"যাত্রাটা সহজ ছিল না সত্যি, তবে অসম্ভবও ছিল না"

উক্তিটি ভারতের হায়েদ্রাবাদে বাস করা এক নারীর, যিনি সারা বিশ্বের একমাত্র না হলেও অল্প কিছু নারী বডিবিল্ডারদের একজন। নাম তাঁর কিরন ডেম্বলা।

শুরুতে কখনোই তাঁর বডিবিল্ডার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। স্বামী-সংসার আর দুই বাচ্চা নিয়ে আর দশজন ভারতীয় গৃহিনীর মতোই ছিলেন, সুখে-দুঃখে কেটে যাচ্ছিল দিন। বিপত্তিটা বাধে ২০০৬ এ এসে, যখন মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধে তার। সংসারবন্দী কিরন অসুস্থতার কারণে ঘরবন্দী হয়ে যান। শরীর ভাল না থাকলে মন ভাল থাকে না সত্যি। কিন্তু কিরণের জন্য সে উপলব্ধি শাপে বর হয়ে আসলো। কীভাবে? শুনুন কিরনের মুখেই- 

'বিয়ের পর মেয়েরা ভীষণ নির্ভরশীল হয়ে যায় স্বামীর উপর। এটা স্বাভাবিক, বিশেষ করে আমরা, ভারতীয় গৃহিনীরা একটু বেশীই নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। ছোট-বড় যেকোনো বিষয়ে স্বামীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। স্বামী-সংসার ঘিরেই আবর্তিত হয় জীবন, থাকে না নিজের জন্য কোনো জায়গা, হয়ে ওঠে না নিজের জন্য কিছু করা। আগে এই উপলব্ধিটা অল্পস্বল্প হলেও সংসারের ব্যস্ততায় কখনো ওরকম তীব্র আক্ষেপ হয়নি। তবে অসুস্থ্য হওয়ার পর যখন বারবার পেছনে ফিরে তাকাতে লাগলাম, তখন দেখলাম নিজের জন্য কিছু করতে পারার প্রাপ্তিতে আমি শূন্য পেয়েছি। মনের ভেতর দমে থাকা আক্ষেপটা যেন জোরালো রূপ নিল। সারাটা জীবন অন্যের প্রাপ্তিতেই কেটে গেল যার, সে আমিই নিজে কিছু করার জন্য, যেকোনো কিছুতে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম'

ছোটবেলায় নিয়মিত গান করতেন কিরন। বিয়ের পর সংসারে বুঁদ হয়ে সে চর্চাটা আর হয়নি ঠিকই, তবে গানের প্রতি ভালোবাসাটা সবসময়ই ছিল। সেই গান দিয়েই 'নিজের জন্য কিছু করা'র শুরুটা করলেন। মায়ের কাছ থেকে তাঁর ১০ বছরের পুরোনো গানের বইপত্র আনলেন, নতুন করে তবলা-হারমোনিয়ামও কিনলেন, শুরু করলেন বাচ্চাদের গান শেখানো। নিজের পুরোনো কোনো অভ্যাসে ফিরতে পেরে যেন নিজেকেই ফিরে পেলেন কিরন। প্রতিদিনকার সংসারের কাজ ছাড়াও যে তিনি কোনো কাজে আসতে পারেন, তিনি যে গুড ফর নাথিং নন, তাঁরও আছে কোনো ট্যালেন্ট, সে ভাবনাটাই তাঁকে নির্মল আনন্দ দিচ্ছিল। তলানিতে পড়ে থাকা আত্মবিশ্বাসটাও যেন ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিলেন, সেখান থেকেই আগ্রহ বেড়ে গেল আরও কয়েকগুণ নিজের প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে।

বিয়ের পর দুই বাচ্চার জননী হয়ে এমনিতেই মুটিয়ে গিয়েছিলেন বেশ, এর উপর ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ওষুধের রিয়্যাকশনের কারণে ওজন বেড়ে হয়ে গেল ৭৬ কেজি। ওজনও নিয়ন্ত্রণ হবে, সময়টাও ভাল যাবে এই ভেবে ভর্তি হলেন বাড়ির পাশের জিমে। প্রতিদিন ভোর ৫টায় জিমে যেতেন, সেখানে ৪-৫ ঘন্টা ব্যায়াম করে বাড়িতে বাচ্চাদের কাছে ফিরে আসতেন। এভাবে ৬-৭ মাস কঠোর পরিশ্রম করে তিনি ২৪ কেজি ওজন কমান। তাঁর ভাষায়, '২৪ কেজি ওজন কমানোটা আমার জন্য দারুণ এক ফিরে আসা ছিল, আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল অনেক। আমার এই ৬-৭ মাসের রুটিনটাকে আমি ভালবেসে ফেলি এবং ভাবি, কিছু যদি করতেই হয়, তবে কেন এখান থেকেই নয়?' এই ভাবনা থেকেই তিনি জিম ট্রেইনার হওয়ার একটি কোর্স করে ফেলেন। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প।

২০০৮ সালে নিজেই একটি জিম দেন। সেখান থেকে তেলেগু অভিনয়শিল্পী রাম চরণের স্ত্রী উপাসনা কামিনী তাঁর খোঁজ পান এবং তার কাছে ফিটনেস ট্রেনিং নেন। উপাসনার পর অভিনয়শিল্পী তামান্না ভাটিয়া ও আনুষ্কা শেট্টিকেও তিনি ট্রেনিং দেন যথাক্রমে মিরচী ও বাহুবলী সিনেমার জন্য। ততদিনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে 'সেলেব্রিটি ফিটনেস ট্রেইনার' হিসেবে। রাজামৌলি, প্রভাস, প্রকাশ রাজের মতো তারকারাও তাঁর কাছে ট্রেনিং নেন, কেউ হয়তো তাদের নিয়মিত ফিটনেস ধরে রাখার জন্য, আবার কেউ সিনেমার কোনো চরিত্রের প্রয়োজনে।

তামান্না ভাটিয়ার সাথে কিরন ডেম্বলা

এভাবে কয়েকবছর কাটানোর পর, ২০১২ সালে মূলত তিনি বডিবিল্ডার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেননা তাঁর মনে হয়, শুধু ফিট বডি হওয়াই যথেষ্ট না, অন্য এক ধাপে নিয়ে যেতে হবে নিজেকে। অবশেষে কঠোর নিয়ম মেনে ৮ মাসে তিনি সিক্স প্যাক অর্জন করতে সক্ষম হন।

একজন নারীর বডি বিল্ডার হওয়ার বিষয়টি আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজের চোখে ভালো লাগবার কথা নয় নিশ্চিত। মানুষ তাঁর বিষয়টি কীভাবে নিল প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'মানুষ আমার এই সিদ্ধান্তকে নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টা করেছে। অনেক ধরনের তিক্ত কথা থেকে শুরু করে প্রচুর নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে। তাঁদের মতে আমাকে দেখতে পুরুষের মতো লাগে, নারীসূলভ নই একদমই। এমনকি আমার পোষাক নিয়েও খারাপ মন্তব্য করেছে। কিন্তু কাউকেই আমি আমার গন্তব্যপথে বাধা হতে দেইনি। লক্ষ্য স্থির রেখে চেষ্টা করলে সফলতা আসেই- তা আমি জানতাম। আমি সেটিই করেছি।'  

এবং তিনি সফলও হোন তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছোতে। অতঃপর ২০১৩ সালে হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত 'ওয়ার্ল্ড বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপ' প্রতিযোগিতায় একমাত্র নারী হিসেবে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পান তিনি। কিন্তু এবারও বাধা! সেই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়ার পনেরদিন আগে এক দুর্ঘটনায় পরিবারের তিনজন সদস্য মারা যায় তাঁর, ফলে দৃঢ় মানসিকতা অনেকটাই টলে যায়, অনেকটাই ভেঙে পড়েন তিনি। কিন্তু তাঁর স্বামী জানতেন এই প্রতিযোগিতাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিরনের জন্য এবং স্বামীর সহযোগিতায়, ভরসায় আস্থা পেয়ে প্রতিযোগিতাটিতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সে প্রতিযোগিতায় ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন তিনি এবং সবচেয়ে সুন্দর শরীরের খেতাব পান।

মানুষ চাইলে যে যেকোনো কিছুই পারে, তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ কিরন

বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও ভারতের কোনো প্রতিযোগিতায় তিনি কখনোই অংশগ্রহণ করেন না। কারণ হিসেবে বলেন- 'বডিবিল্ডিংয়ে নারীদের বিকিণি পরবার প্রয়োজন হয় এবং আমি জানি বেশীরভাগ ভারতীয়রা আমার বিকিণির দিকেই তাকিয়ে থাকবে, আমি জিতলাম কি হারলাম, সেটা কোনো বিষয় না তাঁদের কাছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে বডিবিল্ডিংকে খেলা হিসেবেই নেওয়া হয় এবং বিকিণি তাদের কাছে শুধুই একটি পোশাক।'

নিজেকে অনুপ্রেরণা যোগাতে কিরন তাঁর ৪৫তম জন্মদিনে নিজের সিক্স প্যাক বডির ফটোশ্যুট করে নিজেই নিজেকে উপহার দিয়েছেন। তাঁর সে ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রশংসিতও হয়েছে! 

সাহসী এই নারী শুধু ফিটনেস ট্রেইনার হিসেবেই নিজেকে আটকে রাখেননি, ডিজে বেলে নামেও সুপরিচিত তিনি। উদ্যমে ভরপুর ৪৫ বছর বয়সী এই নারী বর্তমানে এভারেস্টকে জয় করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হয়তো জয় করেও ফেলবেন এভারেস্ট, কারণ তিনি তো হার মানতে শিখেননি। কিরন ডেম্বলার মতো নারীরাই তো সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলেন- ন ডরাই!

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা