মাশরাফির ইন্টারভিউটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালের রমজানের ঈদে। চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এগিয়ে চলোর পাঠকদের জন্য আবারও প্রকাশিত হলো। 

একবার গল্প বলা শুরু করলে মাশরাফিকে থামানো বড্ড কঠিন! মাশরাফিকে যারা কাছ থেকে চেনেন-জানেন, তারা সবাই এককথায় স্বীকার করে নেবেন তা! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আপনি তাঁর কথা শুনতেই থাকবেন, শুনতেই থাকবেন... বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে মাশরাফিকে আপনার ছাড়তে ইচ্ছে হবে না কিংবা মাশরাফিও আপনাকে যেতে দেবেন না! 'এগিয়ে চলো'-এর মতো একেবারেই নতুন একটি পোর্টালের জন্য ম্যাশ যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেটিই তো অভিভূত হওয়ার মতো ব্যাপার! শুধু তাই না, মাশরাফি তাঁর ক্যারিয়ার জুড়েই বোধহয় এ ধরণের সাক্ষাৎকার দেননি! অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল ফেসবুকে তাঁর ভক্তদের কাছ থেকে সংগৃহীত। মজার মজার সব প্রশ্ন শুনে মাশরাফি হেসে কুটি কুটি হয়েছেন, আবার কঠিন কোনো প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে নিজের জীবনদর্শন শুনিয়েছেন। একটি মজার প্রশ্ন করার পর সেই মজার রেশ থাকতে থাকতেই আরেকটি কঠিন প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। উদ্দেশ্য ছিল, মাশরাফির আবেগের উঠানামার স্কেল খানিকখানি পরখ করে দেখা। বলাবাহুল্য, মাশরাফি তাঁর অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়েছেন সাক্ষাৎকারজুড়েই!    সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ঈদের আগেই। দেশের এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে তাই 'এগিয়ে চলো'-এর পাঠকদের জন্য ঈদ উপহার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এই সাক্ষাৎকারটি। চলুন পাঠক, অজস্র খারাপ লাগা মুহূর্তের মাঝে খানিকটা বুঁদ হয়ে যাওয়া যাক মাশরাফি নামক বিস্ময়কর মানুষটিতে।

-পাঠকেরা সাক্ষাৎকারটি পড়বে ঈদের দিন। তবু রমজান মাস নিয়ে একটি প্রশ্ন না করলেই নয়।  আপনার একজন ভক্ত জানতে চেয়েছেন, 'আপনি কি ইফতারিতে হালিম পছন্দ করেন? পছন্দ করলে গরু না খাসি?' 

মাশরাফি: (হাসি) আমি প্রথমত বাইরের খাওয়া তেমন একটা পছন্দ করি না। বউ বানিয়ে দিলে বাসায় হালিম খাওয়া হয়। তাও সব রোজায় না, ত্রিশ রোজার মধ্যে দশটার মতন রোজায় খাই। অবশ্যই গরুর হালিম পছন্দের। তবে সবচেয়ে ফেভারিট- ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনী, শসা। আরেকটা স্পেশাল আইটেম আছে, সেটা শুধু আমাদের তিন বাসায় খাওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে, আমার ঢাকার বাসায় এবং মামা-মামীর বাসায়। সেটা হলো- ভাত দিয়ে ছোলা, মুড়ি, বেগুনী, শসা এবং লেবু মাখানো! 

চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এগিয়ে চলোর প্রত্যেক পাঠককে জানাই ভালোবাসা

-বাহ, খুব ইউনিক তো! খাওয়ার সাথে আমাদের সমাজে টিভি দেখা বোধহয় কিছুটা কানেক্টেড। তাই সরাসরি ওই টপিকে চলে যাচ্ছি। জীবনে কখনো কি আধ ঘন্টার জন্য হলেও স্টার জলসা দেখা হয়েছে? 

মাশরাফি: এটা খুবই পেইনফুল একটা জিনিস। আগে বাসায় একটা টিভি ছিল। শেষমেশ এই স্টার জলসার জন্য আমাকে আরেকটা টিভি কিনতে হয়েছে! খেলা দেখাই তো বন্ধ হতে চলেছিল! প্রথম দিকে তাও লাকি ছিলাম, তোশিবা টিভির নিচে ছোট একটা বক্স থাকতো। দেখা গেল খেলা চলতেছে, তাহলে সেখানে দেখতেছি আবার শিফট করে স্টার জলসা দেখতাম, এভাবেই! তবে বাসায় দুই টিভি হওয়ার পর এখন আর স্টার জলসাই চলে না। হাহাহা... 

-আমরা সবাই জানি আপনি একজন সফল প্রেমিক অজস্র তরুণ আছেন, আপনাকে তাদের লাইফে মেন্টর ভাবে। যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে লাইফে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যায়, অগ্রজ হিসেবে তাদের কী পরামর্শ দেবেন? 

মাশরাফি: প্রথম কথা হচ্ছে, ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে নিজে এস্টাবলিশড না হলে প্রেম এস্টাবলিশ করা যায় না। আপনি যদি জীবনে এস্টাবলিশড হোন, প্রেমও এস্টাবলিশ হবে। এই ধরেন আরও ১০-১২ বছর থেকে দেখে আসছি আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে যারা প্রেম করেছে, তাদের অনেকেই এস্টাবলিশড ছিল না। টিনএজার বয়সেই এফেয়ার হয়ে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেম পূর্ণতা পায়নি। আমাদের দেশে অভিভাবকদের তাদের মেয়েকে তড়িঘড়ি বিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে, কাজেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি ব্রেকআপটাই দেখেছি। আমরা প্রায় ষাটজনের মতো বন্ধু-বান্ধব আছি, শুধু সাজুই আমার ব্যাচের। আর বাকীরা হয় আমার চেয়ে এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ বছরের বড়, অথবা ছোট। এক সময় যেটা দেখতাম, আমার বন্ধু-বান্ধব শুধু 'ধাড়কান' ছবির গান শুনতো! বুঝতে পারছেন তাহলে আমাদের গ্রুপটা কোন লেভেলের গ্রুপ (হাসতে হাসতে)... এজন্য আমি বলি লাইফে আগে নিজের কিছু হওয়াটা জরুরী। আপনি যদি ট্র্যাকে থাকেন, প্রেম বলেন, সাফল্য বলেন, ধরা দিবেই। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনার কোনটা করা উচিৎ। 

-আপনি একজন সুখী বাবা। ইনশাআল্লাহ্‌ একদিন শ্বশুরও হবেন। মেয়ের জন্য কেমন জামাই এবং ছেলের জন্য কেমন বউ চাইবেন? এই প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য নিশ্চয়ই অনেকে মুখিয়ে আছেন... 

মাশরাফি: দেখেন, আল্লাহ্‌র রহমতে বিয়ের পর খুব বাজে রকম ডিফিকাল্ট সিচুয়েশন আমাকে ফেস করতে হয়নি। প্রত্যেক সংসারে খারাপ সময় আসে, আমারও এসেছে, একেবারেই আসেনি, তা না। আমি শুধু আমার ছেলে-মেয়ে না, সবার জন্য দোয়া করি যেন আমাদের সমাজটা সেটেলড হোক! আপনি খেয়াল করলে দেখবেন এখন প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই শাশুড়ি এবং বউয়ের মাঝে একটা প্রবলেম চলতেই থাকে। আমি বিশ্বাস করি দুই ক্ষেত্রেই যদি একটু স্যাক্রিফাইসিং টেন্ডেন্সি থাকে, তাহলেই আমাদের সমাজটা সুন্দর হবে, সুখের হবে। আমি আমার মেয়েকে সেভাবেই গড়ে তুলতে চাই যেন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি হোক ওই বাড়িই। আমার মেয়ে যেহেতু বড়, আমি যদি আমার মেয়েকে সেই মূল্যবোধে বড় করতে পারি, তাহলে আমার ছেলেও একইভাবে তার স্ত্রীকে সম্মান দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে বিবেচনা করবে। আমি যদি আমার সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেটার প্রাইস পাব নিশ্চয়ই!

-আলাদিনের চেরাগ পেলেন। তিনটা উইশ পূরণ হওয়ার সুযোগ। কী কী অপশন বেছে নেবেন? 

মাশরাফি: (একটু ভেবে)... আমার যদি সুযোগ থাকতো, তাহলে আমি প্রথমেই আল্লাহ্‌কে বলতাম যেন সবাইকে তিনি মাফ করে দেন এবং জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। সেকেন্ডলি চাইতাম, আমার বাবা-মা সবসময়ই হাসিখুশি থাকুক, সুস্থ থাকুক। আরেকটা জিনিস চাইতাম, আমার ছেলেমেয়ে যেহেতু বড় হচ্ছে, তারা যেন সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাস করতে পারে। অর্থকড়ি লাগবে না। 

-যারা হবু বাবা হতে চলেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ দিন। স্ত্রীর জন্য কতটুকু সাপোর্টিভ হওয়া উচিৎ, নিজেরও কী কী করা উচিৎ... 

মাশরাফি: এই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে গেলে একটু বড় হবে আসলে। আমার লাইফে প্রচণ্ড আনন্দ আছে, ট্র্যাজেডিও আছে। আমার মেয়ে যখন পৃথিবীতে আসে, ওর কেবল সাত মাস বয়স তখন। ওর বাম চোখের গ্রোউথ তাই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এখন ওকে হাই পাওয়ারের চশমা পড়তে হয়। এমনিতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এত পাওয়ারের চশমা! আমার খুব খারাপ লাগে। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে ঠিকও করতে পারছি না। তো আমার মেয়ে যখন হয়, আমার ওয়াইফ কিন্তু ক্লিনিক্যালি ডেডই ছিল। ১৩ দিন ছিল আইসিইউ-তে, ২৪ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে, প্লাজমা দিতে হয়েছে ৪-৫টা। ও শারীরিকভাবে ওই এক বছর ভীষণ অসুস্থ ছিল। এবং আল্লাহ্‌র কুদরত, আমি তখন ইনজুরড ছিলাম। তো অপারেশনের পরে বাসায় নিয়ে আসি দুইজনকেই। সারা রাত আমার স্ত্রীর যেন রেস্ট হয়, আমি আমার বাচ্চাকে কোলে রাখতাম, পায়চারি করতাম। তো সকাল হলে বাচ্চাকে ওর কাছে রেখে একটু ঘুমুতে যেতাম। তারপর ঘুম শেষে যেতাম প্র্যাক্টিসে। এভাবেই কেটেছে দিন। আমি হয়তো আদর্শ স্বামী নই, তবু এই উদাহরণটা দিলাম। কারণ স্ত্রীর প্রতি সাপোর্টিভ না হলে আপনি কেমন স্বামী হলেন? হয়তো একটু কষ্ট হবে, কিন্তু এতটুকু তো করতেই হবে। খেলার মাঠে অনেক চ্যালেঞ্জ উতরাতে হয়। কিন্তু সন্তানদের মানুষ করা- এটাই জীবনের সবচে' বড় চ্যালেঞ্জ। 

-এবার একদম ভিন্ন প্রসঙ্গ। লিওনেল মেসি যেভাবে অবসর নিলেন, সেটাকে ঠিক কীভাবে দেখেন? 

মাশরাফি: যদি আমাকে বলা হয় কোন স্পোর্টসম্যানের অন্ধভক্ত আমি, উত্তরটা হবে ডিয়েগো ম্যারাডোনা। যদিও আমি উনার খেলা দেখেছি ১৯৯০-তে, তখন আমার বয়স ৭ বছর। তখনকার খেলা আধো আধো মনে আছে। কিন্তু ১৯৯৪ বিশ্বকাপে রোমানিয়ার সাথে আর্জেন্টিনার জেতা ম্যাচটি, তারপর গ্রিসের সাথে ৫২ সেকেন্ডে গোল- এসব আমার স্পষ্ট মনে আছে। এরপর ভাবিনি ম্যারাডোনার মতো উন্মাদনা ছড়াবার মতন আর কেউ আসবে। তারপর এলো মেসি। আর্জেন্টাইন সমর্থক হিসেবে মেসির প্রতি স্বভাবতই একটা দুর্বলতা আছে। আমি বিশ্বাস করি, মেসি একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। ফুটবলেরই গ্রেটেস্ট প্লেয়ারদের মাঝে ওঁ একজন। মেসি রিটায়ারমেন্টে গিয়েছে, এটা তাঁর জায়গা থেকে অবশ্যই ভীষণ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত। তবে আমার মনে হয় এটা কিছুটা ইমোশনাল একটা ডিসিশন। ফাইনালের পর দেখেছিলাম ওঁ ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিল, ডাগআউটে গিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। ভীষণ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত। আসলে মানুষ তাঁর কাছ থেকে শিরোপা চায়। এখন দেখুন ইউসেবিও, পুসকাস, ডি স্টেফানো- তাঁরা কেউই কিন্তু শিরোপা জেতেননি। তাহলে কি তাঁরা গ্রেট নন? রোনালদোর ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা দেখি। ওঁর নিজেকে আর প্রুভ করার কি আছে? তবু দিনশেষে ওই শিরোপাই যেন ফ্যাক্টর! আমরা সমর্থক হিসেবে চাই, মেসি আরও খেলে যাক, তাকে মাঠে দেখতে পাওয়াটাই তো অসাধারণ ব্যাপার। আমার বিশ্বাস ওঁ ফিরে আসবে। -

আবারো প্রশ্নের ৩৬০ ডিগ্রী ইউটার্ন। ধরুন, ভাবিসহ শপিংয়ে বেড়িয়েছেন। আপনার একজন তরুণী ভক্ত আপনাকে হাঁটু গেড়ে ফুল হাতে ভালোবাসার প্রস্তাব জানালেন। আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে তখন? ভাবির প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে? 

মাশরাফি: এই ক্ষেত্রে আমরা ভীষণ কমফোর্টেবল! (অনেকক্ষণ ধরে হাসির ঢেউ) কখনো আসলে এমনটা হয়নি, হলেও আমি খুব সহজভাবে নেব। আমার স্ত্রীও নিঃসন্দেহে সহজভাবে নিতো। আজকে যেভাবে মানুষ মাশরাফিকে চেনে, আমার ওয়াইফ যদি সেরকম কিছু হতো, তাহলে সেও তো এরকম প্রস্তাব পেতে পারতো! তাই আমরা দুজনই খুব স্বাভাবিক এপ্রোচ করব। এবং তখন ওই তরুণীকে বলব, 'I accept your flower, but you know the reality' (আবারও হাসি) 

-এবার একটু সিরিয়াস প্রশ্ন। ধরুন, একজন তরুন পরিচালক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি সিনেমা বানাতে চাচ্ছেন। ছবিটি ভালোভাবে বানাবার মতো সামর্থ্যও তার আছে। কিন্তু ফিনেনশরের অভাবে সে মুভিটি বানাতে পারছে না। এখন পরিচালক চাইছেন একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে আপনাকে পেতে। ক্যারেক্টারটি আপনাকেই নাকি পোর্ট্রে করে!আবার আরেকটা ব্যাপারও আছে, আপনি ছবিটিতে অভিনয় করতে চাইলে দিনশেষে টাকা খরচ করার মতো মানুষেরও অভাব হবে না। আপনি কি রাজি হবেন প্রস্তাবে? 

মাশরাফি: প্রথমত আমি এ ধরণের কাজ আসলে করতে পারব না। অভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। আর আমি বিশ্বাস করি, একটা ভালো কাজ করতে হলে তারকা লাগবেই- ব্যাপারটা এমন না। দেখেন, মুক্তিযুদ্ধ অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমাদের কল্পনার বাইরে। এরকম একটি প্রেক্ষাপট নিয়ে একজন ছবি বানাতে চাচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না… তাহলে আমি আমার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে উনার পাশে দাঁড়াতাম। যতটুকু ব্যক্তি মাশরাফির পক্ষে সম্ভব, ততটুকুই। কিন্তু পাশাপাশি উনাকেও হাল ছাড়লে হবে না। রাইট প্ল্যানিং থাকতে হবে, রাইট টাইমিং হতে হবে, ধৈর্য থাকতে হবে। উনি যদি লেগে থাকেন, তাহলে সাফল্য একদিন ধরা দেবেই। 

-ক্রিকেটের মানুষ, কাজেই খেলা ছাড়ার পরও ক্রিকেট নিয়েই থাকবেন, এটা সবারই জানা। কিন্তু তারপরও সবাই কেন যেন একটা রোল ফিগার ভাবে আপনাকে, একজন আদর্শ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। খেলাধুলা ছাড়ার পর রাজনীতিতে আসার সুযোগ আছে কি? 

মাশরাফি: (কিছুক্ষণ ভেবে) আমার বইয়ের ইন্টারভিউটা (মাশরাফি) দেখে অনেকেই ভেবেছে আমার হয়তো রাজনীতিতে আসার ইচ্ছে আছে। দেখেন, আমি ক্রিকেট খেলি। এটাই আমার প্যাশন। যেদিন ক্রিকেট ছেড়ে দেব, সেদিন থেকেই চেষ্টা করব বাংলাদেশের ক্রিকেট আমাকে যা দিয়েছে, তার কিছুটা হলেও প্রতিদান দেবার। এই যে আপনি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, এর কারণ তো ক্রিকেটার মাশরাফিই! আল্লাহ্‌ যদি আমাকে সুস্থ রাখেন, বাঁচিয়ে রাখেন- তাহলে কিছু করতে চাই দেশের ক্রিকেটের জন্য। এটাই আমার প্রথম লক্ষ্য। আর রাজনীতির কথা বলতে গেলে আমি বারবারই একই কথা বলি, রাজনীতিবিদরাই পারেন দেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে, আমরা ক্রিকেটাররা না। এটাই ধ্রুব সত্য। দেশের প্রতিটি সেক্টরই কিন্তু রাজনীতিবিদদের হাতে। এমনকি আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের অভিভাবকও একজন রাজনীতিবিদ। তাই আমি বিশ্বাস করি তাঁরা চাইলে দুই-তিন বছরের মাঝে দেশের সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এখন আমি যদি বলি, ‘কাল কী হবে, তা তো আমরা কেউ বলতে পারি না’- এর অন্য কোনো অর্থ ভেবে নেবেন না কেউ। আমি বরাবরই নিজের কথায় সৎ থাকতে চাই। তাই পরিস্কার করেই বলছি, আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে আপাতত শুধু ক্রিকেটই। এটাই আমার ধ্যানজ্ঞান। 

-কৌশিক, পাগলা, গুরু- আপনার নামের পাশে মোটামুটি এইগুলোই শোনা যায়। কোনটি ভালো লাগে শুনতে? 

মাশরাফি: বাবার দেওয়া নাম কৌশিক। এটাতেই বেশি কমফোর্ট লাগে। 

-কমফোর্টের কথা যখন আসলোই, তাহলে জেনে নেওয়া যাক কোনটা বেশি কমফোর্টেবল? জিন্স-টিশার্ট? নাকি লুঙ্গি-গেঞ্জি? 

মাশরাফি: কমফোর্টের কথা যদি বলেন, অবভিয়াসলি লুঙ্গি! পৃথিবীর সবচে’ কমফোর্টেবল জিনিস! 

-আর ট্রান্সপোর্টেশন? রিকশা, গাড়ি, ট্রেন, প্লেন, বাইক- কোনটা? 

মাশরাফি: ভ্যান, রিকশা, মোটরবাইক (মুখে হাসি)...মানে এগুলোর মতো কমফোর্ট আর কোনো কিছুতেই নেই। আর সবচেয়ে ডিসকমফোর্টেবল হলো প্লেন। একদমই ভালো লাগে না। 

-অনেকেই তো আপনার পাগলা কিসিমের সমর্থক। আপনি কার পাগলা সমর্থক? 

মাশরাফি: ডিয়েগো ম্যারাডোনা। 

-পেছনে ফিরে তাকালে কোন অপূর্ণতা আপনাকে গ্রাস করে? 

মাশরাফি: আপনি হয়তো বলতে পারেন কখনো টেস্টে ৫ উইকেট পাইনি। কিংবা খেলাধুলা রিলেটেড আরও কিছু। কিন্তু তা নয়। আমার ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা ছিল আমার নানীর। নানী না থাকলে আমি কখনোই ক্রিকেটার হতে পারতাম না। অথচ আমার ইন্টারন্যাশনাল ডেব্যুর কিছু দিন আগেই আমার নানী মারা যান। তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাকে ন্যাশনাল টিমের জার্সিতে দেখলে কতই না খুশি হতেন! আবার আমি ছোটবেলা থেকেই অংকে খুব কাঁচা ছিলাম। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমি সব সাবজেক্টেই ৯৫-৯৮ মার্কস পেতাম, কিন্তু অংকের কারণে পিছিয়ে যেতাম, রোল চলে আসতো দশের ঘরে। এরপর নানা আমাকে অংক করাতেন। যেদিন আমি অংকে ১০০ পেলাম, রেজাল্টশিট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি...নানা রিকশা থেকে নেমেই বমি করা শুরু করলেন। পুরো ঘর ভেসে গেল বমিতে। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে, হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন, মারা গেলেন। আমি জন্মের পর থেকে এই দুজন মানুষের কাছে বড় হয়েছি, ঘুমাতামও নানা-নানীর মাঝখানে। আমার দুইটা আনন্দের দিনে কাউকেই পাশে পাইনি, তাঁদের এই প্রাপ্তির কথা জানাতে পারিনি। তারপর আমার নানীর আপন ছোট বোন, আমেরিকায় থাকেন, কখনো তাঁর সেবা করার সুযোগ পাইনি। তিনি আমার খরচ চালাতেন। সুযোগ পেলে তাঁর সেবা করব ইনশাআল্লাহ্‌। 

-সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আপনার ভক্তদের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই আসলে। এমনও হয়েছে অনেকেই তাদের লিগামেন্ট দিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন আপনাকে। পাগলা সমর্থকদের এরকম ভালোবাসা কেমন উপভোগ করেন? 

মাশরাফি: উপভোগ না আসলে, আমি ফিল করতে পারি এই ভালোবাসা। মেডিক্যালি এই লিগামেন্ট রিপ্লেস করা কখনোই সম্ভব না। কিন্তু এই ভালোবাসা…(কিছুটা থমকে) অদ্ভুত লাগে। আমি বিনীতভাবে কৃতজ্ঞ সবার কাছে।

-শেষ প্রশ্ন। আমাদের মতো তরুণদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী? 

মাশরাফি: গত দুই বছর ধরে একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঘুরছে। আমাদের ইয়াং জেনারেশন কী না পারে! এই যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করে সফল হলো! আমাদের স্বাধীনতার পূর্বের ইতিহাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তরুণ সমাজ যে যৌক্তিক দাবি আদায়ে নেমেছে, সবগুলোতেই সফল হয়েছে। এখন দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ভেজাল খাবার। এই দিকটায় আমরা তেমন একটা জোর দেই না। আল্টিমেটলি কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইয়াং জেনারেশনই। যাদের বয়স ৩৫-৪০ পার হয়ে গেছে, আমার মতো বুড়ো হয়ে গেছে (হাসি), তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু আমার বাচ্চাদের জেনারেশনও সেই ছোটবেলা থেকে ফিজিক্যালি-মেন্টালি অসুস্থ হয়েই বড় হচ্ছে। ওরা যে দেশের জন্য কিছু করবে, আমার তো ধারণা ওদের ৫০% এবিলিটিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! লিভার থেকে শুরু করে কত প্রবলেম হচ্ছে নিজের অজান্তেই। আমি জানি না কখনো সম্ভব হবে কিনা...তবে একটা অনুরোধ, ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে একটা সোশ্যাল মুভমেন্টে যাওয়া দরকার আমাদের। একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার, মনিটরিং দরকার। যার যার জায়গা থেকে সবার এগিয়ে আসা দরকার। সমন্বিত পদক্ষেপই পারে এই সমস্যা দূর করতে। এই দিকটায় তরুণ সমাজ নজর দিলে এটাও সলভ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

ফরমালি সাক্ষাৎকারপর্ব শেষ। আরও কিছু খুনসুটি, আরও কিছু সিরিয়াস কথা শেষে একবারে বিদায় নেওয়ার পালা। হুট করে মাশরাফি নিজ থেকে আবার বলা শুরু করলেন- ‘এই যে মানুষের ভালোবাসা, আমি টের পাই প্রবলভাবে। আজকে শপিংয়ে বের হয়েছিলাম, ঝাঁকে ঝাঁকে সবাই এসে বলা শুরু করলো, ‘‘গুরু, সেলফি…!’’ এখন কয়জনের সাথে ছবি তুলব বলেন? পরে শেষ পর্যন্ত চলে আসতে হলো। আমার খারাপ লাগলো খুব। সবাই কত আশা নিয়ে আসে ছবি তোলার জন্য! কিন্তু অবাক করা ব্যাপার কী জানেন? অধিকাংশই শুধু সেলফি তুলতে আসেন, তারপর সেলফি তুলেই চলে যান! কেউ জিজ্ঞেসও করেন না, ‘‘ভাই কেমন আছেন?’’ অথচ আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমিও নিশ্চয়ই তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করতাম! সবাই কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। আমিই হয়তো ব্যাকডেটেড হয়ে গেছি!’ . . . 

বিদায় নেওয়া হয়ে গেছে। মাশরাফির সামনে থেকে উঠে চলে এসেছি। আর মনে মনে ভাবছি, এইজন্যই বোধহয় মাশরাফি আর সবার চেয়ে ভিন্ন! একবার মনে হবে নড়াইলের আঞ্চলিক সুরে কথা বলছেন, আবার মনে হবে এত স্পষ্টভাবে কাউকে কথা বলতে শুনেছি কখনো! একবার মনে হবে মাশরাফি আমাদের মতো তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করেন, আরেকবার মনে হবে মাশরাফি একেবারেই দুরন্ত এক কিশোর, আবার পরক্ষনেই মনে হবে এই মাশরাফির মাঝে একজন অভিভাবকের ছায়া প্রবলভাবে বিদ্যমান! মাশরাফি মানেই প্রবল ঘোর, বিশুদ্ধ মনের অদ্ভুত এক মানুষ। আমাদের নেতা, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের স্বপ্নসারথি…তিনি কেবলই একজন মাশরাফি বিন মর্তুজা! *


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা