জীবনের নব্বইটা বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন মানুষটা। এই বয়সটাতে এসে তার জন্য সবচাইতে আনন্দের খবর কিবা হতে পারে? না, অমরত্বের সন্ধান পাননি তিনি। আবার পেয়েছেনও...

বরাবরের মতোই এসএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে একজন ৯০ বছর বয়স্ক মানুষ বেজায় খুশি। না তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। করেছে তার নিজের বানানো স্কুলের ৪৬ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যেই সবাই কৃতকার্য হয়েছে। এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ জন।

গল্পের শুরুটা হয়েছিলো ৫৫ বছর আগে। সময়টা ছিলো ১৯৬৫ সাল। চা বিক্রি করেই জীবনযাপন করতেন আমাদের গল্পের নায়ক আব্দুল খালেক। যে অল্প টাকা কামাই হতো, সেটা থেকেই সঞ্চয় করতেন তিনি। এভাবেই প্রায় ৭ হাজার টাকা জমিয়ে ফেললেন।

সেই টাকা দিয়ে খুব শখ করে এক টুকরো স্বপ্ন কিনে রেখেছিলেন। তার কেনা ৫২ শতকের সেই জমিটা ১৯৯৭ সালে এসে দান করে দিলেন বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য। সেই উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর, গত বছরের অক্টোবরে এমপিওভুক্ত করা হয়।   

শিক্ষানুরাগী আব্দুল খালেক

শিক্ষানুরাগী আব্দুল খালেকের নিবাস কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে। উচ্চবিদ্যালয়টির নামকরণও করা হয়ে তার গ্রামের নামেই। বর্তমানে সেখানে অধ্যায়ণ করছে ৪৩৭ জন শিক্ষার্থী। তাদের জন্য প্রধান শিক্ষকসহ স্থায়ী শিক্ষক আছেন ছয়জন, খন্ডকালীন শিক্ষক চারজন।  

অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে সে গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতো। কেউ কেউ খুব কষ্টে বিএ পাশ করতে পারতো শেষ পর্যন্ত। তবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই লিখতে পড়তে পারতো না। এই ব্যাপারগুলোই আব্দুল মালেকের মতো একজন সাধারণ চা বিক্রেতার মনেও দাগ কাটে। সেই থেকে তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি।

নিজে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া মানুষটা একটা হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তার জন্মস্থানের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে ‘নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়’। শত শত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে থাকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তার সামনে বসেই যখন মনের সুখে চা বানান, তার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে একদম। পারিবারিক টানাপোড়েনে নিজে পড়ালেখা না করতে পারার দুঃখটাও ভুলে যান তিনি। তিনি হয়তো থাকবেন না, তবে এই হাইস্কুল একদিন ঠিকই কলেজ হবে, এই আলোকিত মানুষটার এই একটাই প্রত্যাশা।

নিজের গড়া স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে আব্দুল খালেক

এটা যদিও খুব বড় মাপের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না। তবুও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ যে সেবা পাচ্ছেন এটার মাধ্যমে, সেটা কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন চাওয়ালার পক্ষে একটা উচ্চবিদ্যালয় নির্মাণ আসলেই বিরাট ব্যাপার।

সারাটা জীবনের আয়, সঞ্চয় দিয়ে গড়া স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। মানুষের তরে নিজেকে উৎসর্গ করার মত এই দেবদূতগুলো ছিলেন বলেই চারপাশে এতো হতাশার ভিড়েও আমরা দৈব আলোর পরশ পাই। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো আপনার প্রতি, একজন আলোকিত মানুষ আব্দুল খালেক- দ্য হোপমেকার! 

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা- গাজীউল হক, প্রথম আলো

আরো পড়ুন-   


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা