আপনারা যখন বলছেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা নারীর সঙ্গে অসভ্যতা করে না- তখন যে সেই বক্তব্যটা ছাত্রলীগে ঘাপটি মেরে থাকা ধর্ষক, পটেনশিয়াল রেপিস্ট এবং নারী নিপীড়কদের হয়ে সাফাই হিসেবে কাজ করছে, সেটা কি বুঝতে পারছেন?

গতকাল টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদী সভা করেছে ছাত্রলীগ। সেখানে সিলেটের এমসি কলেজের গণধর্ষণকাণ্ড, খাগড়াছড়ির আদিবাসী নারীর ওপর চালানো যৌন নিপীড়ন এবং ঢাবি ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করা হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠনটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, শীর্ষ নেতারা রাস্তায় নেমে ধর্ষণের বিচার চাইছেন- এরচেয়ে চমৎকার ঘটনা আর কি হতে পারে? 

কিন্ত চোখ আটকে গেল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং আরও দুয়েকজন শীর্ষ নেতার বক্তব্যের চুম্বক অংশে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছেন, "বাংলাদেশের নারী সমাজ, কোনো নারী শিক্ষার্থী বা কোনো নারী সহযোদ্ধার প্রতি কটাক্ষ করা কিংবা খারাপ চোখে তাকানোর মতো কোনো কর্মী ছাত্রলীগে নেই।" একটা অনলাইন পোর্টালে তার এই বক্তব্যটা দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি, পরে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও একই বক্তব্য দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। এবং মনে হয়েছে, ২০২০ সালে এর চেয়ে হাস্যকর কোন বক্তব্য সম্ভবত আসেনি। 

লেখক ভট্টাচার্য, আপনি বাংলাদেশের প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। আপনার এক পূর্বসূরি এক নেতা প্রশ্নফাঁসের মহামারীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে লাইভ টেলিভিশনে দাবী করেছিলেন বাংলাদেশের কোথাও নাকি প্রশ্নফাঁসের কোন ঘটনাই ঘটেনি! স্বয়ং উপস্থাপিকাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন সেই কথা শুনে। আপনার মুখে ছাত্রলীগ নারীদের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকায় না শুনে আমাদের অবস্থাও সেই উপস্থাপিকার মতোই হয়েছে। 

সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযুক্তরা যে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত- এটা তো চাইলেও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাহলে কেন সেই পথে হাঁটার বৃথা চেষ্টা? কেন নিজেকে হাসির পাত্রে পরিণত করা? পলিটিক্যালি ক্যারেক্ট থাকাটাই কি সবকিছু? ছাত্রলীগ আর ধর্ষণ- এই দুটো শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে একবার গুগলে সার্চ করে দেখুন, হাজার হাজার রেজাল্ট বেরিয়ে আসবে। তবুও আপনি কিভাবে দাবী করেন যে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নারী নিপীড়ন বা যৌন হেনস্থার সঙ্গে জড়িত নয়? এই বক্তব্যের ভিত্তি কি?

লেখক ভট্টাচার্য, আপনারা একটা টালমাটাল সময়ে ছাত্রলীগের দায়িত্ব পেয়েছেন, দল সামলানোর পাশাপাশি পূর্বসূরিদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা দায়ও আছে আপনাদের কাঁধে। একটা জিনিস মনে রাখবেন, সমস্যা সমাধানের প্রধান শর্ত হচ্ছে সমস্যাটার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া, তারপর সেটা নির্মূলে কোমর বেঁধে মাঠে নামা। ফলাফল কি আসে পরের ব্যাপার, রোগ নির্মূলের চেষ্টা তো করতে হবে। 

অথচ আপনি স্বীকারই করতে চাইছেন না যে ছাত্রলীগে খারাপ কিছুর অস্তিত্ব আছে, তাহলে সেটার সমাধান হবে কি করে? ছাত্রলীগ তো কোন ফেরেশতা বা পীর আউলিয়ার দল না, এখানে ভালো-মন্দ দুটোই আছে, বরং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় সুবিধাভোগীরা এসে ভিড় জমিয়েছে। সেটা স্বীকারের সৎ সাহস রাখুন, পরিবর্তন আনুন। আগাছা ছেঁটে ফেলে দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের জায়গা দিন। আগের নেতারা যে গৎবাঁধা পথে হেঁটেছে, আপনাকেও কেন সেই একই পথে হাঁটতে হবে? 

ক্ষমতার দম্ভে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই অন্ধ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। ধর্ষণের কথা বাদই দিলাম, সেটা আইন-আদালতের বিচারাধীন বিষয়। ছাত্রলীগের ব্যানারে মিছিল-মিটিংয়ে যাবার পথে চলন্ত ট্রাক থেকে নারীদের সাথে অশালীন আচরণ করা হয়েছে, তাদের গায়ে বোতল থেকে পানি ছুঁড়ে মারা হয়েছে, পোশাক নিয়ে কটু মন্তব্য করা হয়েছে- কখনও এসব অভিযোগের তদন্ত করেছেন আপনারা? ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেছেন? আজ যে হুট করে আপনি বলছেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা নারীর সঙ্গে অসভ্যতা করে না- তখন যে সেই বক্তব্যটা এসব ধর্ষক, পটেনশিয়াল রেপিস্ট এবং নারী নিপীড়কদের হয়ে সাফাই হিসেবে কাজ করছে, সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন?

প্রতিবার ছাত্রলীগের কর্মীরা একেকটা অপকর্মের সঙ্গে জড়ায়, আর আপনারা ব্লেম গেম খেলেন, বহিষ্কার করে দায় সারেন, কার পরিবারে বিএনপি আছে জামায়াত আছে সেটা বের করে তাকে অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে দেন। অনুপ্রবেশকারীকে দলের কমিটিতে জায়গা দেয়ার সময় সতর্ক থাকা যেতো না? প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর- এই আপ্তবাক্যটা কেন আপনারা ভুলে যান বারবার? 

একটা সময়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা ছাত্রলীগের রাজনীতি করতো, এখন কারা করে? পঁচে যাওয়া বখাটে আর চরিত্রহীন লোকজন, যারা পাওয়ার প্র‍্যাকটিস করতে পারে, যারা জীবনে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী উল্টেও দেখেনি, কিন্ত মারামারি কিংবা ইভ টিজিংয়ের একাধিক অভিযোগ আছে নামের পাশে। যে ছেলেটা বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানে না, তার জেল খাটার গল্প জানে না, জানে শুধু বাইক নিয়ে অমুক-তমুক ভাইয়ের হয়ে শোডাউন করতে, মিছিলে-সমাবেশে যাওয়ার পথে ট্রাকের ওপর থেকে মেয়েদের গায়ে পানি ছুঁড়ে মারতে- তার কাছে আপনি সমাজ বা দেশ বদলে দেয়ার মতো কিছু তো আশা করতে পারেন না।

একই সমাবেশে সভাপতিত্ব করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেছেন, 'জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যান, তখনই ধর্ষণের মেগা সিরিয়াল দেখা যায়। আমি হতবাক- পরপর কীভাবে ধর্ষণগুলো ঘটে?' এই প্রশ্নটা ছাত্রলীগের উচিত নিজেদের কাছেই করা। ছাত্রলীগকে অন্য কেউ বিতর্কিত করছে না, ছাত্রলীগের দাম্ভিক নেতাকর্মীরাই যথেষ্ট এই দলটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার জন্য। ইতিমধ্যেই অনেকটুকু কাজ সম্পন্নও হয়ে গেছে। নেতাকর্মীরা যখন দলের আদর্শ, জাতির পিতার আদর্শ ভুলে 'ভাইতত্ত্বে' মগ্ন হয়, তার ফলাফল তো এরকমই হওয়ার কথা। 

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানটা মুখস্ত বুলির মতো আউড়ে যেতে পারা আর তেলের বোতল উপুড় করে দেয়াটাই যদি ছাত্রলীগের কর্মীদের যোগ্যতা হয়ে থাকে, তাহলে এই দুর্দিন তো আসার কথাই ছিল! ক্ষমতার নেশায় এরা অন্ধ হবে না তো কে হবে? ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যদি এদের হয়ে সাফাই না গেয়ে বরং দলের মধ্যে থাকা এমন পটেনশিয়াল রেপিস্টদের খুঁজে বের করতে পারেন, সেটাই বরং ছাত্রলীগের জন্য মঙ্গলজনক, দেশের জন্য মঙ্গলজনক। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা