সাঈদীর মামলার বাদী ও একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কষ্ট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাহবুবুল আলম হাওলাদার, একাত্তরের যোদ্ধা। তবে যুদ্ধটা তার শেষ হয় নি আজও, এখনো যুদ্ধ করেই যাচ্ছেন তিনি। একাত্তর শেষ হলেও একাত্তরের কিছু বিষাক্ত বীজ রয়ে গিয়েছিল দেশে, যারা একাত্তরে এদেশটা জন্মযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দেশটাকে নরক করে তুলেছিল। ঘৃণ্য সেই মানুষ নামক জন্তুদের এদেশে পুনর্বাসন হয়েছে, কারো কারো গাড়িতে পতাকা উঠেছে, কি আশ্চর্য এক প্রহসন!
এই যুদ্ধপরাধী ও নরকের সন্তানদের বিচার কার্যক্রমেও বাধা এসেছে বারবার। মাহবুবুল আলম হাওলাদারও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বাধা তিনি পাবেন ই বা কেন? এমন এক লোকের বিরুদ্ধে মাহবুবুল মামলার বাদী হয়েছেন, যাকে অনেকে অন্ধ বিশ্বাসে ভক্তি করে, যার মুখের ছবি চাঁদের পানে তাকিয়ে দেখতে পায়। বলছি মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধপরাধ মামলায় দন্ডিত আসামী দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর কথা।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় বাদী হয়ে শুরু থেকেই দেশ বিদেশ থেকে অগণিত হুমকি পেয়েছেন। তবুও লড়াইটা ছাড়েন নি। কারণ, নিজ চোখে দেখেছেন তিনি একাত্তরের সেই দৃশ্যগুলো। মাহবুবুল একাত্তরে সুন্দরবন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ দিতেন। দেখতেন, পারেরহাট বন্দরে সাঈদীর নেতৃত্বে কিভাবে লুটপাট চলতো।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার বলেন, সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাঈদীর ইন্ধনে বিসা বালী নামের একজনকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এমনকি মাহবুবুলের নিজ বাড়িতেই সাঈদী পাকিস্থানি সেনাদের নিয়ে যায়। সেখানে মাহবুবুলের বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করা হয়। এরপর সাঈদী নগদ টাকা লুট ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যায় ও পরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
জোর করে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা, পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা রানীকে ধরে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করা, পারেরহাটে ভানু সাহাকে ধর্ষণ করা সহ সাঈদীর নেতৃত্বে অপরাধের খতিয়ান অনেক কিছুই জানা আছে, দেখা আছে মাহবুবুলের।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার তাই ছিলেন সাঈদীর মামলার বাদী ও প্রধান স্বাক্ষী যে মামলায় সাঈদী এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত।
যে মানুষটা একাত্তরের বিষ নামাতে এতোগুলো বছর লড়াই করলেন, গুজবতান্ত্রিক দেশে সাঈদীর মতো এক ফিগার যার অন্ধভক্তের সংখ্যাও অনেক বেশি, সেই ফিগারের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মামলা চালিয়ে গেলেন -- বিনিময়ে কি পেলেন মাহবুবুল আলম হাওলাদার? এখন তিনি প্রায় নিঃস্ব। গত ৪ বছরে ৮ লাখ ঋণ হয়ে গেছে তার। ঢাকায় ঘুরছেন ১৩/১৪ দিন ধরে। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায় তার এই শহরে আসা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজের দুঃখের কথা বলতে চান। কিন্তু সুযোগ মিলছে না!
সাবেক এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খুব ব্যথিত হৃদয় নিয়ে নিজের কথা বলেন প্রথম আলোতে। তিনি বলেন, "আমার আয় বলতে ১২ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। আমি ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগী। সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এই টাকায় আমার সংসার, সন্তানদের পড়ালেখা চলছে না। কিন্তু লোকলজ্জায় কাউকে বলতেও পারি না।"
কতটা কষ্ট তিনি পেয়েছেন, পাচ্ছেন, কত কষ্টে চলছে তার জীবন তা বোঝা যায় এই কথাতেই- "হাজার যন্ত্রণার চেয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মারা যাওয়া অনেক ভালো ছিল। আমি মানুষের মতো বাঁচতে চাই।"
সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় লড়ে তার জীবনটা এক দুর্বিষহ চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৩ সালে ২৮ অক্টোবর তাঁর পিরোজপুরের ইন্দুরকানির বাড়িতে জামায়াত-শিবিরের লোকজন হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। রাষ্ট্র তখন নিরাপত্তার জন্যে পুলিশ দেয়। তাতে জীবন আরো কঠিনই হয়েছে। চলাফেরার স্বাধীনতা কমেছে। সামাজিক যোগাযোগ কমেছে। দেশবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়ে যেখানে তার বীরের মতো শ্রদ্ধা পাওয়ার কথা, বুক ফুলিয়ে চলবার কথা সেখানে তাকে থাকতে হচ্ছে নতজানু হয়ে। হয়ত তাই মাহবুবুল ভাবেন, এত কষ্টের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই মরে যাওয়া ভাল ছিল তার।
তিনি বলেন, " নিরাপত্তার জন্য চারজন পুলিশ থাকে। ঘরের লোকদের গোপনীয়তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা বলতে কিছু আর নেই। পুলিশ ছাড়া কোথাও বের হওয়া যায় না। সামান্য বাজার করতে গেলেও সঙ্গে পুলিশ নিতে হয়। যেখানে হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানে দুইটা রিকশা নিতে হয়। তাতে মাসে যাতায়াত খরচ হয় অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আমার এই যন্ত্রণা কে দেখবে?"
সত্যিই এই যন্ত্রণা দেখার কেউ নেই। এইদেশে চেতনাসেবী, চেতনাজীবী বহু লোক গজিয়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো, নয়া নয়া তাদের শইল্লে ভাব এসেছে। নিজেদের আওয়ামীলীগার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এসব দাবি করতে ব্যস্ত কিন্তু কোনো আদর্শের ছিটেফোঁটা তাদের কাজে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। তবুও তাদেরই জয় জয়কার আর মাহবুবুল আলম হাওলাদারের মতো মানুষের দুর্দশা।
মাহবুবুল তার যাপিত জীবনের দূর্ভোগের কথা বলতে চেয়েছেন অনেকের কাছে। সাংসদ, মন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগ নেতা- কেউ তার যন্ত্রণার জায়গাটি লাঘবে উদ্যোগ নেয় নি, সবাই কেবল আশ্বাস দিয়ে গেছে। কেউ কেউ তো দিনের আলোয় আওয়ামীলীগ, রাতে জামাত বিএনপির সাথে মিশে যায়। তাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলেও বিরাগভাজন হয়েছেন এই মানুষটা।
আজ তিনি শহরে, কেউ শোনেনি তার কথা। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার চেষ্টায় আকুল তিনি। এসেছেন আগেও বহুবার। সাক্ষাৎ পান নি।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার বলেন, "এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ বার ঢাকায় এসেছি। অফিশিয়ালি বলেছি, চিকিৎসা ও দাপ্তরিক কাজে আমি ঢাকা যাচ্ছি। কিন্তু এসেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ঢাকায় যাতায়াত খরচই হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছি।"
জানি না, কেন এই মানুষটা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না, কোথায় তাকে বাধা দেয়া হচ্ছে, কেন বারবার ব্যর্থ মন নিয়ে তাকে ফিরতে হচ্ছে...কিন্তু, এই ব্যর্থতা তার ব্যর্থতা না, এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, লজ্জা। যে মানুষটা দেশের জাতীয় লজ্জাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন, তাকে কেন এভাবে লজ্জিত করা হচ্ছে বার বার, এটাই আমাদের প্রশ্ন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাহবুবুল আলম হাওলাদারের কথাগুলো আপনি শুনবেন কি প্লিজ? তিনি খুব বেশি কিছু চান না, মানুষের মতো বাঁচতে চান আর কটা দিন। তাকে বাঁচার উপায় করে দিন প্লিজ...