মারজুক রাসেল: স্রোতের বিপরীতে চলা অন্যরকম একজন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তার লেখা গান শুনে জেমস বলেছিলেন- 'হবে, তোর হবে! তোর মধ্যে আগুন আছে।’ কারো কাছে তিনি বখে যাওয়া একজন; কারো চোখে আবার অমিত প্রতিভাবান- নাম তার মারজুক রাসেল...
পাগলাটে এক যুবকের গল্প বলি। এই যুবককে আমার ভীষণ পছন্দ, তার কথাবার্তা, চাল-চলন, তার লাইফস্টাইল- সবকিছুই আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। দশজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাকে মেলানো যাবে না, তিনি চলেন আপন খেয়ালে, নিজের পছন্দে। আলাদা একটা দুনিয়া আছে তার, সেই দুনিয়ায় তিনিই সর্বময় অধিপতি, সেখানে তিনি কারো ধার ধারেন না।
তার যা মাথায় আসে তিনি সেটা লিখে ফেলেন, যেটা মুখে আসে বলে ফেলেন, মাঝখানে সেন্সর বোর্ডের কোন বাগড়া নেই। হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে, মাথায় বেসবল ক্যাপ চাপিয়ে তিনি জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে যান, মানুষজন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তাকে নিয়ে কানাঘুষা চলে চারপাশে, সেসবের ভীড়ে তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ান। বাউন্ডুলে, পাগলাটে, মাদকাসক্ত বলে তার দিকে নাক সিটকানো ভদ্রলোকেদের মুখ তিনি বন্ধ করে দেন নিজের লেখনী দিয়ে, নিজের কাজ দিয়ে। তিনি মারজুক রাসেল, হাজারো তরুণের আইডল, কারো কাছে বখে যাওয়া একজন; কারো চোখে আবার অমিত প্রতিভাবান।
মারজুকের মাথায় সারাক্ষণ কবিতা ঘোরে। শৈশব থেকে তিনি কবি হতে চেয়েছেন, গীতিকার হতে চেয়েছেন, গান লিখতে চেয়েছেন। বুকের ভেতর অশান্ত এক নদী পুষে রেখে তিনি লিখে ফেলেন মীরাবাঈ, কিংবা আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার ওপরে পরেছে! আমরা বুঁদ হয়ে তার লেখা গানগুলো শুনি, যন্ত্রণাকাতর মনের কথা তিনি তুলে আনেন নিজের কলমে। ‘কেউ প্রেম করে, কেউ প্রেমে পড়ে’ অথবা ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভেতর বলে আসুক না’- শুনে আমরা অনুভূতির অদ্ভুত এক দোলাচালে ভাসতে থাকি দিনরাত।
তিনি চলেন নিজ গতিতে, আপন কক্ষপথে। মন চাইলে তিনি সিগারেটে ডুবে যান, গাঁজার ধোঁয়ায় নিজেকে বিলিয়ে দেন, মদ খেয়ে গলা ভেজান। মায়ের অনুরোধও তাকে ফেরাতে পারে না সেখান থেকে, উল্টো তিনি মা’কে বলেন, "দেখো মা, খালি সিগারেট না, ক্ষতিকর মনে হইলে তোমারেও আমি ছাইড়া চইলা যামু!" সেই মানুষটাই আবার হুট করে আসরে যাওয়া বন্ধ করে দেন; গলির দোকানদার একদিন অবাক হয়ে আবিস্কার করেন, মারজুক ভাই আর তার কাছ থেকে সিগারেট কিনছেন না!
জন্ম হয়েছিল গোপালগঞ্জে, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার, শিল্পচর্চা সেখানে বিলাসিতার ব্যাপার। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো, দুইবেলা হুজুরের মার কিংবা আরবী ভাষার অত্যাচার- কোনকিছুই তার কবি হবার বাসনাকে গলাটিপে মারতে পারলো না। এরইমধ্যে তার লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়েছে খুলনার এক স্থানীয় পত্রিকায়। ১৯৯৪ সালে তিনি পাড়ি জমালেন ঢাকায়, কারণ জাদুর শহরে না এলে কবি হওয়া যাবে না, গান লেখা যাবে না। নিজেকে যাদের শিষ্য ভাবেন তিনি, তাদের বেশিরভাগই ঢাকায় থাকেন।
এরপরের গল্পটা কষ্টের। ঢাকায় এসে না খেয়ে থেকেছেন, বেঁচে থাকার জন্য সিনেমার টিকিট বিক্রি করেছেন, ফুটপাথে হকারগিরি করেছেন, বাসের টিকিট নেয়ার জন্য যাত্রীদের কাছে অনুরোধ করেছেন, প্রেসে কাজ করেছেন, রাতে ঘুমিয়েছেন গ্যারেজের মেঝেতে। শাহবাগের আজিজে আড্ডা দিয়েছেন, প্রবল অর্থকষ্টে দিন কাটিয়েছেন, কারো বাসায় দাওয়াতে গেলে হামলে পড়েছেন গরুর মাংসের বাটির ওপরে, কারণ আবার কবে না কবে ভালো খাবার সামনে পাবেন, কোন নিশ্চয়তা ছিল না সেসবের। বিখ্যাত সব সুরকারদের কাছে নিজের লেখা গান নিয়ে গিয়েছেন, কিন্ত বারবার ফিরেছেন শূন্য হাতে, তার গানের মূল্য বোঝেননি বিখ্যাতদের অনেকেই।
দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরীকে জানালেন এতসব প্রত্যাখ্যানের গল্প। সঞ্জীব তার গানের খাতাটা দেখলেন, খানিক পরে চোখ তুলে বললেন, ‘এসব গান তো ব্যাটা সবার জন্যে না! এগুলা গাইবে জেমসের মতো শিল্পী।’ সঞ্জীবই ব্যবস্থা করে দিলেন জেমসের সঙ্গে মারজুককে দেখা করানোর। তারপরের গল্পটা সবাই জানেন। ‘লাল ফিতা লেইস’ এলো, এলো ‘হাউজি’। তবে ইতিহাস গড়ে ফেললো মীরাবাঈ। এখনও, দুই দশক পরে এসেও কোন কনসার্টে গেলে এই গানটা না গেয়ে মঞ্চ ছাড়তে পারেন না জেমস। মীরাবাঈ-এর আবেদন এমনই!
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সেই আজিজের আড্ডা থেকেই। সেই ফারুকীর সিনেমায় কাজ করলেন সহকারী পরিচালক হিসেবে, ক্যামেরার সামনেও হাজির হলেন একটা রোলে- সিনেমার নাম ‘ব্যাচেলর’। তিনি গানের মানুষ, আর সিনেমায় গান লিখবেন না, তা হয় নাকি? বাংলা সিনেমার দর্শক অবাক হয়ে শুনলো, আইয়ুব বাচ্চু গাইছেন- ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’! এমন গানও বাংলা সিনেমায় হয়?
ব্যাচেলর অনেক দিক থেকেই ভেঙে দিয়েছিল বাংলা সিনেমার স্ট্যান্ডার্ডের বাঁধ, সেই স্রোতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এই মারজুক রাসেল। ব্যাচেলরের পর রাতারাতি তারকা বনে গেলেন তিনি। প্রেসের মেঝেতে ঘুমানো ছেলেটা তখন টিভির পরিচিত মুখ, ফারুকীর সিনেমাতেও তিনি অভিনয় করেন। জেমস-আসিফের মতো শিল্পীরা একটানা তার সঙ্গে কাজ করেন, ঢাকা শহরে বিশাল বিলবোর্ডে তার ছবি টানানো! অনেকেই এই সময়ে পথ হারায়, অহঙ্কারের স্রোতে ভেসে যায়। কিন্ত মারজুক রাসেল কখনও খ্যাতির স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না।
বইমেলায় তার বই প্রকাশিত হয়, লেখক-কবি লুতফুর রহমান রিটন তার সাক্ষাৎকার নেন, তিনি মারজুককে সম্বোধন করেন ‘আপনি’ বলে। ক্যামেরা থামিয়ে মারজুক রিটনকে বলেন, ‘আপনি আপনি করলে আমি কিন্ত ইন্টারভিউ দিমু না ভাই। ঢাকা শহরে আপনি আমারে জায়গা দিছেন, খাবার দিছেন, আমারে আপনি কইরা বলবেন কেন? না রিটন ভাই আপ্নে আমারে আপনি করে বলতেই পারেন না। এইটা যায় না…’ এক ঘন্টার মধ্যে স্টল থেকে তার সব বই বিক্রি হয়ে যায়, একটা সেলফি তোলার জন্যে লাইন পড়ে যায় স্টলের সামনে, তিনি নির্বিকার মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকেন তবুও।
মারজুকের লাইফস্টাইল নিয়ে, তার চলন-বলন, ফেসবুক স্ট্যাটাসের ধরণ কিংবা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতেই পারে, সেসব যার যার পছন্দ। তিনি কাউকে বলেননি মারজুককে পছন্দ করতেই হবে। আমি তাকে পছন্দ করি, কারণ আমার কাছে মারজুক মানেই ‘ঢেউ জানা এক নদীর কাছে, গভীর কিছু শেখার আছে…’- যে গান শুনে অজস্রবার আমার চোখে জল এসেছে। মারজুক মানে প্রেম আর অপ্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া, মারজুক মানে ভালোবাসা আর না বাসার অদ্ভুত এক মায়াবী মেলবন্ধন। মারজুক মানে আগুনের হলকা, যে আগুনের ঝাঁঝ বুঝে জেমস বলেছিলেন- ‘হবে, তোর হবে! তোর মধ্যে আগুন আছে।’ আমি মারজুক রাসেল নামের সেই অগ্নিকুণ্ডটাকে ভালোবাসি…