তারা নাকি দৈববানী শুনেছেন যে রবিবার গভীর রাতে কলিযুগ শেষ হতে চলেছে, যা মেয়েদের পক্ষে ভালো নয়। তাই তাদের বলিদান করা হয়েছে। আর কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হতে চলেছে সত্যযুগ, তখনই আবার পুর্নজন্ম লাভ করবে তাদের দুই মেয়ে...

এক

না, এটা কয়েক হাজার বছর আগের মিথলজিকাল কোনো ঘটনা নয়। গত রবিবার, ২৩শে জানুয়ারি, ২০২১ এর ঘটনা এটা। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের চিত্তোর জেলার  মদনাপল্লী শহরের শিবনগর এ ঘটেছে এই মর্মান্তিক ঘটনা । 

এখানে মা-বাবা তাদের দুই মেয়েকে বলি দিয়েছেম দেবতার কাছে। তাদের বিশ্বাস- এভাবে খুন করাই মেয়েদের জন্য ভাল হয়েছে। মেয়েদের আবার পুনর্জন্ম হবে। 

ভি পদ্মজা এবং ভেলেরু পুরুষোত্তম নাইডু, এই দম্পতি উচ্চশিক্ষিত। শহরের একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন পদ্মজা দেবী, তিনি ম্যাথ এ মাস্টার্স। পুরুষোত্তম নাইডু কেমিস্ট্রিতে এম ফিল এবং পিএইচডি করেছেন। শহরের একটি  মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করতেন। দুইজনেই ছিলেন প্রচন্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বাসায় অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত কাজ করতেন বলে প্রতিবেশীরা জানান। 

তাঁদের বড় মেয়ে আলেখ্যা (বয়স ২৭) ভোপালে একটি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আর ছোট মেয়ে সাই দিব্যা (বয়স ২২) বিবিএ করেছেন বেংগালুরু থেকে। এখম  মুম্বইয়ের এ আর রহমান মিউজিক স্কুল এ পড়ছিলেন। লকডাউনে দীর্ঘদিন এই মেয়েরা বাবা-মায়ের সাথে বাড়িতেই ছিলেন। 

 মদনাপল্লীর ডিএসপি রবি মনোহরা চারি জানান, কোভিড-১৯ এর লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ সময় ওই দম্পতি নিজেদের বাড়িতে আবদ্ধ রেখে অদ্ভুত আচরণ করছিল। রবিবার দিন তাদের বাড়ি থেকে প্রচন্ড জোরে চিৎকারের আওয়াজ শুনে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়।

প্রাথমিকভাবে এই দম্পতি পুলিশকে ঘরে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে। পুলিশ বাড়িতে জোর করে ঢোকার পরে দেখে, একটা মেয়ে পুজোর ঘরে মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং অন্য একটি ঘরে লাল রঙের কাপড় জড়ানো অবস্থায় আর একজন মেয়ে চিত হয়ে পড়ে রয়েছে। দু'জনের মাথায়ই ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাদের  পাশে কিছু পুজোর সামগ্রী আছে। দেখে মনে হচ্ছে, হত্যার পূর্বে তাদেরকে ঘিরে কোনো ধরনের পূজা / রিচুয়াল পালন করা হয়েছিল। 

ডিএসপি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, "আমাদের প্রাথমিক তদন্তের সময় মনে হয়েছিল যে এই দম্পতি অত্যন্ত কুসংস্কারজনক। কারণ আমরা যখন নিহতদের মৃতদেহ ঘর থেকে বার করে আনছিলাম, তখন তারা বলেছিল, কিছু ক্ষণ পরেই তাদের মেয়ে আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে"। 

এই দম্পতি পুলিশকে আরও বলেছিল, তারা দৈববানী শুনেছেন যে রবিবার (২৩শে জানুয়ারি) গভীর রাতে কলিযুগ শেষ হতে চলেছে, যা মেয়েদের পক্ষে ভাল নয়। তাই তাঁদের উৎসর্গ করা হয়েছে। আর কিছু ক্ষণ বাদেই  শুরু হতে চলেছে সত্যযুগ, (২৪শে জানুয়ারি) তখনই আবার পুর্নজন্ম লাভ করবে তাদের দুই মেয়ে।

না, ওদের বিশ্বাস সত্য হয়নি। মেয়েরা আর জ্যান্ত হয়নি। পুলিশ তাদের ডেডবডি নিয়ে গিয়েছে পোস্ট মর্টেমের জন্য। 

তথ্যসূত্র- ১

তথ্যসূত্র- ২

তথ্যসূত্র- ৩

দুই

পোস্ট পার্টাম সিন্ড্রম নামে একটা মানসিক রোগ রয়েছে । সেখানে ডেলিভারিরি পরে হরমনজনিত জটিলতার কারনে মায়েদের মধ্যে অনেক অস্বাভাবিক আচরন দেখা যায়। অনেক মা সুইসাইড করেন। অনেক মা তার বাচ্চাকে খুন করেন। 

হুমায়ুন আহমেদের মিসির আলি সিরিজের 'জিন কফিল' গল্পে এমন একটা ঘটনার বর্ননা রয়েছে। ওই গল্পের মা যখনই প্রেসন্যান্ট হত, তখনই সে অস্বাভাবিক আচরন শুরু করত। বাচ্চা ডেলিভারির পর সেই বাচ্চা মেরে ফেলত। বলত, আমি নিজে কিছু করিনাই, আমার ঘাড়ে থাকা জিন কফিল আমাকে দিয়ে এসব করাইছে। 

গল্পের দুনিয়া ছাড়া বাস্তব জগতেও এমন ঘটনার অভাব নাই।  বাংলাদেশের একটা উদাহরন দেই। ২০১৫ সালের ২রা মে ফরিদপুরের তাসলিমা বেগম বাচ্চা ডেলিভারির  ৬ মাস পরে তার বাচ্চাকে খুন করেন।  তার দাবি, জ্বিনের আদেশে আমি বাচ্চাদেরকে খুন করেছি। 

সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, আমি প্রতি রাতেই তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। ঘটনার রাতে তাহাজ্জুত নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ি। এসময় আমার কাছে গায়েবি হুকুম আসে শিশু দুটিকে হত্যা করার। সে অনুযায়ী রাত তিনটার দিকে প্রথমে ঘুমিয়ে থাকা পুত্র সন্তান তকিকে (৫ বছর) গলাটিপে হত্যা করি। পরে ৬ মাস বয়সী মেয়ে তাহেরাকে একই কায়দায় গলা টিপে হত্যা করি।

এ ধরনের পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস এর কয়েকজন মায়ের ঘটনা দেখতে পাবেন এখানে

শুধু মা নন, অনেক সময় 'বাবারা কুসংস্কার এর কারনে বাচ্চা মেরে ফেলেছে' --এমন খবর আসে। ২০১৪ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মুনপিরিত গ্রামে নাজমুল হোসেন নামের এক বাবা স্বপ্নে আদেশ পেয়ে তার ৩ মাস বয়সী মেয়ে নুসরাত কে মেরে ফেলেন। 

পুলিশ তখন তাকে এ্যারেস্ট করে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠায়। 

নাজুমুল হোসেন এর দাবী, স্বপ্নে সে আদেশ পেয়েছে, মেয়েটাকে ঝোপ এর মধ্যে নিয়ে দাত দিয়ে কামড়ে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। স্বপ্নে আদেশ পেয়েই সে এই কাজ করেছে। (নিউজ লিংক)

তবে, বাচ্চার বয়স বেশি হয়ে গেলে মায়েদের আর এই পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস থাকবে না। এখানকার মা, ভি পদ্মজা এর ২২ এবং ২৭ বছর বয়সী সন্তান তয়েছে। এর রোগ কে সম্ভবত পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস বলা যায়না, অন্য মানসিক জটিলতা থাকতে পারে। 

এক ছবিতে পুরো পরিবার

তার বিশ্বাস আরো অনেক গভীর। তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করছে প্রাচীন গ্রন্থে বর্ণিত ভবিষ্যতবানীগুলো । বর্তমান যুগকে তারা পাপে পরিপূর্ণ কলি যুগ  মনে করছে। নির্দিষ্ট কিছু পূজা, নরবলি এবং অন্যান্য রিচুয়াল পালন করলে এই সংকট কেটে যাবে বলে বিশ্বাস করছে তারা। সাইকোলজিস্ট রা সম্ভবত তাদেরকে সিজোফ্রেনিয়ার (অলীক বিশ্বাস) রোগী হিসেবে চিহ্নিত করবেন । দৈববানী/গায়েবী আওয়াজ শোনাটা অডিটরি হ্যলুসিনেশন এর লক্ষণ। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বলতে পারবেন ওদের সমস্যাটা কি ছিল। 

Sacred Games টিভি সিরিয়ালে এইরকম একটা গ্রুপের কার্যকলাপ দেখানো হয়েছে, যাদের সাথে বাস্তবের অনেক গ্রুপের মিল রয়েছে। (পড়ুন ডুমসডে কাল্ট)

অনেক জঙ্গি গ্রুপ একইভাবে ,কেয়ামতের ভয় দেখিয়ে তাদের রিক্রুটদেরকে খুন-জখম ভায়োলেন্স বা আত্মঘাতী হামলা করতে মোটিভেট করছে। এদের প্যাটার্ন এর মধ্যে কি কোনো পার্থক্য রয়েছে? নাকি এক্কেবারে সেম টু সেম? 

তিন

এই দম্পতি একা নন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো অনেক মানষকে বিশ্বাসের কারনে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। গত বছর উড়িশ্যার এক মন্দিরে সংসারী ওঝা তার প্রতিবেশী এক যুবককে খুন করে তার কাটা মুন্ডু দিয়ে পূজা করছিল মন্দিরে। তার বিশ্বাস, এইভাবে পূজা করলে বিশ্ব থেকে করোনা দূর হবে । 

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে তান্ত্রিক এর কথায় পরিবারে শান্তি ফেরাতে ২ বছর বয়সী মেয়েক খুন করেছিলেন  ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজাফফর নগরের ওয়াজিদ আলি 

এরকম অনেক ঘটনা আছে। গুগল করলেই গত ১০ বছরে অন্তত ২০ টা এমন ঘটনা পাবেন, যেখানে বিশ্বাসের কারনে বাবা/মা আত্মীয়স্বজন অন্যকে বলি দিয়েছে। 

বারবার বলি, নিজে সচেতন হোন। অন্যকেও সচেতন করুন। ২৭ বছরের তরুণী আলেখ্যা কিংবা ২২ বছরের দিব্যা হয়ত নিজেরা কোনো কুসংস্কারে বিশ্বাস করত না, কিন্তু তাদের বাবা-মায়ের বিশ্বাসের ফলে আজ তাদের বলি হতে হল। 

আপনি হয়ত কুসংস্কার বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আপনার আশেপাশের বিশ্বাসীদের কারনে আপনার ও ক্ষতি হতে পারে। আছে নাকি আপনার আশেপাশে এমন কেউ ? 

বারবার বলছি, নিজে সচেতন হোন। অন্যকেও সচেতন করুন।

চার

এই ঘটনা থেকে আমরা কি কি শিখলাম ? 

ক) যত বড় শিক্ষিতই হোন না কেন, যে কেউ যে কোনো ধরনের কুসংস্কারে আক্রান্ত হতে পারেন । 

(বাই দ্য ওয়ে, কুসংস্কার বা  বেসিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো শর্ট কোর্স /লং কোর্স করায় কোনো ভার্সিটিতে? বা কোনো প্রতিষ্ঠানে?  জানা থাকলে কমেন্ট করেন) 

খ) কুসংস্কারকে হেলাফেলা করা উচিত না। এগুলায় যিনি বিশ্বাস করেন, তিনি অনেক ভয়ংকর কাজ করে ফেলতে পারেন। খুন যখম ও করতে পারেন। এমনকি নিজের ফ্যামিলি মেম্বরকেও খুন করতে পারেন। উপরের ঘটনাটা তো তার ই প্রমান।  

অনেকে মনে করেন, ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত কুসংস্কার গুলা নিয়ে কিছু বলা উচিত না। এতে কারো যদি ক্ষতিও হয়ে থাকে, তাও কিছু বলা যাবেনা।   

আজ থেকে ২০০ বছর আগে রাজা রাম মোহন রায় এই বিধান মানেন নি। তিনি অমানবিক সহমরন/সতীদাহ প্রথার নিরোধীরা করেন। (এই প্রথায়, কোনো মেয়ের স্বামী মারা গেলে, মৃত স্বামীর সাথে জ্যান্ত অবস্থায় স্ত্রীকেও  পুড়িয়ে মেরে ফেলা হতো) এভাবে সহমরণে গেলে নাকি স্ত্রীর নিশ্চিত স্বর্গলাভ।   

রাজা রাম মোহন রায় রা সেই সময় এই কুসংস্কারের বিরোধীতা করলেন। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পরে অবশেষে সরকারী আইন করে এই প্রথা বন্ধ করলেন।   

বর্তমান সময়েও, ধর্মে বিশ্বাসের সাথে যদি কোনো কুসংস্কার জড়িত থাকে, এবং সেটার কারনে মানুষের ক্ষতি হয় ( যেমন কল্যানী এবং দিব্যার মৃত্যু ), তাহলে সেই রিচুয়াল, সংশ্লিষ্ট বই পত্র আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।   

আপনি কি মনে করেন ?

আরো পড়তে পারেন- 

  1. স্বপ্নে পাওয়া আদেশ কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত
  2. কালীপূজা এবং নরবলির কুসংস্কার 
  3. ধর্মগ্রন্থে কুসংস্কার: মনুসস্মৃতিতে আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ- ভারতে মনুস্মৃতি নিষিদ্ধের দাবী
  4. ময়মনসিংহে এডাম ফ্যামিলি

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা