নিজেকে নবীর উম্মত দাবী করে সাংসদ খোকা প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দেন কিভাবে? ইসলামে কি কোথাও এমন হত্যার অনুমতি দেয়া আছে? খোকা সাহেব কোন ইসলামের কথা বলছেন তাহলে? এই ইসলাম তো আইএসের বানানো ইসলাম, নবীজীর ইসলাম তো নয়...
বাংলাদেশ বড় অদ্ভুত দেশ। এদেশে যাদের আইন প্রণয়ন করার কথা, তারাই বারবার আইন ভাঙেন। আইনবিরোধী কথাবার্তা বলেন। ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার কথা শোনা গিয়েছিল এক সাংসদের মুখে। অথচ ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার ব্যাপারটাই আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একজন আইনপ্রণেতা হয়ে কেউ যখন বলে যে অপরাধীকে ক্রসফায়ারে দিতে হবে, তখন বোঝা যায় সেদেশে আইনের শাসনের কি বেহাল অবস্থা।
এবার আরও এক সাংসদ আলোচনায়। তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন, তাও আবার একদম প্রকাশ্যে, জনসভায় দাঁড়িয়ে, মাইক্রোফোনে বলেছেন এই কথা। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের জাতীয় পার্টির সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকা এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করতে চাওয়ার সেই বক্তব্য সংবলিত ভিডিও তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলেও আপলোড দিয়েছেন। একজন সংসদ সদস্য, একজন আইনপ্রণেতা যখন প্রকাশ্যে আরেকটা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার হুমকি দেন, সেটা যে কত বড় অভব্য এবং অসভ্য আচরণ- তা আমাদের মাননীয় সাংসদের সম্ভবত জানা নেই।
হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমির আহমদ শফির স্মরণে সোনারগাঁ পৌরসভার আমিনপুর মাঠে একটা আলোচনা সভা এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বক্তব্য দিতে গিয়েই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতি ঘৃণা উগরে দিয়েছেন খোকা। নাম খোকা হলেও তার কথাবার্তা মোটেও খোকাসুলভ ছিল না। মাইক্রোফোনে চেঁচিয়েই তিনি বললেন- ‘আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই, আজকে আমার প্রিয় নবী সম্বন্ধে যারা কটূক্তি করবে, ব্যঙ্গ করবে, আমি মুসলমান হিসেবে বলতে চাই, আমি কোনো সংসদ সদস্য না এখন, ওই ... বাচ্চা (গালি) ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীকে (প্রেসিডেন্ট) বলতে চাই, আজকে তুই যদি আমার সামনে থাকতি, আমি তোকে হত্যা করতাম। হত্যা করে আমি ফাঁসির মঞ্চে হাসতে হাসতে যেতাম।’
এখানেই ঘটনার শেষ নয়। বাড়িতে এসেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতি তার ক্ষোভ কমেনি। নিজের বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুকে আপলোড দিয়ে সাংসদ মহাশয় লিখেছেন- ‘আমি কোনো সংসদ সদস্য হিসেবে নয়, একজন মুসলমান হিসেবে বলছি ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেলে তার জীবন শেষ করে হাসি মুখে ফাঁসির মঞ্চে যেতেও রাজি।’
তার এই বক্তব্য ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। সংবাদমাধ্যমগুলো যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে, সেখানেও তিনি নিজের কথায় অটল থেকেছেন, বলেছেন- নবীর বাইরে কিছু নেই। আমার নবীর বিরুদ্ধে যে বলবে তার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? আগামী ৮ তারিখ সংসদ অধিবেশন। এই অধিবেশনেই ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করতে প্রস্তাব আনা হোক। আমি একজন মুসলমান, আমি নবীর উম্মত, যে আমার নবীকে কটূক্তি করে তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করব না। আমি যে বক্তব্য দিয়েছি, আমি সেই বক্তব্যে এখনও অনড় আছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি অনড় থাকব।
লিয়াকত হোসেন খোকা এক কথার মানুষ, এটা জেনে ভালো লাগলো। কিন্ত তিনি যেভাবে নিজের বক্তব্যে ভিনদেশের একজন রাষ্ট্রনায়ককে 'হত্যা' করতে চাইলেন, সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আইন-কানুনের ব্যাপারে পরে যাচ্ছি। তিনি যেহেতু নিজেকে বারবার নবীর উম্মত হিসেবে দাবী করেছেন, আমি সেই পয়েন্টটাতেই থাকতে চাই।
মহানবী তার পুরো জীবনে কম অত্যাচার সয়েছেন? কাফিররা, মক্কার কুরাইশরা তার ওপর কম নির্যাতন করেছে? মক্কা থেকে তিনি মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হননি? তায়েফে ইসলামের প্রচার করতে গিয়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হননি? তবুও কি কাউকে পাল্টা আঘাত করেছেন একবারও? নাকি আঘাতের নির্দেশ দিয়েছেন? নিজেকে নবীর উম্মত দাবী করে খোকা সাহেব তাহলে প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দেন কিভাবে? ইসলামে কি কোথাও এমন হত্যার অনুমতি দেয়া আছে? খোকা সাহেব কোন ইসলামের কথা বলছেন তাহলে? এই ইসলাম তো আইএসের ইসলাম, আল কায়েদার ইসলাম, নবীজীর ইসলাম তো নয়।
মহানবী (সা) যখন তায়েফে ইসলাম প্রচারের জন্য গিয়েছিলেন, সেখানকার লোকজন তাকে একের পর এক আঘাত করেছে, পাথর মেরে তার মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে, রক্ত জমাট বেঁধে জুতা পায়ের সাথে লেগে গিয়েছিল, খোলা যাচ্ছিল না। আল্লাহ তখন জিবরাইল (আ) কে দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন নবীর কাছে, বলেছিলেন, আপনি অনুমতি দিলেই এই জাতির ওপরে গজব নাজিল হবে। নবী সেই অনুমতি দেননি, বরং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন তাদেরকে সৎবুদ্ধি দেয়ার জন্য, যাতে তারা সত্য ও সুন্দরের পথ চিনতে পারে। নিজেকে সেই নবীর উম্মত দাবী করে লিয়াকত হোসেন খোকা কেন তাহলে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন? তার সঙ্গে ফ্রান্সের সেই শিক্ষককে হত্যাকারী জঙ্গী বা লালমনিরহাটে গুজব রটিয়ে পিটিয়ে শহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যা করা বর্বর অমানুষগুলোর পার্থক্য কোথায়?
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য আপনার খারাপ লাগতেই পারে, তার ওপর আপনি রুষ্ট হতেই পারেন। সেটার জন্য ভদ্রভাবে প্রতিবাদের ব্যবস্থা আছে। আপনি ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাতে পারেন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতকে তলব করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলতে পারেন, সংসদে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সে প্রদর্শিত ব্যাঙ্গচিত্রের নিন্দা জানাতে পারেন। কিন্ত একটা দেশের প্রেসিডেন্টকে 'অমুকের বাচ্চা' গালি দিয়ে তাকে হত্যার হুমকি দিতে পারেন না। আপনি সাংসদ হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন নাকি মুসলমান হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা আপনার ব্যাপার, সেই বক্তব্য গণনা করা হবে বাংলাদেশের একজন বর্তমান সাংসদের বক্তব্য হিসেবেই।
জনপ্রিয়তা পেতে যা খুশি তা বলাটা অনেকের অভ্যাস, কিন্ত সেটা যে দেশের জন্য দুর্নাম বয়ে আনতে পারে- এটুকু মাথায় রাখাটা খুব দরকার। কূটনৈতিক শিষ্টাচার বলে একটা বস্তু আছে, সেটা মেনে চলাও খুব দরকার। ফ্রান্সের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা আছে, ফ্রান্সে লাখ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী বাস করেন, তাদের ওপর যেন কোন বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে, আলপটকা মন্তব্য করলেই হবে না। ফেসবুকের কমেন্টবক্সে ইমানুয়েল ম্যাক্রোকে গালি দেয়া আর একজন সাংসদের ম্যাক্রোকে হত্যা করতে চাওয়া- দুটো এক জিনিস নয়।
একজন সাংসদ হয়ে, আইনপ্রণেতা হয়ে কেউ যখন এমন জঘন্য ভাষায় কথা বলেন, ইসলামকে ভুলভাবে রিপ্রেজেন্ট করেন, নিজেকে নবীজীর উম্মত দাবী করে জনপ্রিয়তা পাবার আশায় সহিংসতাকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেন, একজন জঙ্গীর সঙ্গে যখন একজন এমপির বক্তব্যের কোন তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন এদেশের নাগরিক হিসেবে নিজের ওপর বিতৃষ্ণা জন্মে।কাদের আমরা সংসদে বসিয়ে রেখেছি? আমাদের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে, পাজেরো হাঁকিয়ে এরা ইসলামের নামকে কলঙ্কৃত করে, মহানবীর মহত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উপাদান তৈরি করে। এদেরকে সংসদে দেখার জন্যেই কি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন