সদ্য-পিতা-হারানো একজন পুত্রকে পিতৃবিয়োগের পরদিনই হাটে পাঠিয়ে গরু-ছাগল, চাল-ডাল-মাল কিনতে পাঠানোর মতো নির্মমতা প্রদর্শন বোধহয় কেবল এই উপমহাদেশের মুসলিমদের পক্ষেই সম্ভব।
কারো মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে তার নামে কুলখানি খাওয়ানোর একটা বর্বর রেওয়াজ এই উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত আছে। এর পেছনে হাদিস-কোরানসিদ্ধ কোনো ভিত্তি আছে বলে খোঁজ পাইনি। ইউটিউব খুঁজে দেখেছি বেশ কয়েকজন মওলানাও এই কুলখানিপ্রথার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, এ ধরনের আয়োজনকে নিরুৎসাহিত করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিহতও করতে বলেছেন।
কুলখানির কোনো ধর্মীয় ভিত্তি আছে কি না, তা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব হলেও এর বিপক্ষে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান সুস্পষ্ট। একজন ব্যক্তির মৃত্যু তার স্বজনদের জন্য অবিসংবাদিতভাবেই অপূরণীয় এক ক্ষতি। পিতৃবিয়োগ বা মাতৃবিয়োগ-পরবর্তী অব্যবহিত কয়েকটি দিন সন্তানের কেমন কাটে, কষ্টের কারবালা কীভাবে আপাদমস্তক রক্তাক্ত করে, বেদনার বিদ্যুৎপ্রবাহ কীভাবে চোখদেরকে স্পৃষ্ট করে, মস্তিষ্ক কীভাবে কতটা অসাড় হয়, শরীরের অঙ্গেরা কতটা অঙ্গার হয়, সশব্দ চিৎকারেরা নিঃশব্দে মিলিয়ে গেলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হয়; এ কেবল তারাই জানেন, যাদের বাবা বা মা মারা গিয়েছেন।
এমন ট্রাজেডির পর সন্তানের ফোলা চোখ স্বাভাবিক হতেই যেখানে দেড়-দুই সপ্তাহ কেটে যায়, ক্ষুধামন্দা সারতেই যেখানে অন্তত একমাস লেগে যায়, অনির্দিষ্ট কালজুড়ে যেখানে চোখজুড়ে সেঁটে থাকে কাঁচা কবরের ছবি; সেখানে মৃত্যুর বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই হাজার-হাজার লোক ডেকে খাওয়ানো, খাওয়ানোর যাবতীয় বন্দোবস্ত করা— এ যেন মৃতের সন্তানদের ওপর সামাজিক নির্যাতনের অসামাজিক স্টিম রোলার। সদ্য-পিতা-হারানো একজন পুত্রকে পিতৃবিয়োগের পরদিনই হাটে পাঠিয়ে গরু-ছাগল, চাল-ডাল-মাল কিনতে পাঠানোর মতো নির্মমতা প্রদর্শন বোধহয় কেবল এই উপমহাদেশের মুসলিমদের পক্ষেই সম্ভব।
কুলখানিতে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করা হবে, কী কী খাওয়ানো হবে, ডালে লবণ কতটা দেওয়া হবে, কাকে কই বসানো হবে, কে কাকে চিবিয়ে খাইয়ে দেবে; সদ্য-পিতৃহারা সন্তানটিকে ইত্যাকার সবকিছু সামলেও শেষতক শুনতে হয় সেই চিরাচরিত বাক্য— গোশতের টুকরোগুলো একটু ছোট হয়েছে, ডালটাও আরেকটু ঘন হলে খেতে ভালো লাগত, ফিরনিতে চিনি বেশি হয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জের ধূর্ত, রুক্ষ, বিবেকবর্জিত লোকজনের একাংশ এভাবেই কুলখানির খাবারেও ত্রুটি খুঁজে বের করবেই। বিয়ে, খতনা, আকিকার সাথে কুলখানির কোনো তফাৎ এদের কাছে নেই। অন্য আয়োজনগুলোর মতো কুলখানিও এদের কাছে নিছকই এক আনন্দ উৎসব।
গ্রাম্য লোকজনের একাংশ যেন অপেক্ষায়ই থাকে মানুষের মৃত্যুর জন্য। মৃত্যু হলেই কুলখানি হবে, কুলখানিতে মাংস-মিশ্রিত ডাল খাওয়া যাবে, খাওয়ার পরে তোলা যাবে তৃপ্তির ঢেঁকুর। যে হাজার-হাজার ব্যক্তি কুলখানিতে খেতে আসে, তাদের কেউই মরহুমের মৃত্যুতে শোকার্ত না; তারা নিছকই ক্ষুধার্ত। শোকার্ত কেবল ঐ কজন, পিতৃবিয়োগের পর চোখ মোছারও সময় না পেয়ে যাদেরকে নেমে পড়তে হয় মৃত্যুউৎসবে যোগ দিতে আসা অনাহূত অবিবেচকদের রসনা-রঞ্জনে।
কুলখানিতে কারা কত হাজার মানুষকে খাওয়াতে পারে, এমনও একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা যুগ-যুগ ধরে উপমহাদেশীয় মুসলিমদের মধ্যে লক্ষণীয়। প্রয়াত ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকাকালে কারো টিকিটিরও দেখা পাওয়া না গেলেও, চিকিৎসায় কারো সহযোগিতা না পাওয়া গেলেও কুলখানিতে নিমন্ত্রণ না পেলে 'অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা' গোত্রের স্বজনরা গোস্বা করে থাকেন এবং এই গোস্বাতাণ্ডবের যাবতীয় চাপ এসে পিষে দিয়ে যায় সদ্য এতিম হওয়া সন্তানদেরকে।
এমন না যে, কেউ ভাতের অভাবে কুলখানি খেতে আসেন; কিন্তু কুলখানিতে নিমন্ত্রণ পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে সৃষ্ট বিবাদের রেষ বয়ে বেড়াতে হয় বছরের পর বছর। শুনেছি গ্রামাঞ্চলে ইদানীং কোনো ভিখিরি মারা গেলে তার নামেও নাকি পাঁচ-সাতশো লোককে খাওয়ানো হয়। আজকাল ভিখিরির সন্তানরাও এত বড় আয়োজনের আর্থিক সক্ষমতা রাখেন। চৌদ্দ মাস আগে বাবাকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার পর যখন ওপরে বাঁশের পাটাতন বসানো হলো, বিলাপরত মা তখন লোক পাঠিয়ে আমাকে ডেকেছিলেন আমার হাতে তিন টুকরো মাটি তুলে দেওয়ার জন্যে— এক টুকরো তার নিজের তরফ থেকে, দু-টুকরো আমার দু-বোনের তরফ থেকে।
টুকরো তিনটি নিয়ে যখন আমি কবরের অভিমুখে জনমের তরে এগোচ্ছিলাম, পা দুটো যখন প্রাচীন রেইন ট্রি চেয়েও ভারী মনে হচ্ছিল, পরানের গহিন ভেতরটা যখন নিঃশব্দে পুড়ে ছাই হচ্ছিল; তখন আমারই আপন এক চাচি পেছন থেকে ডাকলেন, বললেন জানাজায় আসা মুসল্লিদেরকে কুলখানির তারিখ জানিয়ে আসতে, কুলখানির তারিখ তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেওয়াই নাকি নিয়ম। ক্রোধ চেপে সবিনয় অভিনয়ে চাচিকে বলেছিলাম মাটি তিন টুকরো কবরে ফেলার সময়টুকু যেন তারা আমাকে দেন, চাচি তবু আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েই ছিলেন। এমন না যে, চাচি আমার অমঙ্গল চেয়েছেন; তিনি বরং গ্রামে প্রচলিত নিয়ম মনে করিয়ে দিয়ে আমার উপকারই করতে চেয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর সময় মা ছিলেন হাসপাতাল-বন্দি। তার ভাঙা পা নিয়ে আমাদেরকে রওয়ানা দিতে হয়েছিল ঢাকা থেকে তিনশো ত্রিশ কিলোমিটার দূরবর্তী বরগুনায়। মধ্য জানুয়ারির তীব্র কুয়াশা আর ফরিদপুরের ডাকাতদের তাণ্ডবের সাথে পথিমধ্যে যুক্ত হয়েছিল ঝালকাঠিতে সংঘটিত অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনা। বাবার লাশবাহী গাড়িটি খালে পড়ে না গিয়ে গাছে বাড়ি লাগলে সেদিন আরো পাঁচ-সাতটি লাশ বইতে হতো আমাকে।
সমস্ত কিছু সামলে, পিতাকে কবরস্থ করে বিকেলের দিকে এক চাচার ঘরে যখন ক্ষণিকের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; তখন শুনতে পেয়েছি চাচাতো ভাইদের বৈঠকের চাপা আওয়াজ— আজাদ যদি না খাওয়ায়, আমরা চাঁদা তুলে চাচার নামে খাওয়াব! তখন আমি আর ঘুমোতে পারিনি, সংবরণ করতে পারিনি আমার ক্রোধের শিখা; মুহূর্তে ফেটে পড়েছিলাম বেদম বিক্ষোভে। আমি জানি— আমার চাচাতো ভাইয়েরা বা চাচি আমার সামাজিক সম্মান রক্ষার জন্যই আমাকে দিয়ে যথাদ্রুত কুলখানির ঘোষণা দেওয়াতে চেয়েছিলেন। তবু আমি তাদের ওপর চড়াও হয়েছিলাম। আমার বাবা প্রয়াত হয়েছেন এখন থেকে চৌদ্দমাস আগে।
এই চৌদ্দমাস আমি কুলখানি ঠেকিয়ে রাখলেও শেষতক আর পারিনি, সম্প্রতি বেশ বড় পরিসরে গ্রামে কুলখানির আয়োজন করেছেন আমার বোনেরা। হাজারখানেক মানুষ এসে গোশত-ডাল খেয়ে গেছেন, গরুর হাড় চিবিয়ে অবশেষে তাদের হাড় জুড়িয়েছে। কিন্তু জানি না ঐ এক হাজার ব্যক্তির মধ্যে কজন আমার বাবার কবরটা জিয়ারত করে গেছেন।
লেখক - আখতারুজ্জামান আজাদ ( কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক)