“লাইফ ইজ বিউটিফুল” এ বাক্যটা মিথ্যা। প্রচণ্ড রকমের মিথ্যা। বলা যেতে পারে, আমার লাইফ বিউটিফুল/তোমার লাইফ বিউটিফুল। মোটা দাগে “লাইফ ইজ বিউটিফুল” বলা আসলে ভুলও না, অমোচনীয় পাপ। আমার জীবন দিয়ে সবার জীবন নির্ণয় করা কি আসলেই সম্ভব? উচিতও?
শুভ সরকার: গত ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার সময়ে ঢাকা গিয়েছিলাম। রাতের দিকে হাকিম চত্বরে গেলাম। দেখলাম, মালপোয়া টাইপের কিছু একটা ভাজা হচ্ছে। আমি আর আমার এক বন্ধু নিলাম দুটি করে সেগুলো। খেতে গিয়ে দেখলাম, ভালো লাগে না। অল্প খাওয়া জিনিসটা ফেলে দিলাম ওয়েস্ট বাস্কেটে। পর মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম, চিলের মত ছোঁ মেরে কে যেন ঐ খাবারটা নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে। একটু খেয়াল করে দেখলাম, এক কোণে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্ক এক মহিলা খুব আগ্রহ করে খাবারটা খাচ্ছে।
ঢাকার বাসার গলি থেকে রাস্তায় নামলেই রাস্তার পাশে বড় একটা ডাস্টবিন পড়তো। প্রতি বিকেলে কোচিং থেকে ফিরলেই সেখানে দেখতাম, এক মা তার ছোট ছেলেকে নিয়ে সেখানে খাবার খুঁজছে। প্রতি বিকেলে এ অভিযান চলতো, এক বিকেলেও এ দৃশ্যের পরিবর্তন হয়নি। শেষ বিকেলের চুরি যাওয়া আলোতে এ দৃশ্য দেখেছি নিয়মিত। মাঝে মাঝে শীতের সকালগুলোতে শরীরে তিন-চার স্তর পোশাক জড়িয়ে বাবার সাথে হাঁটতে নামতাম রাস্তায়। ফুটপাথে দেখেছি, চালের বস্তার মধ্যে শরীরকে কোনোরকমে সেঁধিয়ে ঘুমিয়ে আছে অল্প/মধ্য/বেশি বয়স্ক মানুষ। অবাক হতাম, প্রশ্নও আসতো মাথায়। উত্তরগুলো এখন জানি।
একবার বেদেপল্লীতে গিয়েছিলাম। নৌকায় তাদের জীবনযাপন দেখেছিলাম। একটুখানি ছোট একটা নৌকায় রান্নাবান্না, সেখানেই খাওয়া, সেখানেই ঘুম। নৌকার গলুই, নৌকার মাস্তুল সবখানেই টানাপোড়েনের জীবনের নির্মম ছাপ। নৌকা ভাসে, ভেসে চলে পরিবার, জলের দেহে শরীর ছুঁইয়ে ভেসে যায় জীবনও।
একবার বাবার ওপরে খুব রাগ হয়েছিলাম। বাজার থেকে বালিশের কাভার এনেছে, সে কাভার আমার পছন্দ হয়নি। আমি স্পাইডারম্যানের কাভার চেয়েছিলাম। এর কয়দিন পরেই কোনো কাজে শাহবাগ থেকে ফিরছিলাম। রাত হয়ে গেছে অনেক। দেখলাম লাল ইট দুই-তিনটা জড়ো করে মাথার নীচে দিয়ে একটা বেতের ঝুড়ির মধ্যে শরীর ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে আছে জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত হেরে যাওয়া একেকটা মুখ। ব্যাটম্যানের মুখ আমার সামনে থেকে উবে গিয়ে সেখানে একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করেছিলো।
আমি স্ট্যাটাস লিখছি এখন ঘরে বসে। মাথার ওপরে ফ্যান আছে, হাতে চ্যাপ্টা স্মার্টফোন। খাবারের অভাব নেই, রাতে ঘুমানোর জন্যে খাট আছে, মাথার নীচে নরম বালিশ আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্যে মেগাবাইট আছে। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনটা হয়তো সুন্দর, লাইফটা হয়তো বিউটিফুল। কিন্তু, হাকিম চত্বরের মোড়ে এখনও হয়তো কেউ দাঁড়িয়ে আছে ডাস্টবিনের ওপরে শ্যেনদৃষ্টি মেলে। কেউ কিছু না খেয়ে ফেলে দেয়ার ওপরেই যার আজকের খাওয়া নির্ভর করছে। যার প্রতিদিনই কাটে অনেকগুলো যদি, কিন্তু'র ওপরে নির্ভর করে। যার জীবনজুড়ে জটিল সমীকরণ, সাপলুডুর সাপের মুখে যার জীবন প্রতিনিয়তই বিব্রত।
তাই, নিজেদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আমরা হতেই পারি, হওয়া উচিতও। কিন্তু, "লাইফ ইজ বিউটিফুল" এ বাক্যটা মোটা দাগে না ফেলাই হয়তো ভালো। জীবন বিউটিফুল কিনা, সেটা স্তরে স্তরে নির্ভর করে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ওপরে নির্ভর করে। সেটা চারপাশে একটু তাকালেই বোঝা যাবে। একজনের জন্যে হয়তো "লাইফ ইজ বিউটিফুল", অন্য কারো জন্যে সে জীবনই হয়তো "অভিশাপ" হয়ে যায়।
বিশ তলা বিল্ডিং এর ওপরে দাঁড়ালে নিচটা খুব সুন্দর লাগে। নিচে দাঁড়ালে নিচটা সুন্দর লাগে না। আপনি বিল্ডিংয়ের কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো তার ওপরেই নির্ভর করছে। যোগফলে ভুল হওয়া জীবনকে ইটের শক্ত বালিশের নিচে চেপে রেখে চোখ বোঁজা কোনো একজনের জীবনকে "বিউটিফুল" বলার ঔদ্ধত্য আমাকে কে দিয়েছে? কেউ কি দিয়েছে?