আমরা একজন আরেকজনকে ট্রল করে বলি, কীবোর্ড যোদ্ধা। অনলাইন যোদ্ধা হয়ে কি হাতি-ঘোড়া মেরেছিস? তবে একজন কিন্তু ঠিকই লড়ে গিয়েছে তার কীবোর্ড নিয়ে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। নাম তার ইরফান হাফিজ...

কীবোর্ড যোদ্ধা- সময়ের প্রেক্ষিতে আজ এখন ট্রলের বিষয়বস্তু। কিন্তু কেন? আমাদের হাতে এখন এত এত টুলস যে আমরা অন্ধ হয়ে যে যার মতো কীবোর্ড চেপে নিজেকে প্রকাশ করে যাচ্ছি। অনলাইনে আজকাল প্রচুর ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, একজন আরেকজনের মতামত নিতে পারছে না। যেকোনো ইস্যুতে আমরা দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছি। কীবোর্ড দিয়ে তথাকথিত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছি। এতে ঘৃণা বাড়ছে, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, আমরা দিনকে দিন সামাজিক থেকে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি। তাই আজ অধিকাংশই 'কীবোর্ড যোদ্ধা' শব্দটি শুনে নাক সিটকান। তবে কীবোর্ড দিয়েও যে বদলে ফেলা যায় অনেক কিছু, তা প্রমাণ করেছেন একজন। আজকের গল্পটা তাকে নিয়েই।

নাম তার ইরফান হাফিজ। বাড়ি শ্রীলঙ্কায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ইরফানের শরীরের মাসল সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। 'ডিউচেনে মাসকিউলার ডিস্ট্রোফি' তথা ডিএমডি নামক এই রোগের কারণে তার গোটা শরীর প্যারালাইজড হয়ে যায়। সেই ১৮ বছর বয়সের পর থেকে বছরের পর বছর ধরে তিনি শয্যাশায়ী৷ শরীর নাড়াতে পারেন না একটুও। কোনোরকমে পুরো দেহের মাত্র একটা আঙ্গুলে একটু জোর পান। একটা আঙ্গুল দিয়ে কি করতে পারে আর মানুষ? সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ তো হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মধ্যে মাত্র একটাও যদি নাড়াতে না পারে ব্যথায়, তাতেই কাবু হয়ে যায়৷ কাজ না করার অজুহাত খুঁজে বেড়ায়।

কিন্তু, ইরফান হাফিজের এই গল্প কোনো দুঃখের গল্প না, না কোনো অজুহাতের আড়ালে অক্ষম হয়ে বেঁচে থাকার গল্প। ইরফান হাফিজের গল্পটা একটু আলাদা। তিনি সেই একটা আঙ্গুল দিয়েই নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে নেমেছিলেন। এক জীবনের গল্প লিখবেন বলে শিখেছেন ইংরেজি। ওই শয্যাশায়ী অবস্থাতেই স্রেফ এক আঙুল দিয়ে টাইপ করতে করতে ইরফান হাফিজ লিখেছেন তিনটা বই! Silent StruggleMoments Of Merriment (Stories of children) এবং Silent Thoughts নামের বইগুলো অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর মাঝে Moments Of Merriment বইটি লিখতেই তার এক বছর সময় লেগেছিল!

১৯৮১ সালে মাতারাতে জন্মেছিলেন ইরফান। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার বাবাও একটা ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। যখন ইরফান চার বছর বয়সে প্রথম অসুস্থ হলেন এবং জানা গেল ডিমডি নামক এই রোগের কোনো প্রতিকার নেই, তখন ইরফানের বাবা পড়লেন অথৈ জলে। প্রতিবেশিরা বিভিন্ন ধরণের কথা বলতে থাকলো। অনেকে বিভিন্ন পরামর্শ দিলো। ইরফানকে অনেক রকম ডাক্তার দেখানো হলো, এমনকি আধ্যাত্মিক লাইনেও চেষ্টা করা হলো। কিন্তু, কিছুতেই কাজ হলো না। উল্টো অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেল। 

ইরফান হাফিজ

ল্যাপটপের কীবোর্ড না হয় একটা আইফোন, এই ছিল তার টুলস। এটা ব্যবহার করেই একটি একটি করে শব্দ লিখে শব্দের সাথে শব্দ জোড়া দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠে একেকটা বাক্য। এই কাজটা কতটা কঠিন তা বুঝবেন নিজেই যখন কীবোর্ড ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন একটা আঙ্গুল দিয়ে। কোনো কিছুর সহায়তা নেই, হাত দিয়ে ফোনটা ধরার মতো শক্তিটুকু নেই, শুধু একটা আঙ্গুল দিয়ে টাইপ করে যাওয়া! আমি এই মুহুর্তে এই কন্টেন্ট লিখতে গিয়ে এক আঙ্গুল দিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। একটা বাক্য শেষ করতেই অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। কত সৌভাগ্যবান আমরা! এত প্রিভিলেজ পেয়েও অজুহাত দেখাই, কত কী লেখার কথা, লিখতে পারি না সব কিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও!

ইরফান কিছুদিন স্কুলে যেতে পারলেন না। তখন তার বয়স মাত্র ১২। তার সবকিছুতেই বিরক্তি ধরে যেত। খুব হতাশাজনক অবস্থা। চলাফেরাও দিনে দিনে সীমিত হয়ে গেল। প্রথম দিকে তিনি হুইলচেয়ারে বসতে পারতেন। কিন্তু, ধীরে ধীরে তার মাসলের নাড়াচাড়া আরো কমে যেতে থাকলো। শ্বাসপ্রশ্বাসেও সমস্যা দেখা গেল। ডাক্তার বলেছিল ইরফান ১৮ বছর পর্যন্ত বাঁচবে সর্বোচ্চ। আশংকার হার বেড়ে যায়, যখন ১৮ বছর বয়সেই একবারে শয্যাশায়ী হতে হয় তাকে।

এই সময়ে তার বাবা প্রায়ই তার শয্যার পাশে এসে তাকে বোঝাতেন, জীবনের গভীরতা সম্পর্কে বোঝাতেন। এই রোগটা ইরফানকে ধীরে ধীরে শেখালো কি করে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, কিভাবে সব কিছু সহ্য করতে হয়। অক্সিজেনের মাস্কে মুখ ডুবিয়ে একটা আঙ্গুল দিয়ে শুরু হলো তার লেখক জীবন। ভেন্টিলেশন মেশিনের মাধ্যমে কৃত্তিমভাবে বেঁচে থাকা ইরফান তৃতীয় বইটা প্রকাশের দিন স্ট্রেচারে করে এসেছিলেন, অনুপ্রেরণার গল্প শুনিয়েছেন, জানিয়েছেন তার কীবোর্ড যুদ্ধের গল্প।

ইরফান হাফিজ ৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত লড়ে গেলেন। চতুর্থ বইয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। শেষ হলো না। লড়াইটা শেষ হয়ে গেল ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। ইউটিউবে কন্টেন্ট মেকার নাস তার নাস ডেইলি সিরিজে সে বছরেরই মে মাসে এই কিবোর্ড যোদ্ধাকে নিয়ে এক মিনিটের ভিডিও বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এই মানুষটি সম্পর্কে বলেন, 'মোস্ট ইন্সপায়ারিং ম্যান এভার!' সত্যিই ইরফান হাফিজ এই যুগের এক অনুপ্রেরণাদায়ী যোদ্ধা! তিনি বেঁচে থাকবেন তার গল্পে, তার বইয়ে, তার কথায়, তার কীবোর্ডে রেখে যাওয়া আঙ্গুলের ছোঁয়ায়...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা