কোম্যান ছিলেন পিএসজির ঘরের ছেলে, একাডেমি থেকে উঠে আসা ফুটবলার। কিন্ত পেট্রোডলারের চাকচিক্যে ক্লাবটা অগ্রাহ্য করলো তাকে, চুক্তি নবায়ন করলো না। সেই কোম্যানের গোলেই গতকাল রাতে পিএসজিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতেছে বায়ার্ন। কি বলবেন একে- প্রকৃতির প্রতিশোধ?

বায়ার্ন মিউনিখের কিংবদন্তী ফ্রেঞ্চম্যান ফ্রাঙ্ক রিবেরি ক্লাব ছাড়ছেন। তাই রিবেরির বিকল্প কে হতে যাচ্ছেন তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে, যদিও মাত্র এক মৌসুম আগে জুভেন্টাস থেকে কিংসলে কোম্যানকে ভিড়িয়েছে বায়ার্ন। তবে কি কোম্যানই এখন রিবেরির শক্তিশালী বিকল্প? 'আমি নতুন রিবেরি নয়, হতেও আসেনি। আমি বরং আমিই! সে প্রতিনিয়ত আমাকে ঢের সাহায্য করেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমার নিজস্ব সামর্থ্য এবং প্রতিভা আছে দলকে অনেক কিছু দেয়ার।' জার্মান সাংবাদিকদের নিয়মিত 'নতুন রিবেরি' খুঁজে পাওয়ার তকমায় যখন কোম্যানও ঢুকে পড়লো, তখন এভাবেই মন্তব্য করেছিলেন তিনি৷

জন্ম এবং বেড়ে উঠাটা প্যারিসেই! মা ফ্রেঞ্চ হলেও বাবা ছিলেন ফ্রান্স অধ্যুষিত ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের গুয়াদেলোপ দ্বীপ হতে আগত, যা মূলত মিলে যায় থিয়েরি হেনরি, থুরাম, ম্যাককেলেদের মতো ফ্রেঞ্চ লিজেন্ডদের জীবনীর সাথেও। মাত্র ছয় বছর বয়সেই একটি স্থানীয় একাডেমীতে ফুটবলের হাতেখড়ি হয়। আট বছর বয়সে যোগ দেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনের একাডেমীতে। 

সেখানে খুব দ্রুতই উন্নতি করতে থাকেন কোম্যান, কোচদের দ্বারা আবিষ্কৃত হন বিরল প্রতিভা হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় অসাধারণ সামর্থ্যের পরিচয় দিয়ে মাত্র দশ বছর বয়সেই পিএসজির অনুর্ধ্ব-১৪ দলে জায়গা পেয়ে যান। এরপর অবশ্য ধীরে ধীরে মূল দলে জায়গা পাওয়াটাও নির্ধারিত করে ফেলেন। ২০১৩ সালে মাত্র সাড়ে ষোল বছর বয়সে যখন পিএসজির হয়ে প্রথমবারের মতো মাঠে নামছেন, তখন কোম্যান অভিষেক বিবেচনায় পিএসজির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে নাম লেখান।

কিন্তু এতো প্রতিভাবান হয়েও পিএসজির নয়া সংস্কৃতিতে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেলেন না, খেললেন মাত্র তিন ম্যাচ। ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে পিএসজি তখন কাড়ি কাড়ি অর্থে অভিজ্ঞ তারকাদের ভেড়ানোর স্বপ্নে বিভোর, অনেকাংশে সফলও! 

কিংসলে কোম্যান: যখন পিএসজিতে ছিলেন

তবে ঘরের ছেলে কোম্যান বড় ধাক্কাটা খেলেন যখন পিএসজি কতৃপক্ষ নতুনভাবে কোনো চুক্তি করার বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধও দেখালো না। অগত্যা মাত্র এক বছর পরেই চুক্তির মেয়াদ শেষে, ফ্রি ট্রান্সফারে পাঁচ বছরের জন্য যোগ দেন জুভেন্টাসে। সেখানে এক মৌসুম খেলেন, পনেরো ম্যাচে কোনো গোল ছিল না। ২০১৫ সালে জীবনে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল খেলতে নেমেছিলেন, তাও শেষ মিনিটে প্যাট্রিক এভ্রার বদলি হিসেবে। স্বভাবতই কিছু করতে পারেননি, জুভেন্টাসও হেরে যায় বার্সেলোনার কাছে।

পরবর্তীতে মৌসুমে, লোন ট্রান্সফারে যোগ দেন বায়ার্ন মিউনিখে৷ প্রতিভার বিচারে এগিয়ে থেকেও, সামগ্রিকভাবে থিতু হতে পারছিলেন না কোথাও! ধারাবাহিকতার অভাব তখন নিত্যসঙ্গী হিসেবে কালো ছায়া হয়ে আছে। বায়ার্ন মিউনিখ অবশ্য বেশ সুযোগ দিলো। দুই মৌসুমের প্রায় অর্ধশতাধিক ম্যাচ খেললেন, বেশ কিছু গোলের দেখাও পেলেন। কিন্তু ইঞ্জুরি মাঝে বড় বাঁধ সাধলো। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে, ক্লাব তাকে ছেড়ে দিতে পারে এমন ভীতিকর আত্মউপলব্ধি আসলেও দিনশেষে এমন কিছুই হয়নি। বরং ২০১৭ সালে তিন বছরের পার্মানেন্ট ডিলেই, বায়ার্ন ভিড়িয়ে নিলো কোম্যানকে। তাছাড়া বায়ার্নের চমৎকার পরিবেশের কারণে ডিলটা হওয়ার প্রতি তার ব্যক্তিগত আগ্রহও ছিল প্রবল।

১৭-১৮ মৌসুম নতুন উদ্দীপনায় শুরু করলেন, চমৎকার খেলতে থাকেন। ধারাবাহিকতাও তৈরি হয়। কিন্তু অর্ধ মৌসুম পরে ইঞ্জুরি নতুন আপদ হিসেবে এলে বাকিটা সময় সেভাবে আর খেলতে পারলেন না। সেবার প্রায় তিন মাস মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি। এরপর বাকিটা অবশ্য শুধু এগিয়ে যাওয়ার এবং নিজের মেলে ধরার গল্প। 

গতকাল রাতে চ্যাম্পিয়ন লীগের মহা-ফাইনালে কোম্যান প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়ে মাঠে নেমেছিলেন শৈশবের ক্লাব পিএসজির বিরুদ্ধেই! পেরিসিচকে বসিয়ে বায়ার্ন বস ফ্লিক যেন কোম্যানকে ম্যাচের সূচনালগ্ন থেকে নিজের অপ্রত্যাশিত তুরুপের তাসই বানাতে চাইলেন। আর ফ্লিক সেই পরিকল্পনায় শুরু থেকেই সফল। কোম্যানের পায়ে যতবারই বল গিয়েছে, সর্বাত্মক ত্রাস তৈরির চেষ্টা করেছেন পিএসজির সীমানায়। একের পর চমৎকার ড্রিবলিং এ পর্যদুস্ত পিএসজির ডানদিক, শারীরিক সক্ষমতায় তাল মেলাতে না পেরে হিমশিম খেতে হয়েছে পিএসজির রাইট ব্যাক কিংবা হোল্ডিং মিডফিল্ডারকে। বায়ার্নের বাকিরা যতটা অগোছালো ছিলেন, কোম্যান ছিলেন ঠিক ততটাই তৎপর, গোছানো ও সাবলীল।

ফাইনালে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে কোম্যানের গোলটাই

অবশেষে কিমিচের রক্ষণচেরা ক্রসে বলটা যখন কোম্যানের হেডে কেইলর নাভাসকে পরাস্ত করে জালে ঢুকে পড়লো, তখন কোম্যানের উন্মাদনায় ভরপুর উল্লাসে স্পষ্ট হয়ে উঠলো বছর সাতেক আগের প্যারিসের দেয়া যাবতীয় সব প্রতীক্ষার জবাব! দ্বিতীয় গোলের দেখাও প্রায় পেয়ে গিয়েছিলেন খানিক সময় পর। সেবার ব্যর্থ হলেও ম্যাচে আর ফেরা হয়নি পিএসজির। মাত্র এক গোলের ব্যবধানেই বায়ার্নের ইউরোপিয়ান 'মিশন হেক্সা'র সফল পরিণতি। ইউরোপিয়ান ফাইনালের ম্যান অব দ্যা ম্যাচ ফ্রেঞ্চম্যান কিংসলে কোম্যান। ম্যাচ শেষে সতীর্থদের ভীড়ে তিনি তখন লিসবনের মহানায়ক হয়ে উঠেছেন৷ হয়ে উঠেছেন বায়ার্নের ফুটবল ইতিহাসের এক কীর্তিমান!

পুরো প্যারিস শহরটাই বোধহয় তখন খানিকটা নির্লিপ্ত, নির্বিকার হয়ে উঠেছিলো। কে'ইবা জানতো এই শহরের কোনো ছেলেই তাদের জন্য 'দুঃস্বপ্নের উপখ্যান' রচনা করবেন। কেইবা জানতো বাম ফ্ল্যাংকে আজ ঘরের ছেলের তোলা তান্ডবেই ক্লাব প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে, প্রথমবারের মতো ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট প্রাপ্তির স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে পিএসজির! 

পেট্রোডলারের নবযুগে পিএসজি ইউরোপের নতুন জায়ান্ট হলেও, মাঠের লড়াই যে কেবল টাকার হিসেবে হয় না তাতো অবধারিত সত্য। আশা করি, কোম্যানের জবাব আগামীতে পিএসজির একাডেমী ও ট্রান্সফার পলিসির জন্য নতুন পাঠ হয়েই থাকবে।

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা