যে জীবন ম্যারাডোনার, তার সাথে মানুষের হয় নাকো দেখা...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ম্যারাডোনা কখনও ভদ্রলোক হতে চাননি, তিনি নিজে যেমন, তেমনটাতেই খুশি থেকেছেন বরাবর, মুখের ওপর বাড়তি প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করেননি কখনও। যখন মনে যা এসেছে, তিনি ফিল্টার ছাড়াই সেসব বলে ফেলেছেন, দু'বার ভাবেননি বলার আগে...
আমি মারদাঙ্গা ব্রাজিল ভক্ত, বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যে লিওনেল মেসি আবার আমার সবচেয়ে প্রিয়। দীর্ঘ অনেকগুলো বছর একটা ব্যাপার আমার কাছে তুমুল এক রহস্য হয়ে ছিল- কেন মেসির মতো অসাধারণ একজন খেলোয়াড়কে আর্জেন্টাইনদের অনেকে পছন্দ করে না, অথচ ম্যারাডোনার মতো মাদকাসক্ত, ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে বিশ্বকাপের মাঝপথে নিষিদ্ধ হওয়া একজনকে এরা কি কারনে মাথায় তুলে রাখে? একটা বিশ্বকাপ ট্রফির কি এতই দাম? মেসি যে খাদের কিনার থেকে বারবার দলকে টেনে তুলছেন, সতীর্থদের সাহায্য না পেয়েও দলকে জেতাচ্ছেন, বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, ফাইনাল অবদি টেনে নিয়েছেন- এসবের কি কোন মূল্য নেই?
এখন সম্ভবত আমি উত্তরটা জানি, কেন আর্জেন্টাইনরা ম্যারাডোনাকে এত পছন্দ করে। কারনটা লাইফস্টাইল, কারনটা দুজনের জীবনদর্শন। মেসি ওদের কাছে পাশের বাড়ির ভদ্র ছেলেটার মতো, আর ডিয়াগো হচ্ছে নিজের ঘরের মানুষ। ম্যারাডোনার পাগলাটে আচরন, মন খুলে যা খুশি তা বলে ফেলা, আকণ্ঠ মদ গিলে উন্মাতাল আচরন করা কিংবা সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করার যে অ্যাটিটিউড- এটা আর্জেন্টাইনদের সঙ্গে মানানসই, ল্যাটিন লাইফস্টাইলের ধারক এবং বাহক। ম্যারাডোনার মধ্যে আর্জেন্টাইনরা নিজেদের খুঁজে পেতো, যেটা মেসির মধ্যে অনুপস্থিত। মেসি দুটো বিশ্বকাপ জিতে ফেললেও আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে ম্যারাডোনার জায়গাটা দখল করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না।
ম্যারাডোনা আসলে কী ছিলেন? কারো চোখে জাদুকর, ঈশ্বর, আস্ত একটা মিথ, কিংবা ফুটবলের প্রতিশব্দ। পিটার শিলটনের চোখে আবার প্রতারক, চোর, ছিয়াশির কোয়ার্টার ফাইনালে হ্যান্ড অফ গডের ওই চাতুরী সহ্য হয়নি শিলটনের, তিনি কখনও মেনে নিতে পারেননি সেই গোলটা। কারো কাছে ম্যারাডোনা মানে মাতাল এক প্রতিমূর্তি, মাদকের প্রেমে পড়ে ক্যারিয়ারটাকে যিনি নিজের হাতে শেষ করেছেন। কিন্ত ফুটবল রাডারের বাইরে ম্যারাডোনা খুব রহস্যময় একটা মানুষ, আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, 'আই ডোন্ট কেয়ার' লেখা অদৃশ্য ট্যাগটা যিনি কপালে লিখে ঘুরে বেড়িয়েছেন জীবনভর। সেই মানুষ ম্যারাডোনাকে বুঝতে পেরেছে ক'জন?
খ্যাতির তুঙ্গে থারা সময়টাতেই ম্যারাডোনার সবচেয়ে কাছের দুই বন্ধু ছিলেন কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ- পুঁজিবাদী দুনিয়ার চোখে সবচেয়ে বড় দুই শত্রু। দুজনই সমাজতন্ত্রী আদর্শের রাজনীতি করেছেন, ম্যারাডোনাও তাদের সেই আদর্শের ভক্ত ছিলেন। খেলা ছাড়ার পরে অনেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, ডানপন্থী-বামপন্থী কিংবা মধ্যপন্থী যাই হোক না কেন। কিন্ত আমেরিকার চক্ষুশূল হয়ে ম্যারাডোনার মতো এভাবে ক্যাস্ট্রো বা শ্যাভেজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার সাহস কারো হয়নি।
দুই পায়ে দুই বন্ধুর ছবি ট্যাটু করিয়ে রেখেছিলেন ম্যারাডোনা, বাহুতে ছিল চে গুয়েভারার ট্যাটু। পরাশক্তিদের চোখে ঘৃণ্য অপরাধীর 'মর্যাদা' পাওয়া মানুষগুলোর মুখাবয়ব সঙ্গে নিয়ে ম্যারাডোনা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে- এটাকে আপনি কি বলবেন? শুধু দুঃসাহস? শ্যাভেজ মারা যাওয়ার পরে প্রকাশ্যেই তার উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরোকে সমর্থন দিয়েছেন ম্যারাডোনা, বলেছেন, মাদুরো ডাকলে তিনি ইউনিফর্ম পরে যুদ্ধ করতে যাবেন!
এই লোকটা নিজের জীবনে কখনও মধ্যপন্থার দিকে হাঁটেননি। সাদাকে সাদা বলেছেন, কালোকে কালো বলতে দ্বিধা করেননি। কিন্ত কখনও স্বার্থের জন্য, সম্পর্কের খাতিরে কালোকে ধূসর বলার চেষ্টা করেননি তিনি, ধূসর ব্যাপারটা তার মধ্যে ছিলোই না। স্ত্রীর করা মামলা মোকাবেলা করতে ম্যারাডোনাকে।মিয়ামিতে যেতে হবে, আমেরিকার ভিসা লাগবে, উকিল পইপই করে বলে দিয়েছেন, অ্যাম্বাসির ইন্টারভিউতে ম্যারাডোনা যেন আমেরিকা নিয়ে উল্টোপাল্টা কোন মন্তব্য না করেন।
কিন্ত লোকটা তো ম্যারাডোনা, ডিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা- তিনি কি আর বাঁধাধরা নিয়মে চলবেন? ইন্টারভিউতে তাকে প্রশ্ন করা হলো, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে তিনি কি ভাবেন? ম্যারাডোনা অকপটে জবাব দিলেন, ও তো একটা চিরোলিটা! স্প্যানিশ এই শব্দটার মানে হচ্ছে পুতুল। এর আগেও রাশিয়ান এক টিভি চ্যানেলে ট্রাম্পের প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "ওই লোকটা একটা জ্বলজ্যান্ত কৌতুক। আমার কাছে ওকে কার্টুনের মতো মনে হয়। আর আমি কার্টুন অপছন্দ করি। তাই কোন চ্যানেলে ওর ছবি দেখলেই চ্যানেল বদলে ফেলি।" খুব স্বাভাবিকভাবেই, আমেরিকার ভিসা পাননি ম্যারাডোনা, তার উকিল একাই গিয়ে মামলা লড়েছিলেন।
দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে বাম রাজনীতির পতন, প্রতিটা বিষয়ে তার মতামত ছিল। একই মানুষটা কখনও লিওনেল মেসির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, কখনও বিরক্তি নিয়ে বলেছেন, আর্জেন্টিনাকে নেতৃত্ব দেয়ার মুরোদ ওর নেই। আমাদের কাছে কখনও মনে হয়েছে, এই লোকটা কি পারে না তার মুখ বন্ধ রাখতে? সবকিছু নিয়ে কেন তাকে কথা বলতে হবে? একটা মানুষ এত বড় তারকা হয়েও কেন এত বিতর্কের জন্ম দেয়? কেন আলটপকা মন্তব্য করে হাসির পাত্র হয়? কেন তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভাবগাম্ভীর্যের উপস্থিতি নেই?
উত্তরটা হচ্ছে, ম্যারাডোনা কখনও ভদ্রলোক হতে চাননি, তিনি নিজে যেমন, তেমনটাতেই খুশি থেকেছেন বরাবর, মুখের ওপর বাড়তি প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করেননি কখনও। যখন মনে যা এসেছে, তিনি ফিল্টার ছাড়াই সেসব বলে ফেলেছেন। আকণ্ঠ মদ গিলে মাতলামি করেছেন, নেচেছেন, গেয়েছেন- শত শত ক্যামেরার চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে জেনেও তিনি মধ্যাঙ্গুলি উঁচিয়ে ধরেছেন- যে কাজটা জনসম্মুখে পেলে বা বেকেনবাওয়ারের মতো তারকারা কখনও করবেন না, মেসি-রোনালদো তো বটেই, ইব্রাহিমোভিচও করার সাহস পাবেন না, সেই কাজ তিনি করেছেন। কারন তিনি পেলে বা বেকেনবাওয়ার নন, তিনি ম্যারাডোনা, তিনি ঈশ্বর।
এই লোকটা শুধু বাম পায়ের জাদু দেখাননি, দেখিয়েছেন কীভাবে একটা জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে হয়। কীভাবে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মতো করে বাঁচতে হয়, কিভাবে নিন্দুকদের উপেক্ষা করতে হয়, কিভাবে হেসে আর হাসিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে হয়, কিভাবে ভালোবাসা ছড়িয়ে বেড়াতে হয়, কিভাবে ভালোবাসা আদায় করে নিতে হয়।
ম্যারাডোনা কখনও জানবেন না, পৃথিবীর মানচিত্রে বিন্দুর মতো ছোট্ট একটা দেশ বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার আকাশী পতাকা উড়েছিল শুধুমাত্র তার কারনে, এই দেশটার অজস্র মানুষ ফুটবল খেলাটাকে ভালোবেসেছে তার জন্যে, তিনি ডোপ টেস্টে নিষেধাজ্ঞা পাবার পর সেই দেশটার হাজার হাজার মানুষ চোখের জল ফেলেছে, ফিফাকে অভিশাপ দিয়েছে। আজ ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবরেও তারা স্তম্ভিত, আবেগাক্রান্ত। অথচ ম্যারাডোনা সেই দেশটার নামও জানতেন না হয়তো। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অর্জন করাটা মুখের কথা নয়, ম্যারাডোনা সেটা পেয়েছিলেন, যে জীবন ম্যারাডোনার, সেই জীবন তো আর কোন মানবসন্তানের হতে পারে না, পারবেও না কখনও!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন