সম্প্রতি এক ফেসবুক লাইভে আসার কথা ছিলো মামুনুলের। কিন্তু তিনি আসতে পারেননি স্ত্রী'র শারিরীক অসুস্থতায়। লাইভে কেন আসেননি মামুনুল, তা নিয়ে সেই লাইভের হোস্ট তাকে করলেন তীব্র আক্রমণ...

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের তারকা মামুনুল ইসলামের সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট দেখে মন খারাপ অনেকেরই হয়েছে। নট আউট নোমান' নামের এক পেইজে তাকে লাইভে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সেই লাইভে যুক্তও হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে তার স্ত্রী'র প্যানিক এ্যাটাক হয়। তখন মামুনুল তার স্ত্রী'কে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চলে যান। এবং সেই লাইভে তিনি আর যোগ দিতে পারেননি। ব্যাপারটি তিনি 'নট আউট নোমান' পেইজের সেই হোস্টকে জানানও। কিন্তু সেই হোস্ট লাইভ এসে তাকে 'আনপ্রফেশনাল' বলে উল্লেখ করেন।

মামুনুল আক্ষেপই করলেন তার ফেসবুক পোস্টে। বললেন- বেশ কিছুদিন আগে জামাল ভূঁইয়াও এভাবে লাইভে আসতে চেয়ে পারেননি, লা লীগার এক্সপার্ট অপিনিয়ন দেয়ার জন্যে তাকে ডাকা হয়, তাই। মামুনুলের আক্ষেপ, ইমার্জেন্সি তো আসতেই পারে। পরিবারের দিকে না তাকিয়ে এখন কী তার লাইভে আসা উচিত ছিলো? মামুনুলের কথার আক্ষেপ বুঝতে পারছিলাম। কথাগুলো মেনেও নিচ্ছিলাম। কিন্তু মামুনুলের পোস্টের শেষ লাইনটা যেন বুকে ধাক্কা দিলো একটা-

আমার মনে হয় আমাদের ফুটবলারদের উপর দোষ চাপানোটা একটু বেশিই সহজ।

এই লাইনটির বিশ্লেষণে পরে আসবো। এর আগে একটু 'নক আউট নোমান' পেইজটি নিয়ে জানাই। এই পেইজ ঘুরে যা বোঝা গেলো, পেইজের যিনি ক্রিয়েটর তিনি ইদানীং বেশকিছু সফল লাইভ করেছেন। সে লাইভে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অতীতের, বর্তমানের অনেক তারকাই এসেছেন৷ উৎপল শুভ্র, দেব চৌধুরীর মত সেলিব্রেটি স্পোর্টস জার্নালিস্টদেরও দেখা গিয়েছে তার লাইভে। তাছাড়া হোস্ট নিজেও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী কন্টেন্ট বানানোর চেষ্টা করেন। মেসির দলবদলের নাটক নিয়ে তিনি ক্রমাগতই ভিডিও বানিয়েছেন। সাকিব আল হাসানের সমালোচনা করেও ভিডিও বানিয়েছেন তিনি। ঘুরতে ঘুরতে মামুনুলের আক্ষেপ যে কথা নিয়ে সে কথার ভিডিওটুকুও তার পেইজে পেলাম। সেখানে তিনি একরকম তাচ্ছিল্য করেই কথা বললেন মামুনুলকে। বললেন- সন্ধ্যায় টেস্ট রান করার পরেই মামুনুল লাপাত্তা হয়ে যান। দশটার লাইভ তাই সাড়ে দশটায় নেন, সাড়ে দশটার লাইভ এগারোটায় নেন। কিন্তু মামুনুল আর আসেননি। তারপর বলেন-


নো ওয়ান্ডার, বাংলাদেশ ফুটবল টীমের র‍্যাংকিং যে ২০০ এর কাছাকাছি যাচ্ছে। প্রফেশনালিজম এর জায়গাতেই তীব্র ঘাটতি আছে তাদের।

মামুনুলের ঐ কথাটিতে ফিরে আসি আবার। বাংলাদেশের ফুটবলারদের উপর দোষ চাপানো যে খুবই সহজ... এই কথাটি আসলে তীব্র আক্ষেপের ও নিদারুণ বাস্তবতারও । মাসের পর মাস দর্শকবিহীন মাঠ, তীব্র অন্তর্কোন্দল ও রাজনীতি, বছর বছর কোচ পরিবর্তন ও র‍্যাংকিং এ ক্রমশ নীচের দিকে নামা... আমরা তো এই মানুষগুলিকে কোনোদিন উৎসাহও দেইনি যে- খেলেন আপনারা, আমরা মাঠে আছি। মেসি, রোনালদো, বার্সা, রিয়াল নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা মুখের ফেনা তুলে ফেলেছি নিয়মিত। বার্তামেউ'কে নিয়ে চাইলে হাজার হাজার শব্দ লিখে ফেলতে পারবো। অথচ, ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে এক লাইনও জানি কিনা সন্দেহ। বলছিনা, আমাদের ফুটবল টীম নিয়ে আমরা আদিখ্যেতা করলেই তারা একেবারে র‍্যাংকিং এর টপ টীম হয়ে যেতো। সেটা হয়ও না। কিন্তু আমাদের একটু সমর্থনেও তারা অনেকটু ভরসা পেতো। ভাবতো, ষোলকোটি মানুষ তাদের সাথে আছে। যতকিছুই বলি না কেন, এই টীমটা তো আমাদেরই। বাংলাদেশেরই।  

যাদের জার্সির বুকে বাংলাদেশেরই পতাকা, আমরা তাদেরই ভুলে গিয়েছি ক্রমাগত। শুধু ভুলিইনি, নির্লজ্জের মত আক্রমনও করেছি প্রতিনিয়ত। একজন অজ্ঞাত হোস্ট এসে তাচ্ছিল্যভরা গলাতেই তাই বলতে পারেন- এ কারণেই এদের র‍্যাংকিং এর এই অবস্থা! প্রফেশনালিজমের অভাব!  আমি এই নোমানকে দোষও দিতে পারিনা ঠিক। কারণ আমরা প্রত্যেকেই এই নোমান। আমরা এদের সারাবছর খোঁজ রাখি না। কিন্তু যখন এদের কোনো খারাপ সংবাদ পাই, অমনি হরিলুটের বাতাসার মতন সবার আগে ট্রল করতে ছুটে আসি। র‍্যাংকিং এর খোঁচাসহ অন্যান্য কিছু বলতেও পিছপা হই না। ট্রল করতে করতে তাদের পরিবার পর্যন্তও টেনে নিয়ে যাই পুরো নোংরামিকে। নোংরা ইঙ্গিতে বিষিয়ে তুলি তাদের ভার্চুয়াল জীবন।

আমি জানি না, মামুনুল তার স্ত্রী'র সংবাদটি জানিয়েছিলেন কি না নোমানকে। আমি ধরেই  নিলাম, তিনি জানাননি। নোমানের নিশ্চয়ই উচিত ছিলো, আগে ঘটনা কী, সেটা জেনে নেওয়া। না জেনে তিনি যেটা করলেন অনলাইনে, সেটিকে নেগেটিভ পাবলিসিটির জন্যে সস্তা স্টান্টবাজি যদি আমি বলি, সেটা কি ভুল হবে? একটা মানুষের ইমার্জেন্সি কি আসতে পারে না? সেটির জন্যে তাকে পার্সোনাল এ্যাটাক করা, ক্যারিয়ার নিয়ে কটাক্ষ করা কোন পর্যায়ের অভদ্রতাতে পড়ে, আমি জানি না।

মামুনুলের কথার সূত্র ধরেই বলি, এ দেশে ফুটবলারদের আসলেই সব কথা বলা যায়। কারণ এদের পাওয়ার নেই, গ্ল্যামার নেই, টাকাপয়সাও নেই। রাস্তায় এদের গালি দিলে এরা কিছুই করতে পারবে না। অথচ একজন ক্রিকেটারকে বা একজন সাংসদ'কে নিয়ে কেউ বলে দেখুক লাইভে এসে এই কথা... বাকিটা বোধহয় না বললেও চলে।

মামুনুলের কথাটি আসলে আমাদের গালে থাপ্পড় দেয়ার মতই৷ আমার মনে হয় আমাদের ফুটবলারদের উপর দোষ চাপানোটা একটু বেশিই সহজ... এই কথাটি বলে তিনি এতকাল ধরে তাদের উদ্দেশ্যে বলে আসা প্রত্যেকটা নোংরা কথার সম্মিলিত অভিমানকেই লিখে দিলেন এক লাইনে। যে লাইনের কোন সঠিক প্রত্যুত্তরও নেই আমাদের কাছে।

আমরা লজ্জিত, মামুনুল। আপনাদেরকে আমরা কোনোদিন সম্মান করতে পারিনি, আপনাদের খবরও নিতে পারিনি, উৎসাহ দেয়া তো দূরেই থাকুক। যেটা পেরেছি, নিয়মিতভাবে তীব্র অপমান করতে পেরেছি। আসলে এটাই আমরা পারি। খুব ভালোভাবেই পারি। এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য।

আমাদের ক্ষমা করবেন না। উচিত হবে না।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা