র‍্যাব গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দিয়েছিলো- শরীর থেকে একটা পা হারিয়েছেন, সেই ঘটনার পর জীবন থেকে চলে গেছে ৯টা বছর। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার পাশাপাশি চালিয়েছেন পড়ালেখা। যে আইনি জটিলতা তার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিলো, তিনি এখন সেই আইন বিভাগেরই শিক্ষক। মনে আছে আপনাদের তার কথা?

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) এর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানো সেই কিশোর লিমন হোসেনের কথা মনে আছে আপনাদের? সেই ঘটনায় পুরো জীবনটাই তছনছ হয়ে গিয়েছিলো লিমনের। শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার পাশপাশি ছিলো ভয়াবহ আইনি জটিলতা। আইনের মারপ্যাঁচে যার জীবন থমকে গিয়েছিলো, সেই আইন বিষয়েই এখন তিনি শিক্ষকতা করছেন। সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে লিমন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

২০১১ সালের ২৩ মার্চ বাড়ির পাশে মাঠে গরু আনতে গিয়েছিলেন লিমন হোসেন। সেটাই যেন তার গর্হিত অপরাধ ছিলো। মোরশেদ জমাদ্দার নামের এক সন্ত্রাসীকে ধরতে গিয়ে কিশোর লিমনের পায়ে গুলি করেন র‌্যাবের সদস্যরা। এরপর দুটি মামলায় লিমনকে আসামি করে র‌্যাব। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে। প্রায় ৪ বছর আইনি জটিলতায় ভোগার পর, গণমাধ্যমে এবং মানবাধিকার কর্মীদের সহায়তায় স্বাভাবিক জীবনের ফেরেন তিনি। শরীর থেকে হারিয়ে ফেলেন একটা পা, জীবন থেকে হারিয়ে যায় প্রায় চারটা বছর।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাত্র ১২ দিন আগে তার পায়ে গুলি করা হয়েছিলো। তখন লিমনের বয়স ছিল ১৬ বছর। সে বছর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তবে দমে যাননি দরিদ্র পরিবারের সন্তান মেধাবী লিমন। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই পড়াশোনা করে পরের বছর পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার কাঁঠালিয়া পিজিএস বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪ পান তিনি। এরপর ভর্তি হন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে।

লিমনকে নিয়ে করা প্রথম আলোর রিপোর্ট 

লিমনের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় নিয়ে ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় খবর প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি সারাদেশে আলোচিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তখন পা-হারা এই কিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দেশের বিবেকবান মানুষ ও মানবাধিকারকর্মীরা। লিমনের চিকিৎসাও হয় মানুষের আর্থিক সহযোগিতায়।  

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বাড়ি লিমনের। পড়ার খরচ চালাতে কিশোর বয়সেই ইটের ভাটায় কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে হয়েছিল তাকে। গুলিবিদ্ধ হবার পর লেখাপড়া আর কাজ দুটোই বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় জীবন। লিমনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয় ঢাকায়। এরপর তার জীবন বাঁচাতে গুলি লাগা বাম পা কেটে ফেলেন চিকিৎসকেরা।

সেই নির্দোষ ছেলেটা, যাকে তার রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারেনি উল্টো আইনি জটিলতায় ফেলে দিয়েছিলো। নিজের হারানো পা নিয়ে সেই জটিলতা থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই বেরিয়ে এসেছেন তিনি। চালিয়েছেন লেখাপড়া। অদম্য ইচ্ছেশক্তির জোরে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মাথা উঁচু করেই। খোদ রাষ্ট্রও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এই ছেলেটার বীরত্বগাঁধা হয়তো পাঠ্যবইয়ে ছাপানো হবে না, তাকে নিয়ে সিনেমাও বানানো হবে না। হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকেরই তার কথা মনেও নেই। তবুও কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া এই লিমন হোসেনেরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যাবেন- কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। সে লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।

 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা