ক্ষুদিরাম বসু: হাসিমুখে যিনি ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ফাঁসির মঞ্চে হাসি মুখে যিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি ক্ষুদিরাম। নশ্বর দেহ ত্যাগ করে যিনি চিরন্তন প্রেরণার নাম হয়েছেন তিনি ক্ষুদিরাম। অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম।
মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম:
ফাঁসির মঞ্চে হাসি মুখে যিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি ক্ষুদিরাম। নশ্বর দেহ ত্যাগ করে যিনি চিরন্তন প্রেরণার নাম হয়েছেন তিনি ক্ষুদিরাম। অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম। অদম্য সাহস আর নিখাদ দেশপ্রেমের কাছে প্রতাপশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে অবজ্ঞা করে এর গাঁয়ে খানিকটা হলেও দাগ কেটে যাওয়া ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লব ঘটানোর পথ তৈরি করে দেয়া ব্যক্তির নাম ক্ষুদিরাম। জানতে ইচ্ছে হয় কি তার সম্পর্কে?
শৈশব
ক্ষুদিরাম ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ত্রৈলোক্যনাথ ও লক্ষ্মীপ্রিয়াদেবীর ঘরে তিন মেয়ের পর জন্ম হয় সবার ছোট ছেলে ক্ষুদিরামের। তবে ক্ষুদিরামের আগে লক্ষ্মীপ্রিয়ার গর্ভে আরো দুই ছেলের জন্ম হলেও উভয়েই প্রসবকালীন জটিলতায় মারা যায়। কুসংস্কারে বিশ্বাসী লক্ষ্মীপ্রিয়া সন্তান মৃত্যু ঠেকাতে ‘তিন মুঠো চালের ক্ষুদ’ এর একটি বিশেষ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান পালন করেন এবং পরে শিশু ক্ষুদিরাম সুস্থভাবে জন্ম নিলে ধারনা করা হয় তিন মুঠো ক্ষুদই তার জীবন রক্ষা করেছে। তাই তার নামকরণ করা ক্ষুদিরাম!
চলচ্চিত্রের কাহিনীকেও হার মানায় এই ‘তিন মুঠো ক্ষুদ’ প্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী সন্তান বাঁচাতে হলে শিশুটিকে কারো কাছে তিন মুঠো ক্ষুদের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিতে হতো। লক্ষ্মীপ্রিয়া তার সন্তানকে নিজের বড় মেয়ে অপরূপার কাছে বিক্রয় করেছিলেন এবং সন্তানের সাথে চিরতরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলন। ক্ষুদিরাম বেঁচে ছিলেন ঠিকই কিন্তু মা বাবার স্নেহ বঞ্চিত থেকে। কেননা জন্ম থেকেই তিনি বড় হন নিজের বোনের কাছে।
বিপ্লবের পথে
ক্ষুদিরামের প্রতিটি রক্তের ফোঁটায় বিপ্লব মেশানো ছিল। শৈশব থেকেই তিনি বিপ্লবী তেজে তেজদ্বীপ্ত ছিলেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী নেতৃত্ব দেয়ার সহজাত গুণাবলীও তার মাঝে দ্রুতই বিকশিত হয়। ১৯০৩ সালে স্যার অরবিন্দ এবং নিবেদিতা মেদিনীপুর গিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে উৎসাহিত করতে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সী টগবগে কিশোর ক্ষুদিরাম সেদিন সেই বক্তৃতা শুনেছিলেন এবং ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি স্যার অরবিন্দের গোপন পরিকল্পনায় অংশ নেন।
১৯০৪ সালে ক্ষুদিরাম মেদিনীপুরের মূল শহরে চলে আসেন। সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন। তার এই সক্রিয় রাজনীতির পেছনে কেবল স্যার অরবিন্দের অনুপ্রেরণাই নয়, কাজ করেছিল তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জাগরণী মন্ত্র। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে দেন ক্ষুদিরাম। দেশের জন্য পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় যে হয়ে গিয়েছিল! ক্ষুদিরাম যোগ দিলেন যুগান্তর নামক বিপ্লবী এক রাজনৈতিক সংগঠনে।
মুজাফফরপুরের ঘটনা
তৎকালীন কলকাতা প্রেসিডেন্সির মেজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। যুগান্তরের সাংগঠনিক প্রধানরা কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করলেন। দায়িত্ব দেয়া হলো দুই তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকিকে। দায়িত্ব নিয়েই নাম পাল্টে ক্ষুদিরাম হয়ে গেলেন হারেন সরকার আর প্রফুল্ল হলেন দিনেশ রয়। তারা মুজাফফরপুর গিয়ে কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যেয়ের ধর্মশালায় আশ্রয় নিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা কোর্টের আশেপাশে অবস্থান নিলেন। কিংসফোর্ড বের হলেই বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে তাকে। কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হবার শঙ্কায় তারা এই পরিকল্পনা বাদ দিলেন এবং কিংসফোর্ডকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন।
৩০ এপ্রিল ১৯০৮ সাল। ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকি অবস্থান নিয়েছেন ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে। কিংসফোর্ডের গাড়ি সেখানে পৌঁছা মাত্রই উভয়ে একথে গাড়ির উপর বোমা ছুড়ে মারলেন এবং গুলি চালালেন। গাড়ির ভেতরে সবাই মারা গেছে অনুধাবন করে উভয়েই সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন কিংসফোর্ড মারা যান নি। তার গাড়ির ভেতরে ছিল কলকাতার একজন ব্যারিস্টারের স্ত্রী ও কন্যা। এই খবর পেয়ে অনুতাপে মুষড়ে পরেন উভয় যুবক। তাছাড়া তখন থেকেই তারা পুলিশের নজর এড়িয়ে চলা শুরু করেন।
প্রফুল্ল চাকির মৃত্যু
কিংসফোর্ডকে মারার ব্যর্থ চেষ্টার পর ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকি উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করেছিলেন মেদিনীপুর ফিরে যাবার জন্য। ক্ষুদিরামের কথায় পরে আসছি, প্রফুল্ল চাকি এসময় মুজাফফরপুরের এক স্থানীয় বাসিন্দার বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন। বাড়ির মালিক প্রফুল্ল চাকিকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে যত্ন করেছিলেন এবং কলকাতা যাবার টিকিট কেটে দিয়েছিলেন। মাঝপথে ট্রেন পরিবর্তন করতে হতো চাকির। তবে হাওড়া যাবার সেই দ্বিতীয় ট্রেনে আর ওঠা হয়নি তার। প্রথম ট্রেনের ভেতরেই তাকে দেখে সন্দেহ করে ব্রিটিশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জী। খুব দ্রুতই তথ্য উপাত্ত মিলিয়ে তিনি প্রফুল্ল চাকির মুজাফফরপুর ঘটনার সাথে যোগ থাকার কথা উদঘাটন করেন। ট্রেন পরিবর্তন করতে প্রথম ট্রেন থেকে নেমে পড়তেই প্রফুল্ল চাকিকে নন্দলাল ব্যানার্জী ও তার কনস্টেবলরা ঘিরে ফেলে। প্রফুল্ল চাকি প্রথমে নন্দলালকে গুলি করে মারতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর তিনি নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন, তবু ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা তিনি পড়েননি!
ক্ষুদিরামের গ্রেপ্তার
প্রফুল্ল চাকির কথা তো গেল, ক্ষুদিরামও মুজাফফরপুর থেকে বের হবার পথ খুঁজছিলেন। ঘটনার পরপরই পুরো মুজাফফরপুর জুড়ে সশস্ত্র পুলিশে ছেয়ে যায়। বিশেষ করে ট্রেন স্টেশন গুলোতে বসানো হয় পুলিশের কড়া পাহারা। ক্ষুদিরাম তাই ঠিক করলেন হেঁটেই মুজাফফরপুর থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করছিল ওয়াইনি নামক স্থানে। দীর্ঘ পথ হেঁটে সেখানে এক গ্লাস পানির জন্য একটি চায়ের দোকানে দাঁড়ালেন ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুদিরাম। আর তখনই পাশে থাকা কনস্টেবলদের সন্দেহের নজর পড়লো ক্ষুদিরামে উপর। তারা ক্ষুদিরামের দেহে তল্লাশি চালিয়ে একটি রিভলবার এবং ৩৭ রাউন্ড বুলেট পেল। গ্রেপ্তার হলেন ক্ষুদিরাম। দিনটি ছিল ১৯০৮ সালের পহেলা মেয়ে। আগেরদিন ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা একজন আঠারো বছর বয়সের যুবক!
তাকে গ্রেপ্তার করে যখন মুজাফফরপুর স্টেশনে নিয়ে আসা হলো, তখন হাজারো মানুষ ভিড় করেছে সেখানে একজন ‘সন্ত্রাসী’ কে দেখবে বলে। চারিদিকে মানুষের বিস্ময়ভরা দৃষ্টিরমাঝে ক্ষুদিরাম কেবল কাঁপা কাঁপা গলায় অবিরাম বলে গেলেন, “বন্দে মাতারম!” ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে নিয়ে পুলিশ মারধর সহ সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছিল সেই ঘটনার সাথে আর কে বা কারা যুক্ত ছিল তা জানার জন্য। কিন্তু ক্ষুদিরামের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয়নি তার সাথির ব্যাপারে। তিনি পুরো ঘটনার দায় একা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। কিন্তু যখনই তার সামনে মৃত প্রফুল্ল চাকির দেহ আনা হলো, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং সব স্বীকার করলেন।
আদালতের বিচার এবং মৃত্যু
ক্ষুদিরামকে ২ মে কারাগারে পাঠানো হয়। ২১শে মেয়ে তার বিচারকাজ শুরু হয়। উপেন্দ্রনাথ সেন, কালিদাস বসু আর সেত্রানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পক্ষের আইনজীবী হয়ে লড়াই করেন। তারা কেউই এই কাজের জন্য কোনোপ্রকার অর্থ নেননি। তাদের উপদেশ অনুযায়ী ক্ষুদিরাম ২৩ মে তারিখে নিজের প্রথম জবানবন্দিতে মুজাফফরপুর ঘটনার সাথে নিজের সংযোগ অস্বীকার করেন। আদালত চূড়ান্ত রায়ের দিন জুনের ১৩ তারিখ ঠিক করে দেন। ১২ জুন ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। আদালতের বিচারকরা বেনামি চিঠি লাভ করেন যে আরো অনেক বড় বোমাহামলার ঘটনা ঘটবে যা কিনা কোনো বাঙালি নয় বরং বিহারীরা ঘটাবে।
এই চিঠির প্রেক্ষিতে বিবাদী পক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায় ঠেকাতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহী আর বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে যা হবার তাই হলো। ১৩ জুন চূড়ান্ত রায়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায় হলো। তিনি হাসিমুখে সে রায় মেনে নিলেন। এমনকি উচ্চ আদালতে আর আপিল করবেন না বলেও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু তার উকিলরা তাকে এই বলে রাজি করালেন যে আপিল করে যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নেয়া যায় তাহলে ক্ষুদিরাম পরবর্তীতে দেশের জন্য আরো অনেক কাজ করতে পারবেন। রাজি হলেন ক্ষুদিরাম। আপিল হলো উচ্চ আদালতে।
এবার ক্ষুদিরামের পক্ষে লড়লেন নরেন্দ্রকুমার বসু। ৮ জুলাই প্রথম শুনানিতে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ১৩ জুলাই রায়ের দিন ধার্য করা হয়। নরেন্দ্রকুমার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে রায়ে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার দিকে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। শেষ পর্যন্ত গভর্নরের কাছে আপিল করা হয়। কিন্তু ১১ আগস্ট ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল আপিল প্রত্যাখ্যান করে দিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এই রায় সর্বস্তরের জনগণের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। হাজারো মানুষ জড়ো হয় আদালতের সামনে। তারা শ্লোগান দিতে থাকে ক্ষুদিরামের পক্ষে। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোও ক্ষুদিরামের জন্য প্রচার প্রচারণা চালায়। কিন্তু মৃত্যু ছিল অবধারিত।
১১ই আগস্ট ১৯০৮, আজ থেকে ঠিক ১১২ বছর আগে নির্ভিক ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে পড়েন। মৃত্যু? সে আবার কী? ক্ষুদিরাম কে কি বোকা ব্রিটিশ শাসকরা মারতে পেরেছিল? বরং তরুণ প্রজন্মের মনে ক্ষুদিরামের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধে আগুনই জ্বেলে দিয়েছিল। ক্ষুদিরাম আজ আমাদের মাঝেই তো বেঁচে আছেন। তার বৈপ্লবিক আদর্শই তো আজ আমাদের রক্তে বইছে। লোককবি পীতাম্বর দাসের সেই কালজয়ী গানের দুটি চরণ দিয়ে শেষ করছি-
“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী...”
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন