মনপুরা দ্বীপটা বিখ্যাত হয়েছে সিনেমা মুক্তির পরে। এখন তো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের গন্তব্যস্থলেও পরিণত হয়েছে জায়গাটা। কিন্ত আসলেই কি সেটা বেড়ানোর মতো চমৎকার জায়গা?
প্রথমেই দুঃখিত, এমন শিরোনামের জন্য। তবে আমার কাছে সত্যিই মনপুরা দ্বীপ না যাওয়ার মতো পাঁচটা কারণ আছে।
১। মনপুরা দ্বীপ বেশি আলোচিত হয় গিয়াসউদ্দিন সেলিমের "মনপুরা" সিনেমার পর। এই দ্বীপের নাম সারা বাংলাদেশের মানুষ জেনে যায়। মনপুরা দ্বীপের যে অংশে সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল সেটা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা ছিল। কিন্তু, দুঃখের বিষয় আমরা দ্বীপে গিয়ে স্থানীয় বাইকারের কাছে জানলাম, ওই জায়গাটা নদীর ভাঙ্গণে বিলীন৷
২। মনপুরা দ্বীপের আরো একটি আকর্ষণ ছিল চৌধুরী প্রজেক্ট। নদীর ভাঙ্গণ আর ঘূর্ণিঝড়ে এই প্রজেক্টটিও ক্ষতিগ্রস্থ। আগে অনেক পর্যটক এখানে ক্যাম্পিং করতো। এখন এই প্রজেক্টটার নাকি অবস্থা খারাপ।
৩। ছোট দ্বীপ। পর্যটকের আনাগোনা খুব একটা থাকে না। ফলে, পর্যটক দেখলেই এখানকার ব্যবসায়ীরা কিছুটা বাড়তি দাম রাখার চেষ্টা করে। যেটা ভীষণ দৃষ্টিকটু৷ সবচেয়ে বড় ধরাটা খেতে হয়েছে বাইকারদের কাছে। সকাল বেলা লঞ্চ থেকে নামার পর দুইজন এসে পীড়াপীড়ি শুরু করে। তারা পুরা দ্বীপ ঘুরিয়ে দেখাবে। এ বছরের জানুয়ারি মাসের কথা। তখন প্রচন্ড কুয়াশা। আমরা বাইক নিতে চাইলাম না। তবুও জোরাজুরি করলো ওরা। ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম, বললো, আপনারাও স্টুডেন্ট, আমরাও স্টুডেন্ট। ভাড়া সমস্যা হবে না৷ তাও বলে নেয়া ভাল, বললাম। তারা বললো, যা খুশি দিতে। আমরা ভাবলাম কতই না অতিথিপরায়ণ।
সর্বোচ্চ দুই-আড়াই ঘন্টা ঘুরেছি। তারমধ্যে স্পটেই সময় নষ্ট করেছি ১৫/২০ মিনিট করে৷ তারা এই অল্পসময়ের জন্যই দুই বাইক দুই হাজার টাকা দাবি করে৷ যেটা মারাত্মক অন্যায্য মনে হয়েছে।
৪। থাকার ভাল জায়গা নেই। এই দ্বীপ পর্যটকদের দিয়ে টাকা উপার্জন করতে পারে এমন ভাবনা বোধহয় কারো মাথায় ছিল না কখনো। অল্প দুই একটা হোটেল যা আছে, তা আসলে খুব একটা ভাল লাগেনি। ভাল মানে এই না খুব আহামরি কিছু হতে হবে। ওইটুকুও ভাল মনে হয়নি। তাই রাতে থাকিইনি।
৫। হরিণ, অতিথি পাখি এসব নাকি দেখা যায় এই দ্বীপে। কিন্তু, স্থানীয় মানুষরাই নাকি হরিণ মেরে সাফা করে দিয়েছে, এখন খুব বেশি হরিণ নেই। যা আছে সেগুলোও খুব একটা চোখে পড়বে না, নিতান্ত ভাগ্য ভাল না হলে হরিণ দেখার সাধ অপূর্ণই থাকবে। শীতে গিয়েও সেই অর্থে কোনো অতিথি পাখি চোখে পড়েনি। তাই, শীত আসছে বলে হরিণ, অতিথি পাখির লোভে মনপুরায় না যাওয়াই ভাল।
তবে.... হ্যাঁ, তবে মনপুরায় যাওয়া যায়। তবুও যাওয়া যায়। আমার দেখা সেরা নিরিবিলি জায়গাগুলোর তালিকা করলে মনপুরা উপরের দিকেই থাকবে। শহরের বাইরে কম খরচে একটু দূরে নির্জনে কিছুটা সময় পার করতে চাইলে, একটা বোরিং উইকেন্ডের শেষে হুটহাট একটু ঘুরে আসতে ইচ্ছে হলে মনপুরা খুব একটা খারাপ জায়গা না।
ইট-কাঠের শহরে ভোরের সূর্যোদয়ের স্নিগ্ধতা উপভোগ করার কোনো সুযোগ নেই। মনপুরায় আঁধার-কাটা আলোর সকাল দেখে সন্ধ্যায় সূর্যবিদায়ের রক্তিমক্ষণকেও খুব কাছাকাছি থেকে উপভোগ করা যাবে। যদিও সন্ধ্যা দেখিনি আমি। কিন্তু, সাগরপাড়ে নির্জনে বসে একটা সন্ধ্যা পার করে দিলে খুব যে একটা খারাপ লাগবে তা নয়, বরং শীতের বিকেলে হিম হাওয়ায় মন দিল খারাপ থাকলে ভালও হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলাটির নাম ভোলা। ভোলা সদর থেকে দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গপসাগরের কাছে মেঘনার কোল ঘেঁষে ভোলার মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে জেগে উঠা দ্বীপটিই হচ্ছে মনপুরা দ্বীপ। সাগরের ছোয়ায় থাকা এ দ্বীপকে অনেকে ‘সাগরকন্যা’ বলেও ডাকেন। লোকমুখে প্রচলিত মনপুরা ৮০০ বছরের পুরাতন দ্বীপ। পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল এখানে।
প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এখনো অতটা জনপ্রিয়তা না পেলেও রূপ-লাবণ্য দিয়ে পর্যটকদের মন কেড়ে নেওয়ার যথেষ্ট উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মনপুরায়। আপনি এই দ্বীপের সবচেয়ে সেরা সৌন্দর্য যদি উপভোগ করতে চান, তাহলে সাইকেল নিয়ে যেতে হবে। নিজের মতো করে ধীর স্থিরভাবে পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে পারবেন। কোনো যাতায়াত খরচ লাগবে না বাড়তি, তারচেয়েও বড় কথা এই দ্বীপে সাইকেল চালিয়ে অদ্ভুত আরাম পাবেন নিশ্চিত। রাস্তাঘাট এতো সুন্দর আর ফাঁকা যে সাইকেলপ্রেমীদের জন্য স্বর্গীয় সড়ক। সাইকেলে চড়ে ধীরে ধীরে এই দ্বীপটাকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করবেন।
মনপুরা দ্বীপ হলেও অন্যান্য দ্বীপ থেকে এর বৈশিষ্ট্য কিছুটা আলাদা। চারিদিকের সবুজ গাছপালা এতই বেশি যে একে প্রথমে দেখলে ঠিক চর মনে হবে না। এখানে রয়েছে হাজার হাজার একর জায়গাজুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সংখ্যা কোটি-ছাড়িয়ে।
উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়ন ক্রসডেম এলাকা এবং ৪নং দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়ন ম্যানগ্রোভ বনকে এখানকার মানুষরা বলে থাকেন হরিনের অভয়াশ্রম! এখানে নাকি প্রায় সবসময়ই হরিণের দেখা মিলতো একসময়। এখন আর সেই দিন নেই যদিও। তবুও মাঝে মধ্যে ভাগ্য সহায় থাকলে হরিণের ঝাঁক দেখা যায়। বনের একটু গহীনে যাওয়ার সাহস থাকলে আরো সুন্দর সুন্দর কিছু নাম না জানা পাখির ডাক শুনতে পারবেন। এছাড়া বানর, ভালুকসহ আরো কিছু বন্য প্রাণীর দেখাও পাওয়া যেতে পারে।
সী-ট্রাকসহ অন্যান্য যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার নোঙ্গরের জন্যে একটি ল্যান্ডিং স্টেশন আছে মনপুরায়। আমরা সকালে শুরুতেই সেই ল্যান্ডিং স্টেশনে গিয়েছিলাম। অদ্ভুত সুন্দর লেগেছিল, কারণ তখন কুয়াশায় চারধার ঘেরা ছিল। দ্বীপে কর্মচাঞ্চল্যের ছাপ দেখিনি। শান্ত একটা সকাল কাটিয়েছি সেখানে। যদিও ল্যান্ডিং স্টেশন কিন্তু এটিকে আপাতত কোনো কাজে লাগানো হচ্ছে না। বরং পর্যটক এবং এলাকাবাসীরা বিকেলের দিকে সাগরের উত্তাল ঢেউ দেখতে সেখানে যান। সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্যও দেখা যায় এখান থেকে।
প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়াও মনপুরার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে তিনটি বিশেষ আইটেম- খাসি পাঙ্গাশ, মহিষের দুধের কাঁচা দই ও শীতের হাঁস। হাঁসের মাংস অন্য কোথাও গিয়ে আমি এতো এভেইলেবল দেখিনি। এখানে প্রায় প্রত্যেকটা খাবার দোকানে এই আইটেম আছে৷ হাঁসের মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার সেরেছিলাম আমরা। খাবারের বিলটা অবশ্য বেশি আসেনি৷ মহিষের দই বিকেলে পাওয়ার কথা ছিল, বিকাল পর্যন্ত থাকিনি বলে খেতে পারিনি। তবে, কেউ গেলে এই দই অবশ্যই চেখে আসা উচিত। এছাড়া মেঘনার টাটকা ইলিশের সুব্যবস্থা তো আছেই।
স্থানীয়দের মতে, এখানকার খাঁটি দুধ খেয়ে আর রূপে মুগ্ধ হয়ে মন ভরে যেত মানুষের। তাই এর নামকরণ হয়েছে মনপুরা। এখানকার সাধারণ মানুষগুলো বেশ সাধারণই। তারা বেশ ভাল। কথা বললে খুশি হয়। জানতে চায় অনেক কথা। মজা পেয়েছি অন্য জায়গায়। মনপুরা বরিশাল বিভাগে পড়লেও এখানকার ভাষা অনেকটা নোয়াখালি অঞ্চলের মতো!
যাই হোক, মনপুরায় যেতে চাইলে, ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রতিদিন দুইটা করে লঞ্চ থাকে মনপুরায় যাবার জন্য। বিকেল ৫.৩০ ও ৬.৩০ মিনিটে দুটি লঞ্চ থাকে। ভাড়া এখন বোধহয় ডেকে ৩৫০ টাকা। আমরা গিয়েছিলাম ১৫০ টাকায়। কেবিনও নেয়া যায়।
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে মনপুরা এখনো জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থার দুরবস্থা। নদীপথে যাওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ। আজ সন্ধ্যায় উঠলে, কাল সকাল ছয়টা, সাতটায় নামতে হবে এমন। আমরা যখন গিয়েছি তখন লঞ্চ ঘাট করার মতো একটা লঞ্চ ঘাটও ছিল না। লঞ্চঘাটও নাকি নদীর ভাঙ্গণে বিলীন। মাটির উপর ঠেসান দিয়ে দৈত্যাকার লঞ্চ ঘাট করতে হয়েছিল। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার আশানুরূপ উন্নতি চোখে পড়েনি। বাইকই মূল ভরসা।
এখানে ভালো মানের থাকার হোটেল কিংবা মোটেলের সংখ্যা খুবই কম। তবে, রিকোমেন্ড করবো, কেউ রাতে থাকতে চাইলে ক্যাম্পিং এর ব্যবস্থা করে যেন থাকেন। এখানে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ইস্যু নেই। চোর ডাকাত, জন্তু জানোয়ারের ভয় একেবারেই নেই। তাই ক্যাম্পিং করার আদর্শ জায়গা মনপুরা দ্বীপ। তাবু খাটিয়ে আলো জ্বেলে গল্প করতে করতেই রাত কাটিয়ে দেওয়া যাবে নির্বিঘ্নে। যদি কেউ রুম নিয়ে থাকতে চান, তাহলে এই দুইটা নাম্বার টুকে রাখতে পারেন। জেলা পরিষদ ডাকবাংলো- ০১৯৩৪১৭৫৩৬৯, প্রেস ক্লাব গেষ্ট হাউস– ০১৯১-৩৯২৭৭০৬।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন