আমাদের জন্যে এইসব ডান্ডাওয়ালা পুলিশ আর কানে ধরানো ম্যাজিস্ট্রেটই ঠিক আছে। নির্লজ্জ, ইতর আর অমানুষে ভরপুর একটা জাতি, সেখানে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটরা তো আর ইউরোপ-আম্রিকা থেকে উঠে আসবে না।

বঙ্গবন্ধুর একটা ভাষণের অংশ দিয়ে লেখাটা শুরু করি। ১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- "সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনী নয়। পাকিস্তানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ, ওরা নিজেরা কামাই করে খায়। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।"

২০২০ সালের ছাব্বিশে মার্চ গেল দুদিন আগে, জাতির পিতার সেই ভাষণের পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এসে প্রশাসন বনাম জনগণের সম্পর্কের চিত্রটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? আমরা যে সারাদিন 'বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, শেখ মুজিবের স্বপ্ন' বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, সেই স্বপ্নটা কি ছিল? প্রশাসনের কর্মকর্তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন? জনগনের সঙ্গে মানুষের বদলে কুকুর-বেড়ালের মতো আচরণ করবেন? বাবার বয়সী বৃদ্ধকে কানে ধরে উঠবস করাবেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট- এক বাংলাদেশ দেখার জন্যে বঙ্গবন্ধু তেরো বছর জেল খেটেছিলেন? 

যশোরের মনিরামপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান মুখে মাস্ক না পরায় বয়স্ক কয়েকজন মানুষকে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন, কান ধরার ছবিও তুলেছেন খুব আনন্দ নিয়ে। সেই ছবি আবার ফেসবুকে আপলোড দেয়া হয়েছে। এটুকুতেও ক্ষান্ত থাকলে একটা কথা ছিল, উপজেলা ওয়েবসাইটেও সেই বৃদ্ধদের কানে ধরা ছবি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অদ্ভুত এক বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

মানুষগুলোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, পেটের তাগিদেই তারা নেমেছিলেন পথে। লকডাউনের এই দিনগুলোতে আয় রোজগার শুন্যের কোঠায়, ঘরে বসে থাকলে তো চুলা জ্বলবে না। সেজন্যেই তারা বাইরে এসেছেন। এদের মধ্যে একজন সবজি বিক্রেতা, আরেকজন ভ্যানগাড়ি চালক। চিকিৎসকেরা বারবার বলেছেন, করোনা টেস্টে পজিটিভ না হলে মাস্ক পরাটা জরুরী নয়, তবুও কেন এই মাস্ক না পরাকে অপরাধ ধরে নিয়ে এই বৃদ্ধ মানুষগুলোর ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েমা হাসান- সেটা বোধগম্য নয় একদমই। 

কান ধরার ছবিটা শোভা পাচ্ছে উপজেলার সরকারী ওয়েবসাইটেও

অবশ্য, বিসিএস ক্যাডার বলে কথা, থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে তারা তো রাজা, বাকী সব হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর প্রজা। কাকে কান ধরালেন, কাকে হামাগুড়ি দেয়ালেন, সেসবে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ? আপনারা ক্যাডার হয়েই রইলেন, মানুষ আর হতে পারলেন কই? আফসোস, লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছুরি-কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া শেখানোর পাশাপাশি সাইয়েমা হাসানকে যদি মানুষের সাথে, বয়স্কদের সাথে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়- সেটাও শেখানো যেতো, তাহলে গতকালের ঘটনাটা ঘটতো না বোধহয়। 

পুলিশ পেটাচ্ছে ঘর থেকে বের হলেই, ম্যাজিস্ট্রেট কান ধরিয়ে দাঁড় করে রাখছেন। ঘরে থাকাটা নিঃসন্দেহে জরুরী, কিন্ত যে মানুষটার ঘরে খাবার নেই, পকেটে একশোটা টাকা নেই, রাস্তায় না নামলে যার আয়-রোজগার বন্ধ, যার বাড়িতে চুলা জ্বলছে না, বাচ্চা বাচ্চা একগাদা ছেলেমেয়ে বাবা-মায়ের মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে- সেই মানুষটাকে আপনি কীভাবে ঘরে বন্দী করে রাখবেন? আপনার ঘরে চাল আছে, একগাদা বাজার করে সব স্টক করে রাখসেন আপনারা, হুকুম দিলে লোকজন এসে খাবারের গোডাউন রেখে যায় আপনাদের পায়ের গোড়ায়- অভুক্তের জ্বালা, অক্ষম পিতা হওয়ার যন্ত্রণা আপনারা বুঝবেন না, বোঝার কথাও না।

মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেট, কাউকে কান ধরে উঠবস করানোর আগে আপনার তো জানা দরকার ছিল, মানুষটা কেন লকডাউনের মধ্যে বের হয়েছে? তার সমস্যাটা কোথায়? দুমুঠো খাবার জোগাড় করাটা যদি তার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করুন, কেন রাষ্ট্র অসহায় মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছে না? পাশের দেশ ভারত যদি পারে, দিল্লির মতো একটা রাজ্য যদি প্রতিদিন চার লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের মুখে ফ্রি-তে খাবার তুলে দিতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারছে না? ভারত তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে তারপর দেশ লকডাউন করেছে, সেখানেও পুলিশ লাঠিচার্জ করছে, বের হলে জরিমানা করছে, কিন্ত ভারত গর্ব করে বলতে পারবে, সেদেশ তার নাগরিকদের না খেয়ে মরতে দেয়নি লকডাউনের সময়টায়। আমরা কি পারব সেই দাবী করতে? 

ছবি তুলছেন ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েমা হাসান

কারো মুখে মুখে মাস্ক না দেখে আপনি কান ধরাচ্ছেন, তার আগে একটু জিজ্ঞেস করে নিন, এই মন্দার বাজারে মাস্ক কেনার মতো ৫০টা টাকা তার পকেটে আছে কিনা! মাস্ক যদি বাধ্যতামূলক হয়, প্রতিটা নাগরিকের কাছে জন্যে সেটা সরবরাহ করাটাও রাষ্ট্রের জন্যে বাধ্যতামূলক কাজ। সেই কাজ কি আপনারা করতে পেরেছেন? পারেননি, আপনাদের দৌড় ওই কান ধরিয়ে সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে আলগা বাহাদুরি করা পর্যন্তই! 

অবশ্য, আমরা জাতিগতভাবেই এরকম অসভ্য। আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই, আবার নিজেদের এলাকায় কোয়ারেন্টিন জোন হলে সেটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামি। আমরা চাই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা মোকাবেলার মতো আধুনিক হোক, আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিণ্ডি চটকাই, পলিটিশিয়ানদের দিনরাত গালিগালাজ করি, অথচ আমার এলাকার হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা দেয়া হবে কেন- এটার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামি! এদেশের মানুষ এক মুখে বলে মসজিদে গেলে, জামাতে নামাজ পড়লে করোনা হবে না। আবার যখন এলাকার গোরস্থানে করোনায় মারা যাওয়া কাউকে কবর দিতে আসে, সেই একই লোক তখন ভোল পাল্টে সেটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়! 

আমাদের জন্যে এইসব ডান্ডাওয়ালা পুলিশ আর কানে ধরানো ম্যাজিস্ট্রেটই ঠিক আছে। নির্লজ্জ, ইতর আর অমানুষে ভরপুর একটা জাতি, সেখানে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটরা তো আর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে উঠে আসবে না। আমরা সেটাই পেয়েছি, যেটা আমরা ডিজার্ভ করি। এটা প্রকৃতির বিচার, প্রকৃতি কাউকে বেশি, কাউকে কম দেয় না, তার ভাগ-বাটোয়ারা সমান হয় বরাবর। যে জাতির স্বভাব যেরকম, সেখানে ক্ষমতাবানেরাও সেরকমই হবে, এতে আশ্চর্য্য হবার কি আছে?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা