ছবির এই মহিলার মুখে একটা শক্ত ডিভাইস ঢুকিয়ে টেপ মেরে রাখা হয়েছে, যাতে তিনি নিজের জিভ কামড়ে সুইসাইড করতে না পারেন! তার অপরাধ? ১১৫ জন নিরপরাধ মানুষের রক্ত লেগে আছে তার হাতে!

সিউলের উপকণ্ঠে খুবই সাধারণ একটা আবাসিক হোটেলের লবিতে বসে আছি। জায়গাটা খুব একটা পরিস্কার নয়। আমাকে জানানো হয়েছে, যার খোঁজে এসেছি, তিনি এখানেই আসবেন, আমার মোবাইল নম্বরও নাকি দেয়া হয়েছে তাকে। খানিক বাদে মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠতেই বুঝতে পারলাম, সময় সমাগত। স্ক্রীন জুড়ে অপরিচিত একটা ফোন নম্বর। রিসিভ করতেই কিন্নরকণ্ঠী এক মহিলা আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ৪০২ নম্বর রুমে যাবার নির্দেশ পেলাম। কাঁধব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির দিকে, এই হোটেলে লিফট নেই। নির্ধারিত কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ মোতাবেক তিনবার একসঙ্গে টোকা দিলাম, তারপর আরও দুইবার। খুলে গেল দরজাটা। যিনি দরজা খুলে দিলেন, তিনি ছাড়া আর কেউই নেই রুমে। ভেতরে ঢুকে হাত মেলানোর সময় ভালোভাবে খেয়াল করলাম মহিলাটাকে, একহারা গড়ন, যৌবনে দারুণ রূপসী ছিলেন সেটা বোঝার জন্যে জ্যোতিষী হওয়া লাগে না। সেই রূপের ছটা এখনও খানিকটা আছে। চোখেমুখে কেমন যেন একটা অজানা ভয়, আমাকে বোধহয় ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না তিনি। আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না, এই মহিলা ১১৫ জন মানুষের খুনের জন্যে দায়ী!

ঘটনাটা খুলেই বলা যাক। নাম তার কিম হুন হুই। কিম নামেই বেশি পরিচিত তিনি। জন্ম উত্তর কোরিয়ার কিওসুং প্রদেশে, ১৯৬২ সালে। জন্মের কিছুদিন পরেই তার পরিবার রাজধানী পিয়ং-ইয়ঙে চলে আসে, কিমের পড়াশোনা আর বেড়ে ওঠা সবটাই তাই এখানে। বাবার ইচ্ছে ছিল, মেয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিক। কিমের কিন্ত জলপাই পোষাক বা আর্মিদের কঠোর নিয়মকানুন খুব একটা পছন্দের ছিল না। বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময়টায় একদমই ভালো লাগতো না তার। ছোটবেলায় থ্রিলার বইয়ের পোকা ছিলেন, তিনি হতে চাইতেন জেমস বন্ডের মতো কেউ একজন।

ভাগ্য তাকে সেই সুযোগ এনে দিলো। উত্তর কোরিয়ায় তখন কেজিবির আদলে সিক্রেট সার্ভিস ডিভিশন(SSD) গঠিত হয়েছে। তারা কার্যক্রমও চালাচ্ছে উত্তর কোরিয়ার হয়ে। অতি জাতীয়তাবাদী এই সংগঠনের কাজ ছিল উত্তর কোরিয়ার জন্যে হুমকি হতে পারে, এরকম ব্যক্তি বা সংগঠনকে ধ্বংস করা। আর প্রতিবেশি দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক বরাবরই ছিল আদায় কাঁচকলায়। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে এই সংগঠন যে কোন কিছুই করতে পারতো, এজেন্টদের সেভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। এরা এমনই ডেসপারেট ছিল যে, এজেন্টদের জাপানী ভাষা নিখুঁতভাবে শেখানোর জন্যে বারোজন জাপানীকে কিডন্যাপ করে এনেছিল তারা!

যাই হোক, কিমের গল্পে ফিরি। সিক্রেট সার্ভিসে যোগ দেয়ার পরে দ্রুতই উন্নতি করতে লাগলো সে। কাজটা ভীষণ উপভোগ করছিল কিম। অন্যরকম একটা জীবন, হুট করে আসা উত্তেজনা কিংবা দেশের হয়ে কাজ করার ব্যাপারগুলো তাকে শুরুর দিকে ভীষণ অনুপ্রেরণা যোগাতো। সাত বছর ধরে তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, মার্শাল আর্টে ওস্তাদ হয়ে উঠেছিল সে। অনর্গল জাপানী ভাষায় কথা বলতে পারতো কিম। বাহিনীতে তার উপরস্থ কর্তারাও তার পারফরম্যান্সে বেশ খুশী ছিলেন। তবে দ্রুতই এই কাজটাতেই বিরক্তি চলে আসে কিমের। তার স্বাধীনচেতা মনোভাবটা এখানে প্রকাশ করতে পারছিলেন না ঠিকমতো, নিজেকে বন্দী বলে মনে হতো সারাক্ষণ।

কিম হুন হুই (ডানে)

১৯৮৮ সালে তাকে বাছাই করা হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের জন্যে। উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুং নিজে তাকে এই কাজের জন্যে বাছাই করেছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, এই মিশনটা ঠিকঠাকভাবে শেষ করতে পারলে তাকে সম্মানের সঙ্গে এজেন্সি থেকে বিদায় জানানো হবে। কিম সেই অফারটা পেয়ে খুশীই হয়েছিল, কিন্ত জানা ছিল না, এই একটা ঘটনা তার জীবনটাকে কিভাবে বদলে দিতে চলেছে!

১৯৮৮ অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। প্রতিবেশি দেশটার এমন উন্নতি সহ্য হয়নি উত্তর কোরিয়ার। তারা তখন পুরো বিশ্বে অবাঞ্ছিত একটা রাষ্ট্র। সেখানে তাদেরই প্রতিবেশি আর শত্রু রাষ্ট্র অলিম্পিকের মতো আসরের আয়োজন করে ফেলছে, এটা মেনে নেয়া যায় নাকি! পিয়ং ইয়ং ভাবলো, যেভাবেই হোক, দক্ষিণ কোরিয়ার সামর্থ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে, তাদেরকে বিশ্বের চোখে ভিলেন বানিয়ে দিতে হবে। সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে, দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠুনকো, অলিম্পিক বা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার আয়োজনের ক্ষমতা তাদের নেই।

পরিকল্পনা করা হলো, দক্ষিণ কোরিয়ার একটা যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করে দেয়া হবে। তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে আঁতকে উঠবে সবাই। প্রশ্ন উঠবে, যে দেশ নিজেদের নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা কিভাবে অন্য দেশের অ্যাথলেটদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? কিন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে এই অভিযান চালানো সম্ভব নয়। কাজেই অন্য কোন দেশ থেকে কোরিয়ান বিমান ধ্বংসের এই অভিযান চালাতে হবে। বেছে নেয়া হলো বাহরাইনকে। মায়ুমী হাচিয়া নামের একজন জাপানী নাগরিকের ছদ্মবেশে কিম ইউরোপে গেলেন, মিশনে তার সঙ্গী হলো আরেক এজেন্ট। সার্বিয়ার বেলগ্রেডে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার আরও কয়েকজন এজেন্টের সঙ্গে দেখা করলো তারা, ইউরোপে থাকা এজেন্টরা আগে থেকেই একটা শক্তিশালী বোমা তৈরি করে রেখেছিল, একটা রেডিও'র ভেতরে ঢোকানো ছিল বোমাটা। সেটা কিভাবে খুলতে এবং লাগাতে হয় সেটা শিখিয়ে দেয়া হলো কিমকে।

সেই বোমা নিয়ে কিম এবং তার সঙ্গী চলে এলো ইরাকে। বাগদাদের এয়ারপোর্টে বসেই কোরিয়াগামী যে বিমানে বোমা ফিট করতে হবে, সেই ফ্লাইট KAL-858 এর এক যাত্রীর সঙ্গে খাতির করে ফেললো কিম। দেখতে ভীষণ সুন্দরী ছিল সে, যাত্রী ভদ্রলোকের পটে যেতে সময় লাগলো না। আবেগী এক গল্প শুনিয়ে কিম তাকে অনুরোধ করলো, রেডিওটা কোরিয়ায় পৌঁছে দিতে। সেখান থেকে তার আত্নীয় এসে সেটা নিয়ে যাবে। লাগেজের ভেতরে ঢুকে বিমানে উঠে গেল রেডিওর ভেতরে থাকা বোমাটা! বাগদাদের কাজ শেষ করেই কিম আর তার সঙ্গী চলে এলো আবুধাবীতে, সেখান থেকে তারা গেলো বাহরাইনে। এরমধ্যে খবর এসে গেছে, ১১৫ জন যাত্রী নিয়ে কোরিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে আন্দামান সাগরে, নিহত হয়েছেন সবাই।

গ্রেফতারের পর দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে আসা হচ্ছে কিম হুন হুইকে। মুখে প্লাস্টিকের ছিপি আঁটা, যাতে জিভ কামড়ে আত্মহত্যা করতে না পারেন

গা ঢাকা দিলো কিম এবং তার সঙ্গী। কিন্ত তাতে লাভ হলো না। জাল পাসপোর্ট আর পরিচয়পত্রের ব্যাপারটা ধরা পড়তে সময় লাগলো না বেশি, বাহরাইনেই তাদেরকে খুঁজে বের করে ফেলা হলো। দুজনের কাছেই সায়ানাইড পিল ছিল, যাতে বিপদ দেখলেই সুইসাইড করা যায়। ধরা পড়া নিশ্চিত বুঝতে পেরে কিমের সঙ্গী সেটা গিলে ফেলেছিল, কিন্ত কিম পারেনি। সে ধরা পড়েছিল নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে। তার আসল পরিচয় জানার পরে তাকে পাঠানো হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। কোন কিছু গিলে ফেলে বা জিভ কামড়ে যাতে সে আত্মহত্যা করতে না পারে, সেজন্যে তার মুখের ভেতরে শক্ত একটা ডিভাইস বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে কিম স্বীকার করেছিল, কিভাবে 'দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে' তাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল বিমানে বিস্ফোরণ ঘটানোর।

দক্ষিণ কোরিয়ার আদালতে কিমের বিচার হয়েছিল। সেই বিচারে ১৯৮৯ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়া হয়। কিন্ত পরের বছরই সেই সাজা বাতিল করে তার ক্ষমা ঘোষণা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোহ তাই-উ। তিনি বলেছিলেন, প্রকৃত অপরাধী কিম নন, তাকে যারা আদেশ দিয়েছে, যারা তার ব্রেইনওয়াশ করে সেখানে জাতীয়তাবাদের ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে, যারা তাকে দেশের অস্তিত্ব রক্ষার নামে মানুষের রক্ত ঝরানো শিখিয়েছে, তারাই প্রকৃত দোষী। বিচার করলে তাদেরটা আগে করা উচিত। এমনকি কিমকে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকত্বও প্রদান করা হয় পরে। আদালতে যে উকিল তার হয়ে মামলা লড়েছিলেন, তাকেই কিম পরে বিয়ে করেছেন। দুই সন্তানের মা এখন তিনি, বাচ্চারাও বড় হয়ে গিয়েছে অনেক।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন তিনি, প্রার্থনা করতে যান, উইকেন্ডে পাহাড়ে ট্র‍্যাকিঙ করতে বেরোন, নিজে বাজার করেন, রান্নাবান্নাও করেন। তবুও মনের মধ্যে কোথায় যেন চাপা একটা আতঙ্ক কাজ করে, দেশে ফিরে না যাওয়ায় উত্তর কোরিয়া তাকে ক্ষমা করবে না, তারা নিশ্চয়ই তার ওপর প্রতিশোধ নিতে আসবে, এরকম একটা বদ্ধমূল ধারণা তার মনে চেপে বসে আছে। তিনি জানেন, দেশের হয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি কি বিশাল ভুলটা করেছিলেন, সেই উন্মাদ ফ্যানাটিক মানুষগুলো তো এখনও উত্তর কোরিয়াকে শাসন করছেন। তাই তার ভয়টা কাটে না। নিজের জীবনের গল্প নিয়ে বই লিখেছিলেন, সেই বই বিক্রির পুরো টাকাটা তিনি দান করেছেন বিস্ফোরিত বিমানে থাকা প্রত্যেক যাত্রীর স্বজনদের। তার জন্যেই ঝরে গিয়েছিল এতগুলো প্রাণ, সেই মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনার সাধ্য তো তার নেই, কিন্ত যতোটুকু তার সাধ্যে আছে, সেটা তিনি করতে চান সবসময়ই। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছেও কিম ভীষণ কৃতজ্ঞ। তাকে নতুন করে জীবন দিয়েছে তো এই দেশটাই, এই দেশের মানুষেরাই...


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা