হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে করোনা বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ৬১টি মৃতদেহ সৎকার করেছেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে আমাদের এই সুপারহিরো নিজেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, তবুও হারাচ্ছেন না সাহস...

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হবার পরে কিছু মানুষ হৃদয়ের গভীর থেকে মায়া আর ভালোবাসার বিশাল এক ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে অসহায়-বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য কাজ করছেন, তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের নামটা থাকবে একদম ওপরের দিকে। এই ভদ্রলোক তার দলবল নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের লাশ দাফন করছেন গত ৮ই এপ্রিল থেকে। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এই তথ্য জানিয়েছেন কমিশনার খোরশেদ নিজেই।

কাউন্সিলর খোরশেদ ফেসবুক লাইভে এসে বলেছেন- "শনিবার নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়েছি। এতে আমার দেহে করোনাভাইরাসে উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বর্তমানে নিজ বাড়িতেই আইসোলেশনে আছি। বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবো। সবাই আমার সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন। আমি আক্রান্ত হলেও আমার সব কার্যক্রম চলবে। আমার টিম সব সময় সক্রিয় থাকবে, আমার ফোনও চালু থাকবে। আমি যতোদিন বেঁচে আছি করোনাযুদ্ধ থেকে এক বিন্দুও পিছ পা হবো না।" 

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

নিজে করোনায় আক্রান্ত হলেও, ভয় বা আতঙ্ক বিন্দুমাত্র জায়গা করে নিতে পারেনি তার মনের ভেতরে। দেশের মানুষের কাছে তিনি দোয়া চেয়েছেন, বলেছেন, তার অবর্তমানে সব কাজই ঠিকঠাক চলবে। বাসায় বসেই সবকিছু দেখভাল করবেন তিনি। বুকের ভেতর সাহসের বিশাল এক স্ফুলিঙ্গ নিয়ে বাস করেন কাউন্সিলর খোরশেদ। নইলে গত দুই মাস ধরে তিনি যা করে চলেছেন, যেভাবে মানুষের বিপদে এগিয়ে এসেছেন, সেরকম নজির তো গোটা বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায়নি! ব্যক্তি পর্যায়ে তো একদমই নয়! 

কী করেছেন কাউন্সিলর খোরশেদ? 

করোনায় আক্রান্ত লাশের সংস্পর্শে গেলে করোনাত আক্রান্ত হতে পারেন- এই শঙ্কায় মৃত লাশের ধারেকাছে যাচ্ছে না কেউ, এমনকি নিকটাত্মীয়রাও দূরত্ব বজায় রাখছেন। করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। এমনও হয়েছে, পুরো একদিন করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত কোন ব্যক্তির লাশ পড়েছিল ঘরের কোণে, আতঙ্কে কেউ আসেনি। নারায়ণগঞ্জে এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটার পর কমিশনার খোরশেদ কাজে নামলেন। সরকারের কাছে তিনি এসব মৃতদেহ সৎকারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলেন। 

কমিশনার খোরশেদ জানতেন, ফাইল-পত্রের বাধা পেরিয়ে তার আবেদন পাশ হত্ব সময় লাগবে। মৃত্যুর মিছিল তো থেমে থাকবে না এই সময়ে। তাই অনুমতির অপেক্ষা না করেই কাজে নেমে গেলেন তিনি। রাজনীতি করেন তিনি, গত পনেরো বছর ধরে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একটা হাঁক দিলে শ'খানেক কর্মী হাজির হয়ে যায়। কিন্ত এবার খানিকটা ব্যতিক্রম হলো। জানের ভয়ে পিছু হঠলো অনেকেই। কেউ কেউ আবার খোরশেদ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। অল্প কয়েকজনকে নিয়েই প্রাণঘাতি এক মিশন শুরু করলেন খোরশেদ, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের যথাযথভাবে দাফনের মিশন।

পরিবারের বাধা

শুরুতে বাধা দিয়েছে পরিবার। তারা বুঝিয়েছে, মানুষের জন্যে কাজ করতে চাইলে আরও নানাভাবে করা যায়। এভাবে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে বরণ করার কোন মানে নেই, এটা নিছকই পাগলামি! কিন্ত খোরশেদের মনে যে তখন পাগলামি ভর করেছে। মানুষের জন্যে কাজ করাটাই তো একরকমের পাগলামি, অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয় মন, নেশার মতো হয়ে যায় ব্যাপারটা। খোরশেদের বেলাতেও সেটাই ঘটলো। মানুষটা অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন। ভালো কাজ করার ঘোর, বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। 

শুরু হলো লড়াই! 

নারায়ণগঞ্জ শহরের আমলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নিয়তি রানী বণিক। তার বাবা হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক ডা. কৈলাস বণিক গত ১৯ এপ্রিল করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর লাশটা পড়েছিল ঘরের ভেতরে, ডেকেও কাউকে আনা যাচ্ছিল না শেষকৃত্যের জন্য। একে একে আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ফোন করেছেন নিয়তি রাণী বণিক। সবাই পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন, আতঙ্কে জেরবার হয়েছেন। বাড়িওয়ালার পরামর্শে নিয়তি তখন ফোন করলেন কাউন্সিলর খোরশেদকে, ফোন পাওয়ামাত্রই ছুটে এলেন তিনি। তারপর কি হয়েছিল? নিয়তি রানীর মুখ থেকেই শোনা যাক-

সাহায্যের ডাক পড়লেই ছুটে গেছেন কাউন্সিলর খোরশেদ

'মা, ভাই মারা যাওয়ার পর বাবারে আগলাইয়্যা রাখছিলাম নিজের কাছে। বাবা সারা জীবন মানুষের চিকিৎসা করছেন। অথচ বাবা মারা যাওনের পর কেউ কাছে আসে নাই। আমার আত্মীয়রাও আসে নাই, সবাই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিছিল। তখন এই দুর্দিনে কাউন্সিলর খোরশেদ ভাই দৌড়াইয়্যা আসছেন। আমি বাবার মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দিছি, খোরশেদ ভাই আমার হাত ধইরা পাশে ছিলেন। এইটাই তো অনেক বড় পাওয়া। বাবার সৎকারে যতটুকু নিয়ম পালন করা সম্ভব, তার সবই করছেন খোরশেদ ভাই আর তার দলের লোকজন।'

'বাবার যে করোনা হইছিল, তা-ও না। মারা যাওয়ার আগে গলায় শুধু কাশ জমছিল। এখন তো কেউ মারা গেলেই কয় করোনায় মারা গেছে। তাই বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ আসে নাই। আমার ভাই নাই। চাচাতো ভাইয়েরা আসে নাই। খোরশেদ ভাই আমার কেউ না, তবুও সে আসছে, সব ব্যবস্থা করছে। আমিই বাবার মুখে আগুন দিই।'

১৯শে এপ্রিলেরই আরেকটা ঘটনা। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিপিবি’র নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সদস্য ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড সেক্রেটারি বিকাশ সাহা। সন্ধ্যায় মরদেহ মাসদাইর শ্মশানে নিয়ে আসা হলে লোক পাওয়া যাচ্ছিল না সাহায্যের জন্য। মৃতের পরিবারের সদস্যরা যখন অসহায় অবস্থায় লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শশ্মানে, তখন দাহ করতে এগিয়ে এলেন কাউন্সিলর খোরশেদ।

বিকাশ সাহার ছেলে অনির্বাণ সাহা বলছিলেন, ‘বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন শুনে আত্মীয় স্বজন কেউ আসেনি। আমার একার পক্ষে বাবার মরদেহ দাহ করা সম্ভব ছিল না। কারণ দাহ করতে অনেক নিয়ম-কানুন আছে। এতো কিছু আমি একা কীভাবে করবো। আর কেউ এগিয়েও আসছিল না। তাই খোরশেদ কাকাকে খবর দিই, তিনি এসে সহযোগিতা করেছেন। নইলে সেদিন বাবার মুখাগ্নি করতেই পারতাম না হয়তো।’

হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের মানুষকেই প্রাপ্য শেষ সম্মানটা দিয়েছেন তারা

যারা ভাবছেন, কাউন্সিলর খোরশেদ বুঝি শুধু হিন্দু মৃতদেহ সৎকারেই সাহায্য করেন, তাদের জন্যে নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়া এলাকার একটা ঘটনা বলি এবার। একই পরিবারের তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন সেখানে, কয়েকদিনের ব্যবধানে। তিন জনের মরদেহই দাফন করেছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। সেই পরিবারের এক সদস্য টুটুল আহমেদ বলছিলেন- ‘কী দুর্ভাগ্য যে এক এক করে খালা, মামা ও মামাতো বোন- সবাইকে হারালাম। খোরশেদ ভাই সবাইকে দাফন করেছেন। উনি আমাদের রক্তের সম্পর্কের না হলেও, এখন তিনিই সব থেকে বড় আপনজন। তিনি না থাকলে হয়তো জানাজা ছাড়াই মরদেহ দাফন করতে হত। শুধুমাত্র উনার কারণেই ধর্মীয় রীতিতে মাটি পেয়েছে তিনজন।’ 

এপর্যন্ত দলবল নিয়ে ৬১টি মৃতদেহকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শেষ বিদায় জানিয়েছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। সব খরচ বহন করেছেন তিনি নিজে। শুধু দাফন-সৎকার নয়, যতোভাবে সম্ভব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পরে দোকান থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর হেক্সিসল উধাও হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেও কিনতে গিয়ে পাননি। পরে গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী কাঁচামাল কিনে নিজেই লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ষাট হাজার বোতল হেক্সিসল বানিয়ে ফেলেছেন, সেগুলো বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন শহরের লোকজনের মধ্যে। 

কাউন্সিলর খোরশেদের কথা 

কেন মৃত্যুর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে, পরিবারের বাধা ডিঙিয়ে শুরু করলেন এই কাজ? কাউন্সিলর খোরশেদ উত্তর দিয়েছেন- "শুরুতে যখন দেখলাম করোনায় আক্রান্ত হলে স্বজনরা লাশের কাছে যেতে চায় না। মানবিক দিক বিবেচনা করে এটা মাথায় এসেছে। আসলে মানুষের বিপদের দিনেই পাশে থাকা জরুরি। এখনই মানুষের সব থেকে বড় বিপদ চলছে। এ ছাড়াও, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজে এসেছি। আমি হঠাৎ করে এ কাজ শুরু করিনি। প্রথমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানানো ও বিতরণ করা থেকে এ কাজে যুক্ত হলাম। এভাবে জড়িয়ে পড়েছি বলেই পরিবার কোনো বাধা দিতে পারেনি। তারপরও পরিবার ভীত, বারবার অনুরোধ করে সর্তক থাকার জন্য।’

খোরশেদের জন্য প্রার্থনা

কাউন্সিলর খোরশেদের স্ত্রী-ও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রার্থনা করি, তারা দুজনেই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন খুব দ্রুত। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে এখনও অনেকটা পথ বাকী। এই অক্লান্ত যোদ্ধাকে আমাদের বড্ড প্রয়োজন। কাউন্সিলর খোরশেদকে যতো দেখি তত অবাক হই। মানুষটা যেন হুমায়ূন আহমেদের বই থেকে উঠে আসা কোন চরিত্র, ভালো কাজের নেশা যাকে পেয়ে বসেছে! অনেক বছর পরে কোন একদিন নিশ্চয়ই আমি আমার উত্তরসূরীদের খোরশেদ ভাইয়ের গল্প শোনাবো, তাদের বলব, আমি সুপারহিরো দেখিনি, কাউন্সিলর খোরশেদকে দেখেছিলাম... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা