চার্লি, মালায়ালাম 'হিমু' কিংবা একটি আনন্দময় ভুবনের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

হিমুর সাথে চাইলে এই চরিত্রকে মেলাতে পারেন, অথবা হিমুর চেয়েও বেশি প্রেমে পড়ে যেতে পারেন চার্লির উপর। চার্লি আসলে একটি অনুপ্রেরণার নাম, চার্লি একটি আনন্দময় ভুবনের গল্প!
হিমু সিরিজের প্রথম বই ময়ূরাক্ষী। বইয়ের কয়েকটা লাইন থেকেই আমরা হিমুর চিরায়ত চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ধরতে পারি। হিমু যে মহাপুরুষ হতে চায় বলে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো সবার সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখে, বিশেষ করে রুপার সাথে। মহাপুরুষরা প্রেমের মতো তুচ্ছ বিষয়ে জড়িয়ে সময় নষ্ট করে না। তবুও রুপা তার জন্য অপেক্ষা করে। বইয়ে হিমুর জবানিতে লেখা কটি লাইন উদ্ধৃত করি- "রূপা, তুমি কি এক্ষুনি নীল রঙ্গের একটা শাড়ি পরে তোমাদের ছাদে উঠে কার্নিশ ধরে নিচের দিকে তাকাবে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একটুখানি দাঁড়াও। আমি তোমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাব... আমি জানি, রূপা আমার কথা বিশ্বাস করে না, তবুও যত্ন করে শাড়ি পরে। চুল বাঁধে। চোখে কাজলের ছোঁয়া লাগিয়ে ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়ায়। সে অপেক্ষা করে। আমি কখনো যাই না.."
হিমু এক পরিব্রাজক, যে মানুষকে চমকে দিতে ভালবাসে। যার সিক্সথ সেন্স প্রবল, যার কিছু কিছু ভক্ত আছে যারা তাকে হিমু ভাই বলতে পাগল। এই চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের সবচাইতে জনপ্রিয় কর্মগুলোর একটি। কত তরুণ হিমুর মতো উদাসীন হতে চেয়েছে, খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে চেয়েছে। হিমুর প্রভাব এখনো কাটেনি অনেকের অবচেতন মন থেকে। বইয়ে পড়া এই চরিত্রকে শর্ট ফিল্ম, নাটকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু মনের মতো হয়নি হিমুর দৃশ্যায়ণ।
সম্ভবত এই কারণে ২০১৫ সালে যখন মালায়ালাম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে 'চার্লি' নামক অসাধারণ একটি সিনেমা মুক্তি পেল, আমাদের দেশের অনেক দর্শক সেই চার্লি চরিত্রে হিমুর ছায়া খুঁজে বেরিয়েছেন। মিল খুঁজে ফিরেছেন। যদিও চার্লির সাথে হিমুকে পুরোপুরি মেলানো যায় না। চার্লি চরিত্রটি মহাপুরুষ হবার সাধনা করে না, বরং জীবনকে বিবিধ নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের মতো যাপন করার পথ খুঁজে নেয়। চার্লির কাছে প্রতিটা মুহুর্ত উপভোগ করাই জীবনের মূল উপজীব্য। আজকের লেখাটি মালায়ালাম মাস্টারপিস এই সিনেমাকে নিয়েই। চার্লি চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুলকার সালমান। দুলকারের নিঃসন্দেহে সেরা কাজগুলোর একটি এটি, ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচাইতে প্রিয় সিনেমার তালিকায় উপরে আছে তো বটেই। মাস্টারপিস এই সিনেমার গল্প, চরিত্র, সিনেম্যাটোগ্রাফি সবকিছুই এতো অমানুষিক সুন্দর যে এই সিনেমা এখনো মন ছুঁয়ে আছে। এই সিনেমার রেশ এখনো যায়নি মন ও মগজ থেকে। চার্লির জীবনের মতো হয়ত আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জীবন হয় না, কিন্তু, জীবনের বোধ - লক্ষ্য - আনন্দে বাঁচার মন্ত্র শেখা যায় চার্লির কাছ থেকে।
আমাদের জীবনের লক্ষ্য কি আসলে? এই সিনেমায় জীবনের অন্য একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায়। সিনেমা দেখে ভাবতে হয় এভাবেও জীবনকে উপভোগ করা যায়। দুলকার এই সিনেমায় এত জীবন্ত, প্রাণবন্ত ছিলেন যে তা মনে হতেই পারে ইশশ, ইফ আই কুড বি লাইক চার্লি! বাংলাদেশে অনেকে যেমন হুমায়ূন আহমেদের হিমু পড়ে হিমুর মতো হতে চায়, অনেকটা তেমন ঘরানার আকাঙ্ক্ষিত চরিত্র চার্লি। হিমু কিংবা চার্লি দুইটি চরিত্রই বাউণ্ডুলে কিন্তু খুব বেশি মিল আসলে নেই তাদের। চার্লি ভবঘুরে হলেও তার জীবন মিনিংফুল, সে সবসময়ই কিছু না কিছু খুঁজে বেড়ায় জীবন থেকে। তার আসলে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সে গ্রামার মেনে জীবনকে দেখে না।

সিনেমার শুরুর দিকে দেখা যায়, টেসা নামক চরিত্র যে চরিত্রে পার্বতী অভিনয় করেছেন তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন। টেসা চরিত্রটিও সময়ের স্রোতে গাঁ না ভাসানো স্বাধীন নারীর চরিত্র। যে চায় না মনের বিরুদ্ধে ঘর সংসার করে জীবন একঘেয়ে হয়ে যাক। টেসা একটি ঘর ভাড়া নেয়। পুরানো এই ঘরে আগে যিনি থাকতেন, তার অনেক সরঞ্জাম পড়ে থাকে। এগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে টেসা পায় দুইটা কমিক বই। এই কমিক বই থেকেই চার্লির গল্পটা বুঝতে পারে সে। চার্লিই আগে এই ঘরটাতে থাকত। কিন্তু, কমিক বইয়ে সম্পুর্ণ গল্প নেই। চার্লির গল্প টেসার এতই ইন্টেরেস্টিং মনে হয়েছে যে, সে চার্লিকে খুঁজতে অনেক চেষ্টা করে। চার্লি কোথায় কোথায় গিয়েছে, কাদের সাথে সময় কাটিয়েছে খুঁজতে থাকে সে। কিন্তু একটুর জন্য চার্লির সাথে দেখা হয় না তার। কিন্তু, সে হতাশ হয় না। চেষ্টা চালিয়েই যায়।
অন্যদিকে চার্লির জীবনও দেখানো হয়। চোরের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। দুইজন মিলে বের হয় চুরি করার উদ্দেশ্যে! এখানে হিমুর সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। হিমু যেমন মাস্তানদের কাছ থেকেও সম্মান পায়, মিশে যেতে পারে তাদের সাথে চার্লিও তেমন। আমরা দেখতে পাই, আত্মহত্যা করতে চাওয়া নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চার্লি। যে নারী বয়ফ্রেন্ড দ্বারা প্রতারিত হয়ে জীবনের মানে হারিয়ে ফেলেছিল, তাকে আবার নতুন জীবনের খোঁজ দেয় চার্লি। এখানে হিমুর সাথে আবার অমিল চার্লির। হিমু প্রায় সব ক্ষেত্রেই মানুষের সমস্যা নিয়ে হাসি তামাশা করে। হিমু চায় তার প্রভাব দিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে। হিমুর মধ্যে সারকাস্টিক একটা ব্যাপার থাকে সবসময়ই। চার্লি এদিক থেকে অনেকটা আলাদা। আবার বৃদ্ধদের সাথে সময় কাটায়। তাদের আনন্দে রাখে। এখানকার এক বৃদ্ধ আবার শৈশবের প্রেম বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিল। চার্লি সেই বৃদ্ধকেও সারপ্রাইজ দেয় অন্যরকম এক আয়োজন করে।
হিমুর মধ্যেও এই ব্যাপারটা আছে। হিমু মানুষকে সারপ্রাইজ করে দিতে ভীষণ পছন্দ করে। হুট করে আনন্দ বিলাতে তার ভাল লাগে। রিকশাওয়ালাকে ৫০০ টাকার নোট দিয়ে সারপ্রাইজ দেয়ার প্রবল ক্ষমতা হিমুর মধ্যে বিরাজ করে। মানুষকে অবাক করে দিয়ে হিমু আনন্দ পায়। যাইহোক, এই পুরো যাত্রায় টেসাও জড়িয়ে পড়ে চার্লিকে খুঁজতে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত চার্লির সাথে দেখা হবে টেসার? হিমুর সাথে যেমন রুপার দেখা হবে হবে করেও হয় না, প্রেম হয়ে গেছে গেছে মনে হলেও হয় না, দূরত্ব থেকে যায়, চার্লির সাথে টেসারও কি তেমন হবে? যারা সিনেমাটি দেখেছেন তারা তো জানেন, যারা জানেননি, তারা উত্তরটি খুঁজে নেবেন সিনেমা থেকেই। উত্তরের সাথে সাথে জীবন সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নও আপনার সামনে হাজির হবে। কেমন জীবন আপনি চান, এই প্রশ্নও হয়ত মাথায় ঘুরবে, হয়ত কিছুক্ষণের জন্য ইচ্ছে হবে চার্লির মতো হয়ে যেতে, তবে অনেকটাক্ষণ আপনার মাথায় ঘুরতে থাকবে গল্পটি।
এই গোটা সিনেমা দেখতে গিয়ে মুখে আপনার হাসি থাকবে, অদ্ভুত শান্তির একটা অনুভূতি তৈরি হবে। যদি আপনি বিষাদগ্রস্ত হন, তাহলে সিনেমা দেখার পর আপনার মনে হবে বিষাদের এই বেড়াজালে নিজেকে বন্দী করে রাখার মানে নেই। আপনার মধ্যে মুক্তির স্বাধ জাগবে, আপনি আনন্দের সন্ধান খুঁজে পাবেন। সুখের সংজ্ঞা নতুন করে উপলব্ধি হবে আপনার। হিমুর সাথে চাইলে এই চরিত্রকে মেলাতে পারেন, অথবা হিমুর চেয়েও বেশি প্রেমে পড়ে যেতেন চার্লির উপর। চার্লি আসলে একটি অনুপ্রেরণার নাম, চার্লি একটি আনন্দময় ভুবনের গল্প!