  কাভ্যিয়া সুখ ফিরিয়ে এনেছে গোটা পরিবারেই।

সাহদেভসিন সোলাঙ্কি আর তার মেয়ে কাভ্যিয়া! 

যদিও এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে পুরো ভারতে। অবশ্য এরকমভাবে কৃত্রিমভাবে সন্তান জন্ম দিয়ে অন্য সন্তানের জন্যে ব্যবহার করা- এই পদ্ধতি সারাবিশ্বেই এক প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। সন্তান জন্ম দেওয়ার যে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, সেটিকে পরিবর্তন করে, দেহের স্বাভাবিক জিনের পরিবর্তন করার এই প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকেই নিন্দামুখর। একটা মানুষকে সুস্থ করার জন্যে আরেকটা মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়া কতটা যৌক্তিক ও বিবেচক, সেটাও বিতর্কের বিষয়। তাছাড়া এভাবে যদি জিনগত পরিবর্তন করে সন্তান জন্ম দেয়া হতে থাকে,  তাহলে এই প্রক্রিয়ার শেষটা কোথায় হবে? কতদূর যাবে কৃত্রিম এ জন্মদানের প্রক্রিয়া? এটাও এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।

যদিও ব্রিটেনে এরকমভাবে সন্তান জন্মদানের বিষয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে, ভারতে তার কিছুই নেই। সেটা নিয়েও মানুষজন চিন্তিত। নিয়মকানুন করে এই বিষয়গুলোকে বিধিনিষেধের মধ্যে আনা উচিত, মত অনেকের। সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত সবখানেই, তাদের দাবী।

তবে মুদ্রার উল্টো পিঠ যদি দেখি, চোখের সামনে ফুটফুটে শিশু তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেটা কোনো বাবা-মা'র জন্যেই সুখকর দৃশ্য না। নিজের সন্তানের ভালোর জন্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ যদি কোনো বাবা-মা'র একটুখানি কমেও যায়, সেটা কতটুকু নিন্দনীয়...সেটা নিয়েও জোরদার বিতর্ক হতে পারে। তবে দুটি শিশু- অভিজিৎ এবং কাভ্যিয়া দুইজনেই সুস্থ আছে, এখন এটাই একমাত্র স্বস্তির বিষয়। ওরা বড় হোক। মানুষের মত মানুষ হোক। এটাই আমরা চাই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা