রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ জানে না, জনগন তাদের কতটা ঘৃণা করে। সমাজের ক্ষমতাবান পুরুষ জানে না, তাদের দুস্কর্মের কারণে নারীরা তাদের কতটা ঘৃণা করে...

ভাগ্য-তকদীর-কপাল- এসব জিনিসের ওপর একটা সময়ের পর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। তবে ইদানিং নিজেকে আমি যথেষ্ট ভাগ্যবান ভাবি। বায়োলজিক্যালি আমার একটা পুরুষাঙ্গ আছে, আইডি কার্ড বা সার্টিফিকেটে আমার নামের পাশে সেক্স/জেন্ডার হিসেবে 'মেল' লেখা হয়, অবশ্যই আমি ভাগ্যবান। জন্মসূত্রে আমার গায়ের সাথে 'মুসলমান' এবং 'সংখ্যাগুরু' নামের একটা দৃশ্যমান এবং একটা অদৃশ্য ট্যাগ লেগে গেছে, যেগুলো অনেক জায়গায়, অনেক ক্ষেত্রে আমাকে প্রোটেক্ট করে, হয়তো নিজের অজান্তেই- নিজেকে আমি ভাগ্যবান দাবী করব না কেন? 

সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণাটা খুব বেশি মানুষ বুঝবে না, অনুভবও করতে পারবে না। 'শালা মালাউনের বাচ্চা' গালি শুনে কিরকম জঘন্য অনুভূতি হয়, সেই অভিজ্ঞতা আমার নেই। মোবাইল বা মানিব্যাগ খোয়ানোর চিন্তা বাদ দিলে আমি দিনে বা রাতে যে কোন সময় এই দেশের যে কোন রাস্তায় নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারি, শরীরের নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয় না, তথাকথিত 'ইজ্জত' হারানোর ভাবনায় নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখতে হয় না- এটা যে কত বড় রিলিফের একটা বিষয়, সেটা হয়তো আমি বুঝতেও পারি না ঠিকমতো। 

মন চাইলেই দেশ-বিদেশের যে কোন প্রান্তে ট্যুর দেয়ার প্ল্যান করতে পারি, বন্ধুর বাসায় রাত কাটানোর জন্য আমাকে কারো অনুমতি নিতে হয় না, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে পারি, গলির মোড়ে আড্ডা মারতে পারি, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে পারি, উচ্চস্বরে কথা বলতে পারি, বন্ধুর ফোন এলে ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারি- আমাকে কারো কাছে কিচ্ছু জবাবদিহি করতে হয় না। আমি সেই সমস্ত ব্যাপারগুলো অবলীলায় উপভোগ করতে পারি, যেগুলো আমার বোনের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল, আছে এবং থাকবে। 

চলন্ত বাসে বাজেভাবে কেউ স্পর্শ করলে কিরকম লাগে, সেটা আমি জানিনা। আসরের আজানের পরে মাথার মধ্যে 'সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, বাসায় ফিরতে হবে' নামের একটা অটোমেটিক ঘড়ি অ্যালার্ম বাজাতে শুরু করলে কেমন লাগে, সেটাও আমার জানা নেই। ফুটপাথে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শরীরে অযাচিত হাতের ছোঁয়ায় গা কেমন গুলিয়ে ওঠে, সেই অভিজ্ঞতাও আমার কখনও হয়নি। কারণ সমাজের চোখে আমি 'মাল' না, আমি ভোগ্যপণ্য না, আমি সংখ্যাগুরু, আমি নিপীড়কের ভাই, বন্ধু, তাদের দলভুক্ত। 

এই উপমহাদেশে সংখ্যাগুরু হয়ে জন্ম নেয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার

পরনের টিশার্টটা টাইটফিট হলো নাকি, থ্রি কোয়ার্টারের ফাঁক দিয়ে আমার পায়ের কত শতাংশ বাইরে বেরিয়ে আছে, কলিংবেল বাজলে খালি গায়ে দরজা খুলতে যাওয়া উচিত হবে কিনা- এসব নিয়ে আমাকে কখনও ভাবতে হয়নি, কারন সমাজ আমাকে জানিয়েছে  তুমি ছেলে, তোমার পুরুষাঙ্গ আছে, তুমি নিরাপদ। আমি জেনেছি, ডিক ইজ এ ভেরি পাওয়ারফুল থিং। কিন্ত আমার, বা আমাদের সেই ক্ষমতাধর পুরুষাঙ্গ থেকে বাকিদের নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা এই সমাজ করতে পারেনি, এই রাষ্ট্র করতে পারেনি, পারবেও না। 

ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ার সময় বয়সে বড় একটা ছেলে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। এখন আমার যে সাইজ, চাইলেই আমি তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে পারি, ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকি বলে সেটা করা হয় না। এখনও আমি ওই দৃশ্যটা, গালের ওই জ্বলুনিটা, অপমানের তীব্রতাটা সেদিনের মতোই অনুভব করি। ওই ছেলেকে কখনও চোখের সামনে দেখলে আক্রোশে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়। তাহলে ধর্ষণের পরে একজন নারীর মনে কতটা আক্রোশ জন্ম নিতে পারে, আমি কল্পনা করার চেষ্টা করি। সেই ধর্ষক যখন বুক ফুলিয়ে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, উল্টো হুমকি দেয়, ব্ল্যাকমেল করে- সেই নারী কি ভয়াবহ ট্রমার মধ্যে দিয়ে যান, সেটা দুনিয়ার কোন পুরুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। 

যারা নিপীড়ক, তারা কখনও নিপীড়িতের আর্তনাদ শুনতে পায় না, তার কষ্টটা বুঝতে পারে না। আমিও সেভাবে বুঝতে পারি না, মাঝরাতে ভয়শূন্য মানসিকতা নিয়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর অপূর্ণ বাসনা বুকের ভেতর জিইয়ে রেখে এদেশের কত অজস্র নারী বেঁচে থাকে। পুরুষ নামের অতি ক্ষমতাধর এক হিংস্র প্রাণীর আস্ফালনের কারনে তাদের ছোট ছোট কিছু ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যায়, যেগুলো কেউ 'ড্রিম লিস্টে' রাখতে পারে বলেও আমাদের মনে হয় না। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা দলগুলো জানে না, জনগন তাদের কতটা ঘৃণা করে। সমাজের ক্ষমতাবান পুরুষ জানে না, তাদের দুস্কর্মের কারণে নারীরা তাদের কতটা ঘৃণা করে...

আমার জন্মের পেছনে প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক যে ঘটনারই ভূমিকা থাকুক না কেন, আমি ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। ধর্ম এবং লিঙ্গ- দুই মাধ্যমেই আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ- এই অনুভবটা যে উপমহাদেশের মতো জায়গায় কতটা নিরাপত্তা দিতে পারে, সেটা সংখ্যালঘু না হলে কেউ বুঝবে না...

ছবি কৃতজ্ঞতা- ছাত্র ইউনিয়নের আঁকা ধর্ষণবিরোধী গ্রাফিতি, বেইলি রোড, ঢাকা।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা