খালেদ মোশাররফ: যে সুপারহিরোকে ভুলে গেছে বাংলাদেশ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তিনি বলতেন, "কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্তস্নাত শহীদ।" রাজনৈতিক কূটচালে পরাজিত হয়ে অকুতোভয় সেই বীর যোদ্ধা নিজেই হারিয়ে গেলেন কালের গর্ভে, 'সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস' বা 'বিপ্লব ও সংহতি দিবস' টাইপের বাহারী নামের ভীড়ে হারিয়ে গেল তার প্রয়াণ দিবসটাও...
ক্রাক প্ল্যাটুনের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেই যে ছেলেগুলো তিনটি গ্রেনেড ছুড়ে মারলো চকচকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর ভেতরে, মনে পড়ে? যদিও পরিকল্পনা, রেকি করা হচ্ছিলো বেশ ক'দিন ধরেই। এবং হাই সিকিউরিটির এরকম এক জায়গায় অতর্কিত হামলায় নড়েচড়ে বসেছিলো দুই পাকিস্তানের প্রায় সবাই-ই। বিস্ময়ের রেশ কাটেনি, দুই মাস পরে ফের হামলা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কুশীলব? আগের মানুষজনই। ২৮ পাউন্ড বিস্ফোরকের তাণ্ডবে কেঁপে ওঠে আবারো এই প্রবল গুরুত্বপূর্ণ ভবন। পুরোপুরি টনক নড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আন্তজার্তিক মাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের নৃশংসতা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার খবর। ঠিক এটাই চাইছিলো এই অপারেশনের পেছনের কুশীলবেরা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর অপারেশনের খবর যখন এই তরুণদের লিডারের কাছে পৌঁছায় তিনি হেসে বলেন-
These are Crack People...
তখন থেকেই তরুণদের এই গেরিলা বাহিনীটির নাম 'ক্র্যাক প্ল্যাটুন।'
অসম্ভব স্মার্ট এই মানুষটি, যিনি 'ক্র্যাক প্ল্যাটুন' এর নামকরণ করলেন, তিনিই মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টর এবং কে ফোর্সের প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ। যিনিই প্রথমে ভেবেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর বহির্বিশ্বের কাছে যাচ্ছে না। যেটা যাওয়া দরকার। বিশ্বের নানাপ্রান্তের বাঙ্গালীদের জানা দরকার, কী হচ্ছে এখানে। পরিকল্পনা আঁটলেন। রুমি, বদি, আজাদ, সামাদ, বকর, জুয়েল কে নিয়ে টিএম হায়দার এর সাহায্যে গঠন করলেন গেরিলা বাহিনী; 'ক্র্যাক প্ল্যাটুন।' পুরো মুক্তিযুদ্ধেই যারা দেখিয়েছে একের পর এক ক্যামিও। 'হিট এ্যান্ড রান' ট্যাকটিকসে চলা তাদের অপারেশন পাকিস্তানিদের তটস্থ রেখেছে যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময়ে।
আজকের লেখা 'ক্র্যাক প্ল্যাটুন' নিয়ে না। আজকের লেখা 'ক্র্যাক প্ল্যাটুন' এর লিডার, বাঙ্গালীর সুপারহিরো 'খালেদ মোশাররফ' কে নিয়ে। তাকে 'সুপারহিরো' ডাকাটা কেউ কেউ অতিশয়োক্তি ভাবতে পারেন। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই, তিনি আসলেই ছিলেন অন্যরকম চৌকষ এক নেতা। আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি, আজ ৭ই নভেম্বর। হালকা কুয়াশা আর শীত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আশেপাশে। এরকমই এক কুয়াশায় ডুবে যাওয়া শীতের দিনে মারা যান তিনি। এরকমই এক সাতই নভেম্বরে। এক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ার সময়ে।
খালেদ মোশাররফের জন্ম জামালপুরের ইসলামপুর থানার মোশাররফগঞ্জ গ্রামে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তার নামের শেষ অংশের নামেই গ্রামের নাম- মোশাররফগঞ্জ! অবশ্য পুরো বিষয়টিই কাকতালীয়।কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ এ পড়াশোনা শেষে তিনি যোগ দেন পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে। সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়ার পরে পয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পরে কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবেও যোগ দেন। প্রমোশন হয়। মেজর হন । পরবর্তীতে বিগ্রেড মেজর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সত্তর সালের দিকে তিনি যখন জার্মানি ও ইউকে তে যাবেন প্রশিক্ষণের জন্যে, তখনই তাকে ঢাকায় বদলি করা হয়।
অপারেশন সার্চলাইটের মাত্র একদিন আগে তাকে কুমিল্লাতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। এর একদিন পরেই ঘটে ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। ঢাকার এই গনহত্যার খবর যখন পান, খালেদ মোশাররফ তখন মৌলভীবাজারে। তিনি সাথে সাথেই বিদ্রোহ করেন। সাথে থাকা দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে রওয়ানা দেন ব্রাহ্মনবাড়িয়ার দিকে। খবর পেয়ে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত জামিল তার কোম্পানির সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন খালেদ মোশাররফের জন্যে। মোশাররফ যখন ব্রাহ্মনবাড়িয়া পৌঁছান, তখন তাঁর বাহিনী ও মেজর শাফায়াত জামিলের বাহিনী মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঞ্জাবি সৈনিকদের অ্যাটাক করেন। পাঞ্জাবিদের উৎখাত করে কিছুদিন ব্রাহ্মনবাড়িয়াতেই থাকেন খালেদ মোশাররফ৷ পরবর্তীতে তেলিপাড়া চা বাগানে ইউনিট স্থাপন করে অপারেশন চালাতে থাকে তাঁর সৈন্যরা।

এখানে থেকেই পাকিস্তানিদের দমন করার কাজ ভালোভাবে সামলে যাচ্ছিলেন তিনি। এপ্রিলের শেষদিকে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিমান আক্রমণ করে খালেদ মোশাররফ এর ঘাঁটিতে। পাকিস্তানি হানাদারেরাও বুঝতে পেরেছিলো, খালেদ মোশাররফকে জলে, স্থলে আটকানো যাবে না। তাই এই বিমান হামলা। তিনি তখন ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থান নেন। এরপর মুজিবনগর সরকার তাকে ২ নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়। তিনি চলে আসেন ঢাকার অদূরে মেলাঘরে। শুরু হয় 'কে-ফোর্স' এর কাজকর্ম। এরপরের ঘটনা আমরা জানি। ক্র্যাক প্ল্যাটুনের কথা আমরা জানি। মেলাঘরের ইন্টারেস্টিং সব অপারেশনের কথাও জানি। সময়ের ফেরে যুদ্ধ ক্রমশ বাঙ্গালীদের হাতের মুঠোয় আসছিলো। যুদ্ধের শেষদিকে এসে খালেদ মোশাররফের মাথায় গুলি লাগে। মারাত্মক আহত হন। পরবর্তীতে লখনৌ নিয়ে গিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে একটা গল্প আছে। মাথায় গুলি লাগার ফলে খালেদ মোশাররফের মাথায় একটা গভীর গর্ত হয়। পরিচিত মানুষজন যখন তাকে দেখতে আসে যুদ্ধের পরে, তিনি হাসতে হাসতেই বলেছিলেন-
দ্যাখো, বাংলাদেশ আমাকে কী উপহার দিয়েছে। মাথায় একটা গুলির ক্ষত। এরচেয়ে ভালো উপহার আর কিন্তু হয়না!
যুদ্ধের পর খালেদ মোশাররফ ঢাকা সেনা সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হিসেবেও নিয়োগপ্রাপ্ত হন। খালেদ মোশাররফকে 'বীর উত্তম' উপাধিতেও ভূষিত করা হয় পরবর্তীতে। সব ঠিকঠাক চলছিলো। এরমধ্যেই আসে পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট! সেই ভয়াল রাত আবার। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। মোশতাক ও গং এসে সবকিছুর মালিকানা দাবী করেন। সে সাথে ক্ষমতার মসনদেও গ্যাঁট হয়ে বসেন। এই ঘটনার তিন মাস পরেই আসে ৩ নভেম্বর। আরেক ট্রাজেডি! কারাবন্দী চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার সে রাতেই খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। তিনি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। এর ঠিক তিন দিন পরে অর্থাৎ ৭ নভেম্বর আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। জিয়াউর রহমান, 'ক্রাচের কর্নেল' তাহেরের সাহায্যে মুক্ত হন। মুক্ত হয়েই পালটা এক অভ্যুত্থানের ডাক দেন। সেদিনই ২ নম্বর সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড লে. কর্নেল এটিএম হায়দার (বীরউত্তম) ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কর্নেল নাজমুল হুদা বীরবিক্রমের সাথে খুন করা হয় খালেদ মোশাররফকে। কপালে ও বুকে একঝাঁক গুলি নিয়ে তিনি যখন লুটিয়ে পড়ছেন মাটিতে, কোথাও যেন আমরা শুনতে পাই জীবনানন্দ দাসের কবিতার সেই লাইন-
নক্ষত্রেরও তো মরে যেতে হয়, নাকি?
শেষে কয়টা আক্ষেপের কথা বলে যাই। খালেদ মোশাররফের মৃত্যু নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। বলা হয়, অভ্যুত্থান করতে আসা বিদ্রোহী সিপাহীরা তাকে হত্যা করেছিলো। আবার আমরা এটাও শুনতে পাই, জেনারেল জিয়ার পরিচিত সেনা কর্মকতারাই তাকে হত্যা করে। এটা তো সত্যি, স্বাধীনতা পরবর্তী সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে কয়েকটা গ্রুপ বেশ প্রকট ছিলো। এক গ্রুপের প্রধান ছিলেন জিয়া, আরেক গ্রুপের প্রধান খালেদ মোশাররফ। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব যে ছিলো, তা তো বলাই বাহুল্য। সে দ্বন্দ্বের বলিই কী না খালেদ মোশাররফ, সেটা অবশ্যই এক গুরুতর বিতর্কের বিষয়। ঝাপসা সব প্রেক্ষাপটের পেছনে শক্তিমান কুশীলবদের কারনেই পঁচাত্তরের এত বছর পরে এসেও দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের হত্যার কোনো বিচার হলোনা কী না, খতিয়ে দেখা উচিত সেটিও।

খালেদ মোশাররফকে কারা বা কাদের আদেশেই এভাবে হত্যা করা হয়, সেটাও থেকে গিয়েছে অস্পষ্ট। এ পর্যন্ত কোনো মামলায় দায়ের হয়নি, এই মানুষের হত্যাকান্ড নিয়ে। কেউই কেন যেন আগ্রহী না, তাকে নিয়ে কথা বলার জন্যে। অথচ এরকমটা হওয়ার কথা ছিলো না। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যিনি এসেছিলেন দেশের জন্যে, পরিবার সংসার সব ভুলে যিনি পাগলের মত করে গিয়েছেন যুদ্ধ, তাকেই মনে রাখিনি আমরা কেউ। মাথায় গুলির গভীর ক্ষত নিয়ে যে মানুষ হাসতে হাসতে বললেন, এটাই আমাকে দেয়া বাংলাদেশের উপহার, তাকেই আমরা বানিয়েছি 'ভারতের দালাল!' মৃত্যুর পরে তাকে নিয়েই হয়েছে নোংরা সব রাজনীতি। ইতিহাসের বিকৃতির মহান সব যজ্ঞ। তাঁর মৃত্যুদিবসেই কেউ কেউ পালন করেছে 'সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান', 'বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে। কী দিয়েছি তাকে আমরা? এখনও বা কী দিচ্ছি আমরা? অবশ্য, এটাই তো বোধহয় স্বাভাবিক। দেশের সূর্যসন্তানদের যথাযথ সম্মান না দেয়ার যে খ্যাতি আমাদের, তা তো অক্ষুণ্ণ রাখতেই হবে।
সেই ধারাই হয়তো বজায় রাখছি আমরা। এভাবেই। লজ্জা কী লাগছে আমাদের একটুও? লজ্জা কী লাগে একটুও আমাদের? জানি না। জানা নেই।
ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা- দ্য ডেইলি স্টার
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন