জীবনটা তিনি বাউন্ডুলে হয়ে কাটিয়েছেন, খ্যাতির তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ডুব দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে গিয়ে চাষবাস করেছেন, যাযাবর হয়ে ঘুরে ফিরেছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। স্থিরতা আসেনি, সম্পর্ক টেকেনি, নিজের গানের মতোই একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন লাকি আলী...

মাথায় সাদা টুপি, পরনে আফগান পাঠানদের ট্রেডিশনাল পোশাক। গিটার হাতে মানুষটা গাইছেন তার জনপ্রিয় গান- ‘ও সনম’। যে গানটা তরুণদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, ষোলো থেকে ছাব্বিশ সবার মুখে মুখে বাজতো যে গান, সেটা গাওয়ার সময় তাল কেটে যাচ্ছে তার। দম ফুরিয়ে আসছে, টানতে পারছেন না গলা। নিজেই হেসে ফেলছেন, বয়সের ছাপ চোখেমুখে স্পষ্ট, আর স্পষ্ট ক্লান্তির ছায়া। 

দুই মিনিটের ভিডিওতে কয়েকদিন আগে লাকি আলী যখন হাজির হলেন এভাবে, চমকে উঠেছিল সবাই। বিশেষ করে নাইন্টিজ কিড'রা, যাদের কাছে লাকি আলী আবেগের আরেক নাম। যার গান শুনে ছোটবেলা কেটেছে, ভাষাটা পুরোপুরি না বুঝলেও গায়কী আর সুর দিয়েই যিনি আমাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, যে লাকি আলী আমাদের কাছে ছিলেন তারুন্যের প্রতীক, বসন্তের প্রতীক, সেই মানুষটা আচমকা শীতের পাতাঝরা বৃক্ষের মতো জুবুথুবু রূপে দেখা দেবেন, তার গলায় গান আটকে যাবে, দম ফুরিয়ে যাবে- এভাবে তাকে দেখব, এটা ভাবনার করিডোরে কোথাও ছিল না।

লাকি আলী সেই মানুষ, যার গানে সহজবোধ্য জীবনবোধ, প্রেম, একাকীত্ব আর মাদকতা মিশে থাকতো, হারিয়ে যাওয়াটা যার প্রিয় অভ্যাস ছিল, যিনি খ্যাতির চেয়ে মুক্তির আনন্দকে বেশি পছন্দ করেন, যার কাছে টাকা মালিক হবার চেয়ে স্বতন্ত্র হয়ে, স্বাধীনভাবে বাঁচাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যে মানুষটা নিজের ক্যারিয়ারের সূর্য মধ্যগগনে থাকা অবস্থায় সবকিছু ছেড়েছুড়ে কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে বছর পাঁচেকের জন্য ডুব মারেন, যিনি নিজের দেশ ছেড়ে দূর পরবাসে বসে কৃষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে করতে গলা ছেড়ে গান করেন, ক্লান্তিকর দিনের শেষে সন্ধ্যেবেলায় যার সঙ্গী হয় মাতাল গিটার, হাতের আঙুলের স্পর্শে ঝংকার ওঠে ছয়টি তারে; শিল্পী হয়েও যে মানুষটা বুকের ভেতর পুষে রাখেন যাযাবর এক বেদুইন হৃদয়কে- তিনিই লাকি আলী। 

লাকি আলী, নব্বইয়ের দশকে

বাবা ছিলেন বিখ্যাত কমেডিয়ান মেহমুদ, দাদাও হিন্দি ফিল্মে অভিনয় করতেন। জন্মের পর নাম তার রাখা হয়েছিল মাকসুদ আলী, ডাকনাম লাকি। বাবার সঙ্গে দেখা হতো না একদমই, ভীষণ ব্যস্ত থাকতেন ভদ্রলোক, ছেলেকে সময় দিতে পারতেন না। তার ওপর মাত্র আড়াই বছর বয়সে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বোর্ডিং স্কুলে, কারন এরইমধ্যে তার এক ছোটভাই জন্ম নিয়েছিল, এত জনের দেখাশোনা একসঙ্গে করাটা সম্ভব ছিল না মায়ের পক্ষে। বাবার চেহারাটাও মনে ছিল না তার। স্কুলের ছুটিতে একবার বাড়িতে এসেছেন লাকি, বাবা এবং এক ভাই গেছেন এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করতে, তিনি চমকে উঠেছেন বাবাকে দেখে- আরে! এ তো কমেডিয়ান মেহবুব! এই লোক আমাকে নিতে এসেছে! 

মেহমুদ জানতেন, তার মেজ ছেলেটা খুব মেধাবী। তিনি চেয়েছিলেন, ছেলেও অভিনেতা হোক। চেষ্টাও কম করেননি ছেলেকে অভিনয় জগতে আনতে। লাকির যখন চার বছর বয়স, তখন তার সিনেমায় অভিষেক হলো শিশুশিল্পীর চরিত্রে, সিনেমার নাম ছোটে নবাব। কিন্তু একটু বড় হতেই লাকি আলি বুঝে গেলেন, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন নয়, তার বুকে ঢেউ ওঠে গিটারের আওয়াজ শুনলে। তিনি পড়ে রইলেন আর ডি বর্মন, কিশোরকুমারকে নিয়ে। বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ হলো, কথাবার্তা বন্ধ, বন্ধুদের নিয়ে গান চর্চা শুরু করে দিলেন লাকি, জীবনটাও বেহিসাবি হয়ে গেল, শুরু করলেন নেশা করা। 

বাবা অনেক চিন্তায় পড়ে গেলেন ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু ছেলে তখন অন্য এক জগতে বাস করে, তার দুনিয়াটা বাবার চেয়ে অনেক আলাদা। লাকি বুঝে গিয়েছিলেন, বলিউডে বা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বাবার পরিচিত অনেকেই থাকলেও, তাকে হাঁটতে হবে একা, পেছন থেকে সাপোর্ট তিনি পাবেন না। ঘাবড়ে না গিয়ে একলা চলো'র পন্থাই অবলম্বন করলেন তিনি, সঙ্গে পেলেন দুই বন্ধু সৈয়দ আসলাম আলী এবং মাইক ম্যাকক্ল্যারিকে। গান বানানোর পাশাপাশি তো টিকেও থাকতে হবে, টাকা রোজগারে জন্য কখনও ব্যবসা করেছেন, সেই ব্যবসায় লোকসান গুণে কাজ করেছেন তেলের খনি বা ঘোড়ার আস্তাবলের মতো জায়গাতেও! 

এর মাঝে নিজেদের লেখা আর সুর করা গান নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছেন লাকি, কিন্ত বলিউড বা গোটা ভারতে তখন মোটাদাগে যে টাইপের মিউজিক চলছে, সেই মেলোডিয়াস ধারা থেকে বেশ আলাদা ছিল লাকির গানগুলো। কেউ মুখের ওপর না বলে দিলেন, কেউ ভদ্র ভাষায় বোঝালেন যে, এসব চলবে না এখানে, অন্য কিছু নিয়ে এসো। লাকি আলী দমলেন না, নিজের সৃষ্টির ওপর তার ভরসা আর বিশ্বাস ছিল পুরোপুরি।চার বছরের প্রস্তুতি নিয়ে ১৯৯৬ সালে লাকি রিলিজ করলেন তার প্রথম একক অ্যালবাম 'সুনোহ'। 

লাকি আলী, বর্তমান ছবি

ওই এক অ্যালবামেই বাজিমাত হলো। ভারতে তখন মিউজিক ভিডিও জনপ্রিয় হচ্ছে। জমানো টাকা একত্র করে লাকি ছুটে গেলেন মিশরে, সুনোহ অ্যালবামের জনপ্রিয় গান 'ও সানাম' এর মিউজিক ভিডিও বানালেন, আরব বেদুইনের পোশাকে নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন লাকি নিজেই। বাবা তাকে বরাবরই অভিনেতা বানাতে চেয়েছিলেন, নিজের গানকে জনপ্রিয় করার জন্য লাকি অভিনেতাই হলেন কয়েক মিনিটের জন্য। সেই মিউজিক ভিডিও লুফে নিলো ভারতের মানুষ, ভিন্নধর্মী গান দিয়ে পুরো অ্যালবামটাই সাড়া ফেলে দিলো। ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত টানা ষাট সপ্তাহ এমটিভি এশিয়ার টপচার্টে ছিল 'ও সানাম' গানটা, এটা আজও একটা রেকর্ড। 

এরপর একটানা বিজয়ের গল্প। প্লেব্যাকের ডাক এলো সিনেমা থেকে, কণ্ঠ দিলেন ঋত্বিক রোশনের 'কাহো না পেয়ার হ্যায়' সিনেমায়, গাইলেন 'এক পাল কা জিনা' গানটা, কোমর দোলালেন ঋত্বিক। দুইয়ের রসায়ন জমে ক্ষীর, আরও একবার উঠলো ঝড়। এর মাঝে অ্যালবাম রিলিজ পেয়েছে- সফর, আকস, কাভি অ্যায়সা লাগতা হ্যায়,গোরি তের পেয়ার মে। নিজেও দুটো সিনেমায় অভিনয় করেছেন, শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় টিভি সিরিয়ালেও দেখা গেছে তাকে, যদিও নায়ক হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পারেননি। অভিনয়কে আঁকড়ে ধরা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাওয়াটাই বিপদ ডেকে আনলো, লাকির মনে হলো, গানের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা কমে যাচ্ছে তার। 

ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিও তখন বদলাচ্ছে, বড় বড় হাউজগুলো শিল্পীদের পণবন্দী করে রাখতে চাইছে, মিউজিকের 'ম' না বোঝা লোকজন এসে বাঘা বাঘা সঙ্গীতজ্ঞদের ওপর পণ্ডিতি ফলাতে চাইছে। তারা গান না বুঝলেও, ব্যবসাটা বোঝে। গ্রুপিং শুরু হলো সব জায়গায়, কোরামে কোরামে বিভক্ত হতে শুরু করলেন শিল্পীরা। টি সিরিজের একটা কোরাম, সনি মিউজিকের একটা কোরাম, জি মিউজিকের একটা কোরাম- এই বদলটা লাকির পছন্দ হয়নি, নিজের স্বাধীনচেতা স্বভাবটাও বিসর্জন দিতে চাননি কোনকিছুর বিনিময়ে। লাকি টাকার জন্য গান করেননি, করেছেন গানের প্রেমে পড়েছেন বলে। তাই লাকি আলী মানচিত্র থেকে হারালেন আচমকা, কোন নোটিশ না দিয়েই গায়েব হলেন। 

২০০৭ সালে ফিরে এলেন নতুন অ্যালবাম নিয়ে, গাইলেন আনজানা আনজানি সিনেমায়, গানের নাম হায়রাত- সেটাও তুমুল আলোড়ন তুললো। ব্যক্তিগত জীবনেও তখন ঝড় চলছে, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে সংসারটা টেকেনি, দ্বিতীয় বিয়েটাও তখন ভাঙছে। তৃতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন ২০০৯ সালে, তার বছর দুয়েক পর আবারও হারালেন। এবার অবশ্য জানিয়েই চলে গেলেন নিউজিল্যান্ডে। লাকির প্রথম স্ত্রী ছিলেন সেই দেশের নাগরিক, সেখানে একটা ফার্মহাউজ কেনা ছিল তার। সেখানে গিয়ে থাকতে শুরু করলেন। গিটার নিয়ে তুমুল ব্যস্ত সময় কাটানো লাকী আলী অন্যরকম ব্যস্ততায় ডুবলেন এবার, সেটার নাম কৃষিকাজ, রাসায়নিক ছাড়া শস্য উৎপাদনের নেশা ধরলো তাকে। 

মঞ্চে গাইছেন লাকি আলী

কয়েক বছর নিউজিল্যান্ডে কাটিয়ে ফিরে এলেন আবার, পরিচালক ইমতিয়াজ আলী গেলেন তার কাছে। এ আর রেহমানের কাছে নিয়ে গেলেন লাকি আলীকে, নতুন একটা গান গাইতে হবে ইমতিয়াজের সিনেমায়, গানের নাম সফরনামা। অদ্ভুত না? যে মানুষটা আড়াই বছর বয়সে ঘর ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে গিয়েছিলেন, যার গোটা জীবনটাই কেটেছে ঘুরে বেড়িয়ে, এক জায়গায় থিতু হওয়াটা যার কপালে ছিল না কখনও, যার গানে, যার মিউজিক ভিডিওতেও বারবার উঠে এসেছে সফরের কথা, ভ্রমণের কথা, যাকে ডাকাই হতো 'ট্রাভেল সং কিং' নামে, সেই মানুষটার সবশেষ প্লেব্যাক করা গানের নাম সফরনামা! 

তার গানে প্রেম এসেছে, বিরহ এসেছে, তার চেয়ে বেশি এসেছে একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা। মানুষ হিসেবে লাকি আলীও যে নিঃসঙ্গই রয়ে যাবেন, এটাই কি নিয়তি লিখে রেখেছিল আগে থেকে? নইলে তিনবার বিয়ে করেও কেন একটা সম্পর্কও টেকাতে পারলেন না তিনি? জীবনে যাদের তিনি ভালোবেসেছেন, তাদের ছেড়ে এলেও ভুলতে পারেননি, যোগাযোগ রেখেছেন, সেটা তার তৃতীয় স্ত্রী কেট এলিজাবেথই বলেছেন। এলিজাবেথের ভাষায়, তার মনে হতো একটা নয়, লাকি আসলে তিনটা সংসার করছে একসঙ্গে, এই যন্ত্রণাতেই নাকি তিনি লাকিকে ছেড়ে এসেছিলেন।

নিজের গানে লাকি গেয়েছিলেন, তিনি হাসতে চান, সবাইকে হাসাতে চান, সবার অভিমান ভাঙাতে চান, যদি কারো সাথে দূরত্ব তৈরি হয় সেটাও মিটিয়ে নিতে চান। লাকি গেয়েছেন, তার ভালোবাসা বরাদ্দ থাকবে তাদের জন্য, যারা তার মধ্যে ভালোবাসাকে খুঁজবে। লাকি নিজে তো ভালোবাসা খুঁজে পেলেন না, বাষট্টি বছর বয়সে একাকীত্বের অনলে পুড়ছেন, বেঁচে আছেন গিটারকে সঙ্গী বানিয়ে। গানটাকেও যে আঁকড়ে ধরতে পেরেছেন, এমনটাও নয়। শেষ অ্যালবাম রিলিজ পেয়েছে নয় বছর আগে, সিনেমায় গান গেয়েছেন পাঁচ বছর আগে, সেই সফরনামা। কিন্ত এখনও স্টেজ শো করতে গিয়ে গিটারে ও সানামের টিউনটা বাজালেই দর্শক সারিতে হুল্লোড় ওঠে, হাজারো মানুষ এক লহমায় ফিরে যান নব্বইয়ের দশকে, এই গানটা যখন পাগল করেছিল গোটা ভারতকে। 

জীবনটা তিনি বাউন্ডুলে হয়ে কাটিয়েছেন, বেদুইনের মতো বেঁচেছেন, যাযাবর হয়ে ঘুরে ফিরেছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। স্থিরতা আসেনি, সম্পর্ক টেকেনি, 'ঘর' বলতে যে অনুভূতিটা বুঝি আমরা, সেটা তৈরি হয়নি। মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে অনেক, লাকি আলীর চামড়া কুঁচকে গেছে, দম কমেছে, শরীর দুর্বল হয়েছে, একটানা গাইতে পারেন না এখন আর। আমরা যারা লাকি আলীর গান শুনে বেড়ে উঠেছি, তারাও বয়সের খাতায় ত্রিশের আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছি, অনেকে ত্রিশ পেরিয়েও গেছে। এই জীর্ণশীর্ণ জুবুথুবু হয়ে যাওয়া লাকি আলীকে দেখে তাই আমাদের মন খারাপ হয়, বুঝতে পারি, বড় হয়ে গেছি অনেক। তবু আজও লাকি আলী আমাদের কাছে আবেগের আরেক নাম, নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া কোন টাইম মেশিন, আজও মাঝরাতে ইউটিউবের নিউজফিডে উঁকি দেয় 'ও সানাম' গানের ঘোর লাগানো সুর, মাথায় গেঁথে থাকা লাইনগুলো বাজতে থাকে বারেবার-

"আঁখো মে বাসি হো, পার দূর হো কাঁহি,
দিল কে ক্বারিব হো ইয়ে মুঝকো হ্যায় ইয়াকীন;
ও সানাম, তেরি ইয়াদো কি কসম
ও সানাম, মোহাব্বাত কি কসম..."

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা