এ বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে কেরালার কায়ামকুলামে একটি মসজিদ হিন্দু বিয়ের আয়োজন করেছিল, তার রেশ কাটতে না কাটতেই সেই কেরালাতেই একই রকম মন ভাল করা আরেকটা ঘটনা ঘটলো। তাই পুরো ভারতের অবস্থা জানি না, তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়- কেরালার আকাশটা একটু বেশি নীল।

গোলাপী-সোনালী বর্ণের ঐতিহ্যবাহী সিল্ক শাড়ি পরা হিন্দু বধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পায়ে ধরে আশির্বাদ নিচ্ছে মুসলিম বাবা-মায়ের কাছ থেকে। ভাবছেন এ কী করে সম্ভব? মুসলিম বাবা-মায়ের আবার হিন্দু মেয়ে হয় কী করে? তবে শুনুন কেরালার মুসলিম এক দম্পতি আর তাদের হিন্দু মেয়ের গল্প, একে দুই শব্দে 'মানবিকতার গল্প' নামেও আখ্যায়িত করা যায়।

তিন ছেলে শামীম, নাজীব আর শরিফকে নিয়ে আব্দুল্লাহ-খাদিজা দম্পতির সংসার৷ তাদের ছোট্ট একটি ফার্ম ছিল, সেই ফার্মে হিন্দু এক লোক চাকরী করতো। একদিন ফার্মের একটি দুর্ঘটনায় লোকটি মারাত্মকভাবে জখম হয়। তাকে তাৎক্ষণিক এক হাসপাতালে ভর্তি করেন আব্দুল্লাহ এবং চিকিৎসার যাবতীয় যা কিছু খরচ, সব নিজ থেকে তদারকি করেন। কিন্তু কয়েকদিন মৃত্যুর সাথে লড়ে অবশেষে মারা যায় লোকটি। নিজ ফার্মের কোনো কর্মচারীর এমন মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছিলেন আবদুল্লাহ, দায়িত্ববোধ থেকেই লোকটির পরিবারকে সাহায্য করতে চাইলেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন লোকটির স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছে, পরিবারের একমাত্র সদস্য হলো রাজেশ্বরী নামের ৮-১০ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। 

বিমর্ষ হয়ে তিনি স্ত্রী খাদিজার সাথে এই ব্যাপারে আলাপ করলেন। সব শুনে স্ত্রী বললেন- যতদিন না মেয়েটির কোনো গতি হয়, ততদিন তিনি নিজের কাছেই রাখতে চান মেয়েটিকে। সুতরাং আব্দুল্লাহ-খাদিজা দম্পতি বাপ-মা মরা রাজেশ্বরীকে নিজেদের বাড়িতে এনে তুললেন। 

তিন ছেলের সংসারে একটি মেয়ের অভাববোধই হয়তো করতেন এই দম্পতি, আদর-ভালোবাসায় অল্প দিনেই রাজস্বীকে আপন করে নিলেন। বেশ ক'দিন পর মেয়েটির গ্রামের বাড়ি থেকে আত্মীয়রা এলো তাকে নিয়ে যেতে। রাজেশ্বরীকে বিদায় দেয়ার আগে খাদিজা বললেন, 'তোর জন্য এ বাড়ির দরজা সবসময় খোলা। কোনো রকম অসুবিধা হলেই চলে আসবি'। 

গ্রামে গিয়ে রাজেশ্বরীর আর ভাল লাগে না, খাদিজার সাথে যোগাযোগ করে বলে, সে তাদের সাথে থাকতে চায়৷ খাদিজাও মেয়েটির জন্য পুড়ছিলেন, চিঠি পেয়েই স্বামীকে বলেন রাজেশ্বরীকে একবারে নিয়ে আসতে। কিন্তু তিন ছেলের সংসারে একটি মেয়েকে এমনি এমনি নিয়ে আসা তো যায় না, লোকে কী বলবে! উপায়ান্তর না পেয়ে তারা পারিবারিকভাবে দত্তক নিলেন রাজেশ্বরীকে।

স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিচ্ছে রাজেশ্বরী

তারপর তিন ছেলের সাথে তাদের মেয়ে হিসেবেই বড় হতে থাকে রাজেশ্বরী। ভাইয়েরাও বোনকে পেয়ে অনেক খুশি। মুসলিম পরিবারে বড় হলেও রাজেশ্বরীকে কখনোই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য কোনো প্রকার জোর-জবরদস্তি করা হয়নি, সে তার ধর্মই পালন করে এসেছে সবসময়। এই নিয়ে নিজেদের কাছে স্বচ্ছ থেকেছেন তারা, কখনও মনোমালিন্য হয়নি তাদের মাঝে। 

দেখতে দেখতে রাজেশ্বরীর বয়স ২২ পার হয়ে গেল, এখন তো যোগ্য পাত্র দেখে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। চিন্তা এসে ভর করলো আব্দুল্লাহ-খাদিজা দম্পতির মাথায়। তাদের ভাষ্যমতে-

'আমরা সবসময় চেয়েছি- ধন দৌলত নয়, এমন ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে, যে কিনা মেয়েটিকে সুখী রাখবে। আমাদের পরিচিত কয়েকটি হিন্দু পরিবারের সাথে কথা বলি এই ব্যাপারে। অনেকজনকে দেখেছি, কিন্তু পরে খোঁজ-খবর নিয়ে আর ভালো লাগেনি। এই ছেলেটিকে সব মিলিয়ে ভালো লেগেছে।'

অতএব, তাদের পছন্দ করা ছেলে, বিষ্ণু প্রসাদের সাথে রাজেশ্বরীর বিয়ে ঠিক করেন তারা৷ রাজেশ্বরীরও পছন্দ হলো বিষ্ণুকে। কিন্তু বিয়ে দেবেন কোথায়, সব মন্দিরে তো মুসলমানদের প্রবেশ করতে দেয় না। তারপর খোঁজ-খবর নিয়ে 'ভগবতী' মন্দিরে সবকিছুর আয়োজন করেন তাঁরা, যেটিতে মুসলমানদের প্রবেশে কোনো বাধা নেই। সেখানে আব্দুল্লাহ-খাদিজার মুসলমান আর বিষ্ণু প্রসাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে হিন্দু রীতিনীতি অনুযায়ী গত রবিবার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে রাজেশ্বরী-বিষ্ণু দম্পতির। 

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বোরকা পরা খাদিজাকে রাজেশ্বরীর পা ছুঁয়ে আশির্বাদ নেওয়ার মুহুর্তের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি টুইটার-ইন্সটাগ্রামে হাজার হাজারবার শেয়ার করছে ভারতীয় নেটিজেনরা, ক্যাপশনে লিখছে- 'বিউটি অফ ইন্ডিয়া', 'এপিক এক্সাম্পল অফ সেক্যুলার ইন্ডিয়া'। 

এর আগে এ বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে কেরালার কায়ামকুলামে একটি মসজিদ হিন্দু বিয়ের আয়োজন করেছিল, তার রেশ কাটতে না কাটতেই সেই কেরালাতেই একই রকম মন ভাল করা আরেকটা ঘটনা ঘটলো। তাই পুরো ভারতের অবস্থা জানি না, তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়- কেরালার আকাশটা একটু বেশি নীল।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা