অনুমতি ছাড়া ড্রোন বা ঘুড়ি ওড়ালে নাকি দেশি বিদেশি বিমান, হেলিকপ্টার এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন সামরিক বিমানের সাথে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কাজেই ড্রোন বা ঘুড়ি ওড়ানোর জন্যে অন্তত ৪৫ দিন আগে লিখিত আবেদন করতে হবে...
একটা সময়ে এ বঙ্গদেশের অনেক জৌলুশ ছিলো। গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর মানুষের সমৃদ্ধিতে সয়লাব ছিলো এ ভূখণ্ড। সেরকম এক "স্বর্গ" থেকে পতন কেন হলো এ বঙ্গদেশের, সে নিয়ে ইতিহাসবিদরা ভালো বলতে পারবেন। তবে এই জনপদের বয়স যতই বেড়েছে, ততই তার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে জৌলুশ, সে সাথে মিলিয়ে গিয়েছে বৈচিত্র্য, বিনোদনের উৎসগুলো। নৌকাবাইচ, ঘুড়ি লড়াই, ঘোড় দৌড়, পুতুল নাচ এগুলো এখন টিকে আছে না টেকার মতন। ধুঁকে ধুঁকে এগোচ্ছে প্রাণ। কদাচিৎ দেখা মেলে এই সব আবহমান সংস্কৃতির। বিশেষ করে আক্ষেপ হয় ঘুড়ি নিয়ে। একটাসময়ে যে ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় এক বস্তু, শরৎ বা হেমন্তের বিকেলে পেঁজাতুলোর আকাশের নীচে যার ছিলো একচ্ছত্র দখলদারিত্ব, "বো-কাট্টা" ছিলো যখন রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের চেয়েও রোমাঞ্চকর, আমাদের শিল্পসাহিত্যেও যে ঘুড়ি ছিলো এক কুলীন সন্তান, সেই ঘুড়ি কেমন যেন হুট করে হারিয়ে গেলো একদিন।
এই করোনার বদ্ধসময়ে দেখেছিলাম একটি সুন্দর বিষয়। আকাশের তলে ঘুড়ি ফিরে এসেছিলো আবার, আপামর বাঙ্গালীর জীবনে। মানুষ বাইরে নামতে পারছেনা লকডাউনে। প্রত্যেক বাসার ছাদ তাই বিকেলে সয়লাব হয়ে যেতো নানা রঙা ঘুড়িতে। আশেপাশের বাসার সামনে দেখতাম, বাবা-ছেলে, ভাই-বোন মিলেমিশে ঘুড়ির কাপড় কাটছে, সুতায় মশলা লাগাচ্ছে, মাঞ্জা কাগজের প্রস্তুতি চলছে। শৈশবের উপকরণ ফিরে এসে "সেতু" হয়ে যুক্ত করছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম... এটা দেখার মধ্যে কোথায় যেন প্রশান্তিও কাজ করে। তাছাড়া ঘুড়ি বিক্রি করেও অনেক মেহনতি মানুষ দিন গুজরান করেছেন অর্থনৈতিক মন্দার এ সময়ে।
ঘুড়ি বরাবরই টানে আপামর বাঙ্গালীকে। আপনি দশজন বাঙ্গালীর "আত্মজীবনী" পড়ুন, তাদের প্রত্যেকেরই শৈশবস্মৃতিতে অব্যর্থভাবে ঘুড়ি একটা ভিন্ন দ্যোতনা দিয়েছে। এদেশের পৌষ পার্বণ, চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখবরণেও ঘুড়ি প্রধান কুশীলবই ছিলো। পুরান ঢাকার "সাকরাইন" উৎসবে এখনো ঘুড়ি নিয়ে প্রবল মাতামাতি হয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিসে উদ্ভাবিত হওয়া এই "কাগজের খেলনা" কীভাবে সারাবিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছে এবং রাখছেও দিনের পর, সে এক বিস্ময়েরই ব্যাপার।
মহামারীর প্রকোপের মধ্যে আমাদের মধ্যে "ঘুড়ি" ফিরে আসায় আমি এবং আমরা বেশ আশাবাদী হয়েছিলাম। খুশিও হয়েছিলাম। কিন্তু সে সুখ বুঝি কপালে সইলোনা আমাদের। সম্প্রতি দেখলাম, আইএসপিআর (আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর) জানিয়েছে এক নিষেধাজ্ঞা। ড্রোন, রিমোটলি পাইলটেড এয়ারক্রাফট সিস্টেম (UAs/RPAS), রিমোট কন্ট্রোল খেলনা বিমান ওড়াতে লাগবে তাদের অনুমোদন। সেখানেও সমস্যা ছিলোনা। মেনে নিচ্ছিলাম। চোখ আটকে যায় এই তালিকায় "ঘুড়ি" শব্দটিতে। এখন থেকে ঘুড়ি ওড়াতেও নাকি লাগবে তাদের পারমিশন। নাহয় কেউ ওড়াতে পারবে না ঘুড়ি!
এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে তাদের যুক্তিও বেশ অন্যরকম। তারা বলছে, উৎসাহী মানুষজন, বেসামরিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার এভাবে পারমিশন ছাড়া ড্রোন, ঘুড়ি ওড়ানোতে নাকি দেশি বিদেশি বিমান, হেলিকপ্টার এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন সামরিক বিমানের সাথে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি এ তথ্যটির সাথে একটু মিলিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম "ঘুড়ির ধাক্কায় লড়াকু বিমান ভূপাতিত" রকমের সংবাদ হওয়া সম্ভব কী না অদূর ভবিষ্যতে! এরকম আকাশকুসুম কল্পনার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না এবং তাদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, অনুমতি ছাড়া এসব ওড়ানো নাকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যেও হুমকিস্বরূপ। কী অদ্ভুত!
আরো যেটি জানা গেল তাদের নীতিমালা থেকে, এখন থেকে সবারই পারমিশন নিয়ে ঘুড়ি, খেলনা বিমান, ড্রোন চালাতে হবে। এরকম বস্তু চালাতে/ওড়াতে গেলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে একটা নির্ধারিত ফর্ম ফিলাপ করে লিখিত পূর্বানুমতি নিতে হবে ৪৫ দিন আগে। ৪৫ দিন আগে পারমিশনের জন্যে আবেদন করলে, ফলাফল কতযুগ পরে আসবে, সেটা অবশ্য আইনে নেই।
বিকেলে হঠাৎ মন কেমন করলো। ভাবলাম ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াবো। কিন্তু তা পারা যাবেনা। আমাকে অনুমতি নিতে হবে ৪৫ দিন আগে যে আমি ঘুড়ি ওড়াতে চাই। এটা ভাবতেও তো কেমন কেমন লাগছে। অথচ এটাই বাস্তবে হতে যাচ্ছে। আশঙ্কা হয়, কবে না আবার নিষেধাজ্ঞা হয়, কাগজ দিয়ে বানানো প্লেনও আকাশে ওড়ানো যাবেনা, তাহলেও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাহলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে আমাদের।
আকাশের দখল তো হারিয়েছি আগেই। এখন আস্তে আস্তে হারাচ্ছি বাকিসব। এটাই কী ভবিতব্য? জানা নেই।
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে