ম্যারি কুরি- নারীদের জন্য সফলতার অন্যরকম একটা মাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন যিনি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ম্যারি কুরি যে সময়টাতে এত কিছু করেছেন সে সময়টাতে সারা পৃথিবীতেই মেয়েরা ছিল অনেক পিছিয়ে। বিজ্ঞানচর্চায় মেয়েদের পদচারণা ছিল অবাঞ্চিত। সেই কঠিন দিনগুলোতে একজন মেয়ে হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
ম্যারি কুরি পৃথিবীর ইতিহাসের এক অন্যতম সফল নারী। তিনি নোবেল পুরস্কারজয়ী প্রথম নারী, তবে সেটিই তার একমাত্র অর্জন কিংবা একমাত্র পরিচয় নয়। তার জীবন গল্পের পাতায় পাতায় রয়েছে আরও অনেক অর্জন, সফলতা আর পরার্থপরতার গল্প। পোল্যান্ডের ওয়ারশে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে ম্যারি কুরি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ব্রনিসলাওয়া ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের শিক্ষক। বাবার কাছেই কুরির বিজ্ঞানচর্চার হাতেখড়ি। ছেলেবেলা থেকেই কুরি ছিলেন পরিশ্রমী এবং মেধাবী যা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশকে হার মানিয়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিল সাফল্যের চূড়ায়। জীবনের অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে ২৪ বছর বয়সে ১৮৯১ সালে তিনি নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান প্যারিসে। সেখানে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করতে থাকেন।
১৯৮৩ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং “দ্য সোসাইটি ফর দ্য এনকারেজমেন্ট অফ ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি” এর সহায়তায় বিভিন্ন পদার্থের চৌম্বক ধর্ম পরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করেন। সেই ল্যাবেই তার পরিচয় হয় ফরাসি পদার্থবিদ পিয়েরে কুরির সাথে। পরিচয়ের পর তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৮৯৫ সালের ২৬ জুলাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিজ্ঞানের অগ্রদূত এ চমৎকার জুটি। ১৮৯৬ সালে হেনরি বেকেরেল আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম লবণ একধরণের রশ্মি নিঃসরণ করে যাদের কোন কিছু ভেদ করার ক্ষমতা এক্স-রশ্মির সমতুল্য। তার আবিষ্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ম্যারি কুরি ইউরেনিয়াম রশ্মির উপর গবেষণা শুরু করেন। মারির স্বামী পিয়েরে তার কাজে এতটাই মুগ্ধ হন যে নিজের গবেষণার কাজ বন্ধ রেখে তিনিও ১৮৯৮ সালে স্ত্রীর গবেষণায় সাহায্যে করতে শুরু করেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার ফলেই ম্যারি কুরি তার স্বামীর সাথে যৌথভাবে দুটি মৌল আবিষ্কার করেন পোলনিয়াম ও রেডিয়াম।
১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স হেনরি বেকেরেল কর্তৃক উদ্ভাবিত বিকিরণের উপর সমন্বিত গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ পিয়েরে ক্যুরি, ম্যারি কুরি এবং হেনরি বেকেরেলকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করে। এটিই ছিল কোন নারীর প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। দুই কন্যার জননী ম্যারি কুরি ১৯০৬ সালে এক দূর্ঘটনায় হারান স্বামী পিয়েরে ক্যুরিকে। এই অসহনীয় কষ্টের দিনগুলোতে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্বামীর ফেলে যাওয়া পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের পদটিতে আসীন হন। কুরি এ পদটি গ্রহণ করেছিলেন এই স্বপ্নকে ধারণ করে যে তিনি সেখানে তার স্বামীর সন্মানে একটি বিশ্বমানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনিই ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী অধ্যপক।
১৯১১ সালে ম্যারি কুরি দ্বিতীয়বারের মতো নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তবে এবার আর পদার্থবিজ্ঞানে নয়। এবার তিনি নোবেল পান রসায়ন শাস্ত্রে। রেডিয়াম ও পোলনিয়াম আবিষ্কার, রেডিয়াম পৃথকীকরণ এবং এরকম অসাধারণ উপাদানের প্রকৃতি ও এদের যৌগের উপর গবেষণার মাধ্যমে রসায়নশাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটানোর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এই সম্মানে ভূষিত হন। যদিও তিনি এককভাবে এ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন, তিনি তার নোবেল পরবর্তী ভাষণে স্বামী পিয়েরে কুরি-কেও তার এই সম্মানের ভাগীদার বলে উল্লেখ করেন। তিনি ছিলেন দুইটি নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী প্রথম নারী।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধক্ষেত্রে সার্জনদের সাহায্যে করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এই মহীয়সী নারী। তিনি তাদের সাহায্য করার জন্য এক্স-রে যন্ত্র, যানবাহন, সহায়ক জেনারেটর ইত্যাদি জোগাড় করেন এবং ভ্রাম্যমাণ রেডিওগ্রাফি ইউনিটের উন্নয়ন করেন যেগুলো পরবর্তীতে লিটল ক্যুরি ("ছোট ক্যুরিগুলো") নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি রেডক্রস রেডিওলজি সার্ভিসের পরিচালক পদে আসীন হন এবং ফ্রান্সের প্রথম সামরিক রেডিওলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯১৪ সালের শেষভাগ থেকে কাজ শুরু করে। প্রথমে একজন সামরিক চিকিৎসক এবং তাঁর ১৭ বছর বয়সী মেয়ে আইরিনের সহায়তায় যুদ্ধের প্রথম বছরে কুরি ২০টি ভ্রাম্যমাণ রেডিওলজিকাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং মাঠপর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ২০০ রেডিওলজিকাল ইউনিট স্থাপনের কাজ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে, তিনি অন্যান্য মহিলাদের এই কাজে সহায়তা করার সক্ষমতা লাভের প্রশিক্ষণ দেন। ধারণা করা হয় যে দশ লক্ষেরও বেশি যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা করা হয়েছিল তাঁর এক্সরে ইউনিটে। এছাড়াও যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কার দান করতে প্রস্তুত হয়ে যান, কিন্তু ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। তবে নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তিনি ওয়ার বন্ডস কিনেছিলেন।
এছাড়া তিনি পোলিশদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত পোলনিয়া ইন ফ্রান্সের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯২২ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ একাডেমী অফ মেডিসিন-এর একজন ফেলো নির্বাচিত হন। নোবেল বিজয়ী কুরির নেতৃত্বে পরিচালিত এই ইন্সটিটিউটটি আরও চারজন নোবেল বিজয়ীর উদ্ভব ঘটায়, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর মেয়ে আইরিন ক্যুরি এবং মেয়ের জামাই ফ্রেডরিক কুরি। ম্যারি কুরি তার জীবনের অনেকগুলো বছর তেজষ্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করেছেন, যা তার শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। জীবনের শেষভাগে তিনি অ্যাপলাসটিক অ্যানিমিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হন। বিশ্রাম ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আশায় ১৯৩৪ সালে তিনি ফ্রান্সের পূর্বদিকে স্যানসেলেমোজ স্যানাটোরিয়াম নামক স্থানে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে তার বর্ণময় জীবনের।
স্মরণকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী বৈজ্ঞানিক হিসেবে ম্যারি কুরি বৈজ্ঞানিক জগতের একজন আদর্শ এবং সারা বিশ্বে সমাদৃত। পদার্থবিজ্ঞানে তার অনন্য অবদানের কারণে তাকে বলা হয় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জননী। ক্যুরির কাজ শুধু পদার্থ ও রসায়নের মতো বিষয়কেই প্রভাবিত করেনি, সামাজিক প্রভাবও ছিল। তিনি তাঁর সততা ও সুশৃঙ্খল জীবনাচরণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর প্রথম নোবেল পুরস্কারের সাথে প্রাপ্ত অর্থের অনেকটাই তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, শিক্ষার্থী এবং গবেষণা সহকারীদের দেন। ক্যুরি রেডিয়াম পৃথক করার পদ্ধতিটি পেটেন্ট না করার একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে বৈজ্ঞানিক মহলগুলো বাধাহীনভাবে গবেষণা চালাতে পারে। তিনি আরও চেয়েছিলেন, অর্থ সহায়তা ও পুরস্কার তাঁকে না দিয়ে বরং তিনি যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সেগুলোকে দেয়া হোক।
শুধু নোবেল পুরস্কারই নয়, জীবনজুড়ে অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হন তিনি। এমনকি মৃত্যুর পরও তাকে তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরুপ অনেক পুরস্কার ও সন্মানে ভূষিত করা হয়। তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তার নামে নামকরণ হয় বিভিন্ন স্থানের। তাকে নিয়ে লেখা হয় অনেক গল্প। জীবন নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা। বিশ্বজুরে বিভিন্ন ডাকটিকিট ও মুদ্রায় পাওয়া যায় তাঁর ছবি। এই যে জীবনের এত অর্জন, তা কিন্তু এত সহজেই আসেনি। ম্যারি কুরি যে সময়টাতে এত কিছু করেছেন সে সময়টাতে সারা পৃথিবীতেই মেয়েরা ছিল অনেক পিছিয়ে। বিজ্ঞানচর্চায় মেয়েদের পদচারণা ছিল অবাঞ্চিত। সেই কঠিন দিনগুলোতে একজন মেয়ে হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাকে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তথ্যসূত্র-
১। How Did Marie Curie Change the World?
২। Marie Curie Biography