সেই ম্যাচের পরে ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটন অনেক বছর ম্যারাডোনার মুখদর্শনও করেননি। তার পরিস্কার জবাব ছিল- "একটা চোরের সাথে একসঙ্গে বসার মতো অযোগ্য এখনও আমি হইনি..."

অগ্নিগর্ভ একটা ম্যাচ! বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, মুখোমুখি দুই 'চিরশত্রু' ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা। ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে দুই দেশের লড়াইয়ের ঝাঁঝ খেলাটাকে শুধু মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সবুজ মাঠে বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা। দুই দেশের শত শত সৈন্যের মৃত্যুর বদলা নিতে যেন মাঠে নেমেছিলেন বাইশ ফুটবলার। এই ম্যাচে যে বারবার বারুদের ফুলকি জ্বলে উঠবে, সেটা জানতেন সবাই। কিন্ত সেটা যে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিতর্কটিরই জন্ম দেবে, এতখানি বোধহয় ভাবেননি কেউই!

২২শে জুন, ১৯৮৬। মেক্সিকোর অ্যাজটেক স্টেডিয়ামে মঞ্চ প্রস্তত, মাঠে নামলেন ফুটবলারেরা। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার দাপট, ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের দৃঢ়তায় গোলবার অক্ষত থাকলো ইংল্যান্ডের। গোলশূন্য সমতা নিয়ে বিরতিতে গেল দুই দল। মাঠে উপস্থিত দর্শকেরা তখনও জানেন না, কি অসধারণ এক রোমাঞ্চের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তারা, অল্প কিছুক্ষণ বাদেই! 

ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারের সেরা গোল কোনটা? ভোটের আয়োজন করা হলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে করা দ্বিতীয় গোলটাই পাবে সর্বোচ্চ ভোট। অথচ ম্যারাডোনার কথা উঠলে লোকে মাঝমাঠ থেকে ছয়জনকে কাটিয়ে দেয়া সেই গোলটাকে স্মরণ করে না, উল্টো কথা বলে ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত গোলটা নিয়ে! সেই গোলটাও তো সেই একই ম্যাচেই হয়েছিল, করেছিলেন সেই ম্যারাডোনাই! হ্যান্ড অফ গড নামে যেটাকে অভিহিত করেছিলেন তিনি ম্যাচশেষে!

বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে ম্যারাডোনা

দ্বিতীয়ার্ধের খেলা চলছে তখন, ম্যাচের বয়স ৫১ মিনিট। মাঝমাঠের একটু সামনে বল পেয়ে দৌড় দিলেন আর্জেন্টিনার ক্ষুদে জাদুকর, দিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা যার নাম। প্রতিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে কাটালেন, তারপর দুজনের মাঝখান দিয়ে জায়গা বানিয়ে হুট করেই ডি-বক্সের ঠিক সামনে চলে এলেন। সম্মুখে ইংলিশ ডিফেন্ডারদের রক্ষণদূর্গ দেখে বলটা পাস দিলেন ভালদানোকে, নিজে ঢুকে পড়লেন বক্সের ভেতরে।

কিন্ত বল পায়ে রাখতে পারলেন না ভালদানো, ইংলিশ ডিফেন্ডার স্টিভ হজের দখলে গেল সেটা। আর ভুলটা করলেন তিনিই, ক্লিয়ার করার বদলে উল্টো বল ওপরে তুলে দিলেন হজ। সেটা ধরতেই এগিয়ে এলেন ইংলিশ গোলরক্ষক শিলটন, যাকে তখনকার সেরা গোলরক্ষক ধরা হয়। ম্যারাডোনা ততক্ষণে শিলটনের সামনে চলে এসেছেন, বলের সঙ্গে তার দূরত্ব কয়েক ফুটের। ছোটখাটো শরীরের ম্যারাডোনা বলের নাগাল পাবেন? নাকি শিকারী ঈগলের মতো ছোঁ মেরে সেটা ধরে ফেলবেন শিলটন?

স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা দেখলেন, ম্যারাডোনা লাফ দিয়েছেন। বল হাতে নেয়ার জন্য শূন্যে ভাসলেন শিলটনও। তারপর? বলটা জড়ালো জালে। উল্লাসে ভেসে গেল গোটা গ্যালারি, সেখানে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের পাল্লাটাই ভারী। উৎসব করছেন আর্জন্টিনার খেলোয়াড়েরাও। হেড থেকে গোল হয়েছে ভেবে বাঁশি বাজিয়েছেন রেফারীও। কিন্ত তার দিকে তখন দলবেঁধে ছুটে গেলেন ইংলিশ ফুটবলারেরা। অভিযোগের সুরে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন তারা, কিন্ত রেফারী খুব একটা পাত্তা দিলেন না তাদের কথায়। 

বিখ্যাত সেই 'হ্যান্ড অফ গড'

কমেন্ট্রিবক্সে থাকা ধারাভাষ্যকারেরা তখন ভেবেছিলেন, ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা বুঝি অফসাইডের দাবীতে একজোট হয়ে ঘিরে ধরেছে রেফারীকে। গোলের পরে একবার টিভিতে রিপ্লে দেখালেও বোঝা যায়নি কিছুই। ম্যারাডোনা লাফ দিয়েছেন, তার একটা হাত ওপরের দিকে উঠেছিল, এটুকুই চোখে পড়েছে সবার। তাহলে গোলমালটা কোথায়? 

আরও দুইবার রিপ্লে দেখার পরে বিবিসির ধারাভাষ্যকারেরা একটু সন্দিহান হলেন। গোলটার মধ্যে ভেজাল কিছু আছে। কি সেটা? ম্যারাডোনা এগিয়ে যাচ্ছেন, সামনে এগিয়ে আসছেন পিটার শিলটনও, বলটা তখন হাওয়ায়। ম্যারাডোনা শূন্যে ভাসলেন বলের সঙ্গে তার শরীরের সংযোগ হলো... এক মিনিট! বলটা হাতে লেগেছে! ম্যারাডোনার হাতে লেগে বল ঢুকেছে জালে! এটা গোল হয় কিভাবে? এটা তো পরিস্কার হ্যান্ডবল! আর চতুর ম্যারাডোনা কিনা হ্যান্ডবল বুঝতে পেরেও উল্লাসে মেতে আদায় করে নিলেন রেফারীর ইশারা!

কিন্ত ওই মূহুর্তে সেটা বলার সময়টাও পাননি ধারাভাষ্যকারেরা। বিতর্কিত সেই গোলটার মাত্র চার মিনিটের মাথায় বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলটাও যে করে ফেলেছেন ম্যারাডোনা! মাঝমাঠ থেকে ইংল্যান্ডের পাঁচ খেলোয়াড়কে একাই কাটিয়ে গোল দিয়েছিলেন তিনি। ধারাভাষ্যকারেরা তখন সেই গোলের প্রশংসা করবেন, নাকি আগের গোলটার সমালোচনায় মত্ত হবেন, সেটাই বুঝতে পারছিলেন না! 

অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্ত

সেই ম্যাচটা আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলে হেরেছিল ইংল্যান্ড। কিংবা আর্জেন্টিনা নয়, ওরা হেরেছিল ডিয়াগো ম্যারাডোনা নামের এক ফুটবল জাদুকরের কাছে। ইংলিশরা যদিও সেটাকে হার মানতে নারাজ, তাদের কাছে সেটা পরিস্কার জোচ্চুরি। আর ম্যারাডোনা তো সেদিন ম্যাচ শেষে আগুণে ঘি ঢেলেছিলেন জোরেশোরে, দাবী করেছিলেন, সেই গোলটা আসলে তার হাত দিয়ে হয়নি, হয়েছে ঈশ্বরের হাতে লেগে। সেখান থেকেই 'হ্যান্ড অফ গড' কথাটার জন্ম।

কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর বেলজিয়াম আর জার্মানীকে হারিয়ে সেই বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলেছিল আর্জেন্টিনা। ট্রফি হাতে বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, বিশ্বকাপের চাইতে ইংল্যান্ডকে হারানোটা তাদের কাছে বেশী তৃপ্তির! সেই ম্যাচের পরে পিটার শিলটন অনেক বছর ম্যারাডোনার মুখদর্শনও করেননি। তার পরিস্কার জবাব ছিল- "একটা চোরের সাথে একসঙ্গে বসার মতো অযোগ্য এখনও আমি হইনি।"

শিলটন ম্যারাডোনাকে চোর বলুন কিংবা অন্যকিছু, ফুটবলের কাছে ম্যারাডোনা বিশেষ একজন। সেই ম্যাচে নিজের ক্যারিয়ারের আর বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা গোলটাও দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা, অথচ নিখাদ ফুটবলপ্রেমী ছাড়া খুব বেশী মানুষ সেটার খবর রাখে না। কিন্ত ম্যারাডোনার নাম নিলেই বিতর্কিত সেই হ্যান্ড অফ গডের কথা চলে আসে অবলীলায়! যেন ম্যারাডোনা আর হ্যান্ড অফ গড, দুটোই সমার্থক শব্দ!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা