প্রতি বছর পশুর হাটকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক আমেজ লক্ষ করা যায়, যা আমাদের সংস্কৃতিতেই রুপান্তর হয়েছে। কিন্তু এবার করোনা প্রকোপের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
একদিকে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা আগতপ্রায়, অন্যদিকে গত ছয় মাস ধরে পৃথিবীজুড়ে বিস্তার করা কোভিড উনিশের প্রকোপ কমার কোনো নাম-গন্ধ নেই। অর্থাৎ, করোনাকালীন অন্যান্য উৎসবগুলোর মতো কোরবানি ঈদও ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পালিত হবে।
কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবার বর্জ্যব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক কিছু প্রশ্ন থাকে; এবার তার পাশাপাশি পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারটাও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশুর হাটের নানা ঝক্কি-ঝামেলা যারা পোহাতে চান না, তারা গত কয়েকবছর ধরে ভার্চুয়াল পশুর হাটগুলোর দিকে ঝুঁকছেন৷ গত কয়েকবছরের চিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অনলাইন হাটগুলো হতে পশু কেনা-বেচার গ্রাফ ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী। তাই সার্বিক বিবেচনা করে ও করোনার সংক্রমণ যাতে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে না যায়, তার প্রয়োজনে ভার্চুয়াল হাটগুলোর দিকে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। আশার কথা হলো, বিভিন্ন ই-কর্মাস সাইটের উদ্যোক্তাবর্গ এ বিষয়ে ইতিবাচক কথাবার্তা শোনাচ্ছেন; পাশাপাশি দেশের খামারি ও বিভিন্ন ক্রেতা-বিক্রেতার আগ্রহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পারছি।
দেশে করোনা সংক্রমণের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে পশুর হাট বসানোটা খুবই চ্যালেঞ্জ হবে। পশুর হাটগুলোকে কেন্দ্র করে বিপুল যে কর্মযজ্ঞ দেখা যায় প্রতিবছর, তা থেকে সহজে করোনা সংক্রমণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনলাইন হাটের কিছুটা প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। ভার্চুয়াল মার্কেটগুলোতে যাতে কোনো রকমের অসাধুতা বা নিরাপত্তহীনতা না থাকে, সে-বিষয়গুলো প্রশাসনকে তদাকরি করতে হবে। এত সমস্যার মধ্যেও অবশ্য অনলাইন হাট বড় বিকল্প সন্দেহ নেই, তবে গ্রাম পর্যায়ে অনলাইন কেনাবেচায় প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার মাত্রাটা একটু বেশি। এক্ষেত্রে গ্রাম পর্যায়ের হাটগুলোর দিকে সরকারের সুদৃষ্টি রাখার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ নির্দেশনা আসা প্রয়োজন। পাশাপাশি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে যেমন কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে, একইভাবে গ্রাম পর্যায়ের সমাজ সচেতন ব্যক্তিবর্গকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে এ-ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে।
কোরবানি ঈদ পরবর্তী সময়ে বড় সমস্যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলোর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, একইভাবে সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কিছু কর্তব্যও রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রস্তুতির কথা বলতে গিয়ে নাগরিকদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তা দিতে কন্ট্রোল রুম নম্বর চালু করার কথা জানিয়েছেন। ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনগুলো এ-ব্যাপারে ভাবতে পারেন।
পশু জবাইয়ের পর নিজ নিজ বিল্ডিং বা বাড়ির সামনে বর্জ্য জমিয়ে রাখার দৃশ্যটা প্রতিবছরের খুব সাধারণ দৃশ্য। এসব বর্জ্য পচে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু ছড়ায় ও মশা-মাছির প্রজননকেন্দ্রে রূপ নেয়। নিজেদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে এসব বর্জ্য নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করা আবশ্যক। সর্বোত্তম হয় যদি সোসাইটি বা মহল্লাভিত্তিক সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে সে-জায়গায় যাবতীয় কার্য সম্পাদন করা যায়। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে মসজিদের ঈমাম বা সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। এটা সম্ভব না হলে কয়েকটি বিল্ডিং বা বাড়ি মিলে এ ধরণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে বর্জ্যসমূহ কর্তৃপক্ষ একটি নির্দিষ্ট স্থান হতে সহজে সংগ্রহ করতে পারবে, ফলে সম্পূর্ণ নগরী পরিষ্কার করতে কম বিলম্ব হবে।
নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি করার বড় সুবিধা হলো, জবাইকৃত পশুর রক্ত ব্লিচিং পাউডার বা অন্যান্য জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে সহজ হবে। সম্মিলিত এসব উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব না হলে ব্যক্তিগতভাবে হলেও স্ব-স্ব পশু কোরবানির স্থলের রক্ত জীবাণুনাশক ছিটিয়ে অবশ্যই পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া বর্জ্যসমূহ যত্রতত্র জমিয়ে না রেখে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে।
কোরবানির ঈদ দেশের অর্থনীতির জন্যও আশীর্বাদ হতে পারে। কোরবান ঈদে যে পরিমাণ গরুর নাড়িভুঁড়ি বা ওমাসম ড্রেনে-খালে ফেলা হয়, তা দিয়ে অনায়াসে চীন, হংকং, ভিয়েতনামসহ বহির্বিশ্বে ওমাসমের বাজার ধরা যাবে বলে দেশের ব্যবসায়ী মনে করছেন। গরুর নাড়িভুঁড়ি প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে প্রতি ১ টন হতে ৭০০ কেজি ওমাসম পাওয়া যায় বলেও তারা জানাচ্ছেন।
সরকারিভাবে ভালো কোনো উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের এ সুযোগটা সৃষ্টি করে দিলে একইসাথে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে, পরিবেশদূষণও রোধ করা যাবে। এছাড়া অন্যান্য বর্জ্য রিসাইক্লিং-এর মাধ্যমে মৎস্য খাদ্য হিসাবে রূপ দেওয়া সম্ভব। দেশের চামড়া শিল্প বিপন্ন প্রায়। গত কয়েকবছরের মতো এবারও যাতে চামড়া শিল্প সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অশুভে কবলে পড়ে না যায়, সে-বিষয়ে সরকারকে যথেষ্ট সজাগ হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। করোনাকালীন এ দুঃসময়ে চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে এবং হতদরিদ্র মানুষরা এতে করে কিছুটা হলেও উপকৃত হবে।
কোরবানি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলার জন্য যদি মানুষের কষ্ট হয়, তাহলে কোরবানির বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠতে পারে। তাই মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের উচিত, কোরবানি পরবর্তী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ জোর দেওয়া। পাশাপাশি সম্ভব হলে অনলাইন পশুর হাট থেকে পশু কেনা এবং তা সম্ভব না হলে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুর হাটে যেতে হবে।
প্রতিবার পশুর হাটকে কেন্দ্র করে দর্শনার্থীদের ইতিবাচক আমেজ লক্ষ্য করা যায়, যা সন্দেহাতীত আমাদের সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। তবে সময়ের প্রয়োজনে এবার এটিকে রুদ্ধ করতে হবে। অপ্রয়োজনে কোনোভাবেই পশুর হাট বা ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় উৎসবগুলো যথাযথভাবে পালন যেমন আবশ্যক, সকল প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ করে আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাও সমান আবশ্যক।
-
* প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে