একজন মার্গারেট মিড ও সভ্যতার টিকে থাকার মন্ত্র!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নিচের যে মহিলাটাকে দেখতে পাচ্ছেন, উনার নাম মার্গারেট মিড এবং উনি একজন নৃতত্ত্ববিদ বা এনথ্রোপোলজিস্ট। উনাকে দেখে এই জাজমেন্টাল যুগে কারো অবশ্য তেমন ভালো লাগার কথা না, তবে তাঁকে নিয়ে গল্প আছে একটা, সেটা আজকে বলি।
বহু বছর আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, সভ্যতার শুরু কীভাবে হয় বলে আপনি মনে করেন? মানে কোনো একটা জায়গায় বা সমাজে বা রাষ্ট্রে সভ্যতার প্রথম সাইন কী? তিনি নৃতত্ত্ববিদ, তাঁরা মানুষের আচরন নিয়ে গবেষণা করেন, অতীতের সাথে বর্তমানের সংযোগ ঘটিয়ে, পুরো মানবসভ্যতা টিকে থাকার রহস্য উদ্ঘাটন করা, এবং সেগুলো নিয়ে লেখালেখি করাই তাঁদের কাজ। তাই সভ্যতার চিহ্ন নিয়ে তিনি ভালো বলতে পারবেন- এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা ছিল অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত। তিনি বলেছিলেন- একটা দেশে, সমাজে বা গোত্রে সভ্যতার শুরু সেদিন থেকে হয়, যেদিন থেকে একটা প্রাণীর ভাঙা পা (রান বা থাই অংশ) ভালো হয়ে যেতে শুরু করে এবং পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। যে জায়গায় কোনো প্রাণীর ভাঙা পা ভালো হয়ে যাবে, বুঝতে হবে সেখানে সভ্যতার অভ্যুত্থান হয়েছে।
এই উত্তরের কোনো আগা মাথা বোঝা গেল না। যে প্রশ্ন করলো, সে কনফিউজড হয়ে বললো, 'বিষয়টা একটু খুলে বলেন ম্যাডাম। ভাঙা পা মানে?' তিনি বললেন-
প্রাচীন কালে কী হতো? সকল প্রাণিকুল কীভাবে বেঁচে থাকতো? সেসময় তারা দলবদ্ধ হয়ে ঘুরাফিরা করলেও যার যার চিন্তা ছিল তার তার। যেমন তাদেরকে নিজ দায়িত্বে নদীর পারে গিয়ে পানি পান করতে হতো, শিকারে দৌড়ে নিজের খাদ্য জোগাড় করতে হতো, এমনকি নিজেও শিকারির কবলে পরলে নিজেকেই দৌড়ে পালিয়ে যেতে হতো। এটাই ছিল জীবন, এটাই বেঁচে থাকা।
এখন সেই প্রাণীর যদি পা ভেঙে যায়, তাহলে কী হবে? সে নদীর পারে যেতে পারবে না, পানি পাবে না। নিজে দৌড়িয়ে শিকার ধরতে পারবে না, এমনকি হেঁটেও কোনো খাদ্য সন্ধানে যেতে পারবে না। ফলে সে মারা যাবে। যদি এগুলো সে কোনোভাবে ম্যানেজও করে ফেলে, কোনো শিকারি প্রাণীর কবল থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। কারণ এ সবকিছু করার জন্য একজোড়া পা দরকার!
অতএব পা ভাঙা কোনো প্রাণী আসলে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না, তার ভাঙা পা ভালো হয়ে যাবার আগেই তাকে না খেয়ে বা শিকারীর কবলে পরে মরে যেতে হয়। যখন থেকে কিংবা যেদিন থেকে কারো ভাঙা পা জোড়া লেগে যায় এবং সে বেঁচে থাকার জন্য আবার দৌড়াতে পারে, তখনই সভ্যতার সূচনা হয়।
কারো ভাঙা পা এমনি এমনি ভালো হয়ে যেতে পারে না। সেজন্য যত্ন লাগে, তার পাশে কাউকে দরকার হয়- তাকে পানি এনে দেয়ার জন্য, খাদ্য জোগাড়ের জন্য এবং তাকে শিকারির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য।
যদি কারো ভাঙা পা ভালো হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে তার আশেপাশে সেই যত্ন করা বা যত্ন নেয়া কোনো প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। আর এভাবেই সভ্যতার চিহ্ন আমরা খুঁজে পাই। সভ্যতা গাড়ি-বাড়ি নয়, অন্যের বিপদে পাশে থাকা, সাহায্য করার নামই সভ্যতা।
মার্গারেটের গল্প এখানেই শেষ!
এনিওয়ে, আপনাদের যদি কখনো মানবতা খোঁজার দরকার পরে, আপনারা খুঁজে-টুজে একজন মন ভাঙা মানুষকে বের করতে পারেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল বা আছে তেমন কাউকে খুঁজে দেখেন। যদি তার বিপর্যস্ততা কেটে যায়, তাহলে বুঝতে হবে তার আশেপাশে সত্যিকারের মানবতার জন্ম নিয়েছে, তার পাশে সত্যি সত্যি কেউ একজন আছে, যে নিয়মিত তার মনের যত্ন নেয়।
শুধু ঔষুধ-কাউন্সেলিং না, এমন মানুষের পাশে সত্যি সত্যি কাউকে থাকতে হয়। নইলে হয় না, হবেই না..ভাঙা মন ভাঙতেই থাকবে আর সেই ব্যক্তি টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া মনের অংশগুলি কীসের আশায় যেন মাটি থেকে টোকাতেই থাকবে। এভাবেই সে নুয়ে যায়, এভাবেই সে ক্লান্ত হয়ে যায়। সেই ক্লান্তির খবর অবশ্য অমানবসভ্য জগতের কেউ রাখে না...
যাইহোক, মানবতার চিহ্ন কবে না কবে পাবো সেই অপেক্ষা না করে, আমরা নিজেরাই কিন্তু প্রজেক্ট শুরু করে ফেলতে পারি। কম চেনা, অল্প চেনা এমনকি 'নান অফ মাই বিজনেস' টাইপ মানুষের পাশেও আমরা দাঁড়িয়ে যেতে পারি। আমরা বললাম এইজন্য, কারণ আমরাই জানি ভাঙা মন নিয়ে দিশেহারা হওয়ার যন্ত্রনা, আমরা ছাড়া আর কে বুঝবে ভাঙা পা নিয়ে আসলে বেশিদূর দৌড়ানো যায় না...
তবুও তাদের বিপর্যস্ততা তো আমাদের বিপর্যয়, না? অতএব তাদের বিপর্যয়ে আমরা খুব শক্ত করে তাদের হাত ধরে ফেলতে পারি, বাকিটা দেখা যাবে। অবশ্য হাত ধরতে যেয়ে প্রেম হয়ে যেতে পারে, সেটাও খারাপ না। প্রোফাইল পিকচার দেখে প্রেম হওয়ার এই সস্তা যুগে, মনের ক্ষত দেখে যে প্রেম হয়, সেটা অসাধারণ হবার কথা। সবাই যে যার মতন ভালো থাকুক, সুস্থ্য থাকুক। এবং পৃথিবীর সকল প্রেম শুরু হোক মন দিয়ে, মনন দিয়ে, মনের ক্ষতস্থানে মলম দিয়ে।