
এই মানুষটির আত্মত্যাগের ফলেই আজও বেঁচে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাহলে এতদিনে বাংলাদেশ হয়তো সত্যি সত্যিই পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে পরিণত হতো। তাই এই মানুষটির প্রতি আমাদের আজীবন ঋণী থাকার কথা ছিল। অথচ...
২১ আগস্ট, ২০০৪। সেদিনটা ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও গাড়িচালক মাহবুব রশীদের ছুটি। চাইলেই তিনি দুপুরের খাওয়া শেষ করে লম্বা একটা ঘুম দিতে পারতেন। সারাবছরই তো হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তাই ছুটির দিনে একটু আরাম আয়েশ করে সময় কাটানো তো তার প্রাপ্য।
কিন্তু মাহবুব যে একসময় সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। ২০০০ সালে যোগ দিয়েছিলেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও। পরে ২০০২ সালে ল্যান্স কর্পোরাল পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করলেও, তার মনস্তত্ব গড়ে উঠেছিল একদম খাঁটি সৈনিকদের মতই। কর্তব্যবোধের চেয়ে বড় আর কিছুই ছিল না তাঁর কাছে। সেই কর্তব্যবোধের অমোধ ডাকে সাড়া দিয়েই, সেদিন তিনি ছুটে গিয়েছিলেন রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। কারণ সেদিন সেখানে হওয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ, যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সে সময়ের সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।
সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাবেশে অন্যান্য বক্তাদের বক্তৃতা শেষ হলে, বিকাল পাঁচটার মিনিটখানেক পর বক্তব্য রাখা শুরু করেন শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ হলে, ৫টা ২২ মিনিটের দিকে, এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে বিকট শব্দে একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। মোট ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরও হামলাকারীরা যখন বুঝতে পারল গ্রেনেড জখম করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে, তখন গুলি ছুঁড়তে শুরু করল তারা। নেতারা ও দেহরক্ষীরা দ্রুত শেখ হাসিনাকে তার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে দেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পরপর ৬টি বুলেট। কিন্তু একটিও শরীর স্পর্শ করে না শেখ হাসিনার।
গ্রেনেড হামলায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন শেখ হাসিনা যখন তার বুলেটপ্রুফ গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সাহসী মাহবুব তাকে গাড়িতে প্রবেশ করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু শেখ হাসিনা মাহবুবকে চিৎকার করে বলে, "না আমি যাব না, ওরা মারে আমাকে মারুক।" নেত্রীর সে কথায় কান না দিয়ে মাহবুব বুক দিয়ে আগলে গাড়ির মধ্যে তাকে ঠেলে দেন। আর ঠিক এ সময় একটি বুলেট তার মাথার পেছন দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি গুলি তার বুকে বিদ্ধ হয়। রাজপথে লুটিয়ে পড়েন মাহবুব। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার অবস্থা আশংকাজনক হলে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল হয়। ২১ আগস্ট রাতেই মাহবুব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সেদিন যদি মাহবুব এগিয়ে না আসতেন, নিজের জীবনের বিনিময়ে বর্তমান দেশনেত্রী শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা না করতেন, তাহলে হয়তো চিরতরে পাল্টে যেত বাংলাদেশের ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর যেমন ঘোর অমানিশা নেমে এসেছিল সোনার বাংলায়, ঠিক সেরকম কিছুরই পুনরাবৃত্তি হতো এই দেশে। আমাদের বাংলাদেশ হয়তো এতদিনে পরিণত হতো পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে। কিন্তু তা যে শেষ পর্যন্ত হয়নি, এবং এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে থেকে একাত্তরের চেতনাকে ঢাল করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তো মাহবুবেরই।
সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার পাশে মাহবুবের মতো একজন ছিলেন বলেই বাংলাদেশটা আজও বাসযোগ্য রয়েছে, পুরোপুরি আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়নি। সেজন্য মাহবুবের প্রতি প্রতিটি বাংলাদেশের আজীবন ঋণী থাকা উচিৎ। কিন্তু আদৌ কি মাহবুব তাঁর অমর আত্মত্যাগের যোগ্য প্রতিদান পেয়েছেন? পাননি। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, দেশের অধিকাংশ মানুষ মাহবুবকে চেনেই না। আর যারাও বা চেনে, তারাও মনে রাখেনি মাহবুবকে। ক্রমেই যেন ইতিহাসের বিবর্ণ পাতার ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছেন মাহবুব। সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার হবে।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ফুলবাড়িয়ায় ছিল মাহবুবের গ্রামের বাড়ি। তাঁর কবরটিও সেখানেই, শৈশবের স্কুলের পাশে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো স্মৃতি সংরক্ষণ কিংবা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না উপজেলা কিংবা জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। নিদারুণ অবহেলা আর অযত্নে মাহবুবের কবরটি রয়েছে আগাছায় ঘেরা। মাহবুবের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থানীয় একটি সড়কের নামকরণের উদ্যেগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। মাহবুব ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর পর অথৈ জলে পড়ে তাঁর পরিবার। সেই পরিবারটিকেও কি যথাযথ সহায়তা করা হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় রয়েছেন মাহবুবের স্ত্রী শামীমা আক্তার। বড় ছেলে ঢাকার শ্যামলীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ছোট ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এককালীন ৫ লাখ টাকা ও বঙ্গবন্ধু কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে মাসিক ৭ হাজার টাকা দিয়ে চলছে ছেলেদের লেখাপড়াসহ পরিবারের সমস্ত খরচ।
কিন্তু পরিবারের অন্যান্য সদস্য, যারা এখনও গ্রামে বাস করেন, তাদের অভিযোগ যে এক যুগেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও তারা তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না হয় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই ইচ্ছা থাকলেও সবসময় আলাদা করে এই পরিবারটির প্রতি বিশেষ নজর দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ আর কারোও কি কখনও মনে হয় না মাহবুবের পরিবার ঠিকমত সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটু খোঁজ-খবর নেয়া উচিৎ? প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা কি তবে কেবল তাঁর প্রতি চাটুকারিতাতেই সীমাবদ্ধ?
যেই মানুষটির আত্মত্যাগের ফলে আজও প্রধানমন্ত্রী বেঁচে আছেন, তাঁর পরিবারের ব্যাপারে, বা তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই?
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হলেও গত ১৪ বছরে হয়তো মাহবুবকে নিয়ে অন্তত এক ডজন বই লিখে ফেলা হতো, বলিউডে কয়েকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের দেশে সেসব তো দূরের কথা, মাহবুবের নামটা পর্যন্ত পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। আমরা কি তবে এতটাই অকৃতজ্ঞ জাতি?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন