আর্জেন্টাইনদের জিজ্ঞেস করুন ম্যারাডোনা মানে কি- জবাব পাবেন, ঈশ্বর! ম্যারাডোনাকে আপনি ফুটবল প্রতিভা দিয়ে মাপতে পারবেন না, বিতর্ক দিয়ে মাপতে পারবেন না, তাকে মাপা সম্ভব নয় জনপ্রিয়তা দিয়েও। ম্যারাডোনাকে মাপতে হবে ভালোবাসা দিয়ে...

ঢাকা থেকে বুয়েন্স আয়ার্সের দূরত্ব প্রায় সতেরো হাজার কিলোমিটার। সবচেয়ে দ্রুতগামী বিমানে গেলেও ট্রানজিট মিলিয়ে দেড়দিন লেগে যায়। সেই দূরত্ব মাত্র চার মিনিটে অতিক্রম করেছিলেন ডিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। ছিয়াশির বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমে তার ঐতিহাসিক হ্যান্ড অফ গডের গোল, তারপর ছেষট্টি গজ ড্রিবল করে, একাই ছয়জনকে কাটিয়ে দেয়া বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা গোলটা- তাতে আর্জেন্টিনার সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়েছিল, আর ম্যারাডোনা নিশ্চিত করেছিলেন অমরত্ব। রঙিন টেলিভিশনে প্রথমবার বিশ্বকাপ দেখতে বসা বাংলাদেশের মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছিলেন ক্ষুদে জাদুকরের জাদু, তারা প্রেমে পড়েছিলেন ম্যারাডোনা নামের একটা মানুষের, অষ্টাদশী তরুণীর প্রথম প্রেমের মতোই অবিনাশী ছিল সেই অনুভূতি। 

বিশ্বকাপ ফুটবল এর আগে পুসকাসের হাঙ্গেরীকে দেখেছে, দেখেছে এক আসরেই তেরো গোল করা জ্যাঁ ফন্টেইনের অতিমানবীয় কীর্তি। বিশ্বকাপ দেখেছে পেলের সর্বজয়ী ব্রাজিলকে, দেখেছে হল্যান্ডের টোটাল ফুটবলের ক্যারিশমা। কিন্ত ছিয়াশিতে বিশ্বকাপ সাক্ষী হলো অন্য রকম এক অতিপ্রাকৃত নজিরের। সাক্ষী হলো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার জয়রথের, বিশ্বকাপ দেখলো, ছোটখাটো আকারের একটা মানুষ কীভাবে দলের চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারেন, একা একটা দলকে টেনে নিতে পারেন, এমন ওয়ান ম্যান শো বিশ্বকাপ এর আগে কখনও দেখেনি, ভবিষ্যতেও দেখবে না, নিশ্চিত থাকুন।

সেই বিশ্বকাপের পরে ম্যারাডোনা আর আর্জেন্টিনার রইলেন না, হয়ে গিয়েছিলেন গোটা বিশ্বের। নীল-সাদা পতাকা বুয়েন্স আয়ার্স থেকে উড়ে এলো ঢাকায়, কলকাতায়, আফ্রিকা থেকে এশিয়ায়, ছড়িয়ে পড়লো সারা বিশ্বে। গোটা একটা প্রজন্মকে তিনি ফুটবলের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন, তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছেন, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মানুষেরা ম্যারাডোনার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের ছায়া- এমন কীর্তি দুনিয়ার আর কোনো ফুটবলারের নেই। ছিয়াশির বিশ্বকাপে তারকার অভাব ছিল না। মিশেল প্লাতিনি, গ্যারি লিনেকার, জিকো- তাদের ছাপিয়ে মহাতারকা হলেন ম্যারাডোনা। রাজপুত্র হয়ে মেক্সিকোতে এসেছিলেন, রাজা হয়ে শিরোপা হাতে দেশে ফেরার বিমানে উঠেছিলেন, মাঝের সময়টায় লিখেছেন অমরত্বের মহাকাব্য। 

বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে ম্যারাডোনা

একটা মানুষ জীবনে তিনবার ড্রাগ নিয়ে ধরা পড়েছেন, নিষিদ্ধ হয়েছেন প্রতিবারই। তার মুখ চলেছে খাপখোলা তলোয়ারের মতো, যখন যা খুশি বলেছেন, কাউকে রেয়াত দেননি, ফুটবল দল থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট- কেউই বাদ যাননি বাক্যবাণ থেকে। ট্যাক্স ফাঁকির মামলায় তিনি দোষী প্রমাণিত হয়েছেন, জরিমানা হয়েছে তার। জাতীয় দলের কোচিং করাতে এসে দলকে নিয়ে ডুবেছেন, কিন্ত লোকে তাকে শুলে চড়ায়নি। গোটা জীবন মদে ডুবে ছিলেন, বিতর্কে তিনি জড়াতেন না, বরং বিতর্ক তৈরি করতেন। তার বন্ধুরাই বলতেন, শান্ত পরিবেশ ডিয়াগোর সহ্য হয় না। কোথাও কোন ঝামেলা না থাকলে ও নিজেই একটা গণ্ডগোল পাকাবে, ও এরকম মানুষ। পারিবারিক জীবনে স্থিরতা ছিল না, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বেলায় ছিল প্রবল অনীহা, দায়িত্ব নেয়ার মানুষও তিনি ছিলেন না। 

অথচ এতকিছুর পরেও এই লোকটাকে দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীরা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে। তিনি গালি দিলে সেটাকেও বেদবাক্য বলে মেনে নিয়েছে। কোন ঝামেলায় জড়ালে তারা আগেই রায় দিয়ে ফেলেছে, ম্যারাডোনা নির্দোষ, তিনি খারাপ কিছু করতেই পারেন না। আজও অজস্র মানুষ বিশ্বাস করে, তার কোকেনে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা আমেরিকা বা ফুটবল পরাশক্তিগুলোর চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। সেজন্যেই বিশ্বকাপের ফাইনালে রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে আর্জেন্টিনা হেরে গেলে রেফারির মুন্ডুপাত করে বাংলাদেশে মিছিল হয়, সেই মিছিলে রেফারির ফাঁসির দাবী তোলা হয়; অথচ ম্যারাডোনা হয়তো বাংলাদেশের নামটাও শোনেননি তখনও! এই আবেগটাকে কেউ পাগলামি বলতেই পারে, কিন্ত ভালোবাসা ব্যাপারটাই তো পাগলামি, তাই না? 

ইংল্যান্ডের সাথে তার আজন্ম শত্রুতা, না ইংরেজরা কখনও তাকে মেনে নিতে পেরেছে, না তিনি কখনও ইংরেজদের পছন্দ করেছেন। তবুও গ্যারি লিনেকার, যিনি কিনা ছিয়াশির সেই কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার অতিমানবীয় কীর্তি স্বচক্ষে দেখেছিলেন, তিনি অকপটে রায় দেন- ম্যারাডোনার চাইতে ভালো ফুটবল খেলতে কাউকে তিনি কখনও দেখেননি! লিনেকারের চোখের সামনে মেসি-রোনালদোরা মাঠ মাতাচ্ছেন, তিনি শুধু যোগ করেন- মেসি অনেকটা ডিয়াগোর মতো। কিন্ত সে ডিয়াগো নয়। কেউ ডিয়াগো হতে পারবে না। বলের ওপর ওর যে কন্ট্রোল ছিল, সেটা অবিশ্বাস্য, ও বলকে দিয়ে কথা বলাতে পারতো! 

শোকের সাগরে ভাসছে আর্জেন্টিনা

ম্যারাডোনা কে ছিলেন? ম্যারাডোনা আসলে কী ছিলেন? কারো কাছে তিনি সর্বকালের সেরা ফুটবলার, কারো কাছে শুধু দুর্দান্ত, অথবা কিংবদন্তী। কারো চোখে মাদকের প্রেমে পড়ে নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস করা একজন। কারো চোখে পাগলাটে, খেয়ালি এক চরিত্র। আর্জেন্টাইনদের জিজ্ঞেস করুন ম্যারাডোনা মানে কি- জবাব পাবেন, ঈশ্বর! বলা হতো, ঈশ্বরের উচ্চতা নাকি পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি, কারন ম্যারাডোনার উচ্চতাও সেটাই! আর্জেন্টিনায় পোপের যতটা সম্মান, ম্যারাডোনার সম্মান তার চেয়ে কম কিছু নয়, দেশের প্রেসিডেন্টের চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি নিজের দেশে। 

সেটার নমুনাও দেখা যাচ্ছে। করোনার সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ ছুটে আসছেন রাজধানীতে। গন্তব্য একটাই- বুয়েন্স আয়ার্সের প্রেসিডেন্ট প্যালেস, যেখানে ম্যারাডোনার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। এই লোকটা আর্জেন্টিনাকে অনেক কিছু দিয়েছেন, দিয়েছেন ফুটবলকে। বিদায়বেলায় তাকে শেষ শ্রদ্ধাটা দিতে তাই কার্পণ্য করছে না লোকে। অখ্যাত ইতালিয়ান ক্লাব নেপোলিকে তিনি লিগ শিরোপা জিতিয়েছিলেন, তার কারনে ইউরোপের সমীহ জাগানিয়া দল হয়ে উঠেছিল তারা। সেই নেপোলি ঘোষণা দিয়েছে নিজেদের স্টেডিয়ামের নাম ম্যারাডোনার নামে রাখার। 

আজন্ম লড়াকু ছিলেন মানুষটা। জন্ম থেকে লড়েছেন, প্রথমে দারিদ্র‍্যের সঙ্গে, তারপর পরিবেশের সঙ্গে, ফুটবলে আসার পরে প্রতিপক্ষের সঙ্গে। যত ফাউলের শিকার ম্যারাডোনা হয়েছেন, ফুটবল ইতিহাসে ম্যাচের অনুপাতে আর কাউকে সম্ভবত এত ফাউল করা হয়নি। ম্যারাডোনার খেলার ধরনটাই এমন ছিল, তার কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে হতো। স্পষ্টভাষী ছিলেন, মিডিয়ার সঙ্গে চাপা একটা লড়াই ছিল, তার লড়াই ছিল পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধেও। প্রকাশ্যেই তিনি সমাজতন্ত্রের আদর্শকে সমর্থন দিয়েছেন, তার বাহুতে খোদাই করা থাকতো চে গুয়েভারার ট্যাটু, দুই পায়ে একেঁছিলেন দুই বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর হুগো শ্যাভেজের মুখাবয়ব।

ডিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা- রিমেম্বার দ্য নেম!

তবে জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা ম্যারাডোনাকে করতে হয়েছে নিজের সঙ্গে। মাদকে ডুবে গিয়েছিলেন তিনি, সেই নেশা কাটানোর জন্য কিউবায় রিহ্যাব সেন্টারেও ভর্তি হতে হয়েছিল। যা পেয়েছেন, যা করেছেন, কোনকিছু নিয়ে ম্যারাডোনার আফসোস ছিল না কখনও। শুধু ওই মাদকের চ্যাপ্টারটা নিয়ে আফসোস করেছেন, তিনি নিজেও বুঝে গিয়েছিলেন, এই সর্বনাশের স্রোতে গা না ভাসালে উপকারটা তারই হতো, ফুটবলের হতো, তার ভক্তদের হতো। তবু দিনশেষে অনেক কিছু হারিয়ে হলেও তিনি সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছেন বিজয়ীর বেশে।

সেইসব যুদ্ধের কথা ম্যারাডোনা ভোলেননি কখনও। রগচটা, খামখেয়ালি ম্যারাডোনা জীবনের কাছে শিখতে শিখতেই দার্শনিকে পরিণত হয়েছেন ধীরে ধীরে। আল ওয়াসলের কোচ থাকার সময় সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছেন, কোন চাপ অনুভব করছেন কিনা? ম্যারাডোনা জবাব দিয়েছেন- "চাপে তো সেই লোকটা থাকে, যাকে ভোর চারটায় কাজের জন্য বাসা থেকে বের হতে হয়, দিনশেষে ঘরে ফেরার সময় একশোটা টাকাও যার আয় হয় না, যার ঘরে অভুক্ত বাচ্চারা বসে আছে বাবার অপেক্ষায়- সেটাকে আমি চাপ বলি। আমার মাথার ওপর ছাদ আছে, বাড়িতে খাবার আছে, আমি চাপে ভুগবো কেন?" যে জীবন ম্যারাডোনা ফেলে এসেছেন তার শৈশব-কৈশোরে, সেই জীবনটাকে তিনি মনে রেখেছেন শেষ দিন অবদি। 

ম্যারাডোনা যখন বিশ্বকাপের ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরেছেন মেক্সিকো সিটিতে, ফুটবল ভক্তদের মনের ভেতর আবেগের সুনামী উঠেছে। ম্যারাডোনার কান্না লাখো-কোটি ফুটবল ভক্তকে কাঁদিয়েছে। তার নিষেধাজ্ঞার খবর শুনে আত্মঘাতি হয়েছে ভক্তরা। এইসব ভালোবাসা তো মিছে নয়। ম্যারাডোনাকে আপনি ফুটবল প্রতিভা দিয়ে মাপতে পারবেন না, বিতর্ক দিয়ে মাপতে পারবেন না, তাকে মাপা সম্ভব নয় জনপ্রিয়তা দিয়েও। ম্যারাডোনাকে মাপতে হবে ভালোবাসা দিয়ে। যে পরিমাণ ভালোবাসা ম্যারাডোনা পেয়েছেন, সেটা দুনিয়ার আর কোন ফুটবলার কখনও পায়নি, এটা নির্দ্বিধায় লিখে দেয়া যাবে। ম্যারাডোনা মারা গেছেন- এটা ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য প্রযোজ্য। আসল সত্যিটা হচ্ছে, ভালবাসারা মরে না, ঈশ্বরের কোন মৃত্যু নেই। ম্যারাডোনা ছিলেন, আছেন, থাকবেন...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা