তিতাসের দুর্নীতি, খামখেয়ালিপনার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের দুর্ঘটনাকবলিত মসজিদটি অবৈধভাবে জমি দখল করে বানানো হয়েছিল কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন...

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ এবং এসি বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা তেইশ ছুঁয়েছে ইতিমধ্যেই, সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে, আহতদের অনেকের অবস্থাই আশংকাজনক। দুর্ঘটনার পর বেশ কিছু অভিযোগ সামনে এসেছে, তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হচ্ছে, ছয় মাস আগেই গ্যাস লাইন লিকেজের কথা তিতাস গ্যাসকে জানানো হয়েছিল। কিন্ত সমস্যার সমাধানের জন্য তিতাসের কর্মকর্তারা নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন, মসজিদ কমিটি সেটা দিতে না পারায় লিকেজ সারানো হয়নি, গ্যাস বেরিয়ে মসজিদটাই আস্ত একটা গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে প্রাণ হারিয়েছে এতগুলো নিরীহ মানুষ, এখনও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে অনেকে, ধ্বংস হয়ে গেছে কতগুলো পরিবার! 

তবে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির পাশাপাশি আরও একটা দিকে নজর ফেরানোটা বোধহয় খুব দরকারী। ঘটনাস্থল ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুল সালাত জামে মসজিদ পরিদর্শনে গিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু প্রশ্ন তুলেছেন, মসজিদ নির্মাণে রাজউকের কোনো অনুমতি নেই। রাস্তা ঘেঁষে কিভাবে মসজিদ গড়ে তোলা হলো? গ্যাস লাইনের ওপরেই বা মসজিদ বানানোর অনুমতি দিলো কে? বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর এই প্রশ্নগুলোর সূত্র ধরে আমাদেরও জানতে ইচ্ছে হয়, বায়তুল সালাত নামের এই মসজিদটা কি তবে অবৈধ জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে? 

'অবৈধ জায়গায় মসজিদ'- এই তিনটা শব্দ পড়েই ক্ষেপে উঠবেন না দয়া করে। যদি সার্ভে করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে মোট যতগুলো মসজিদ আছে, তার মধ্যে ২০-২৫ শতাংশই অবৈধ জায়গায় বানানো। মফস্বল বা গ্রামে অন্যের জায়গা দখল করে, বা যে জমির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা আছে, সেখানে মসজিদ বানিয়ে ফেলাটা অনেক পুরনো প্র‍্যাকটিস। মসজিদ আল্লাহর ঘর, তার ইবাদতের জন্যেই মসজিদ বানানো হয়। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, এদেশের অন্য সব সেক্টরের মতো মসজিদ বানানোতেও দুই নম্বুরি উদ্দেশ্য ঢুকিয়ে ফেলেছি আমরা, স্রষ্টার ইবাদতের চেয়ে অন্যের জমি দখল করা কিংবা প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যেও এদেশে অজস্র মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। 

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

শুধু দখল বা প্রভাব বিস্তার নয়, সরকারী বা পতিত জমি দখল করে মসজিদ বানানোর পেছনে ব্যবসাটাও অনেক জায়গায় মূখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে। খেয়াল করলে দেখবেন, অনেক মসজিদ সংলগ্ন মার্কেট থাকে। বই-খাতা-স্টেশনারীর দোকান থেকে শুরু করে মুদি দোকান, ফার্মেসি থেকে মোবাইল রিচার্জ বা মোবাইল ব্যাংকিং- সব ধরণের দোকান থাকে এসব মার্কেটে। বলছি না সবগুলোই অবৈধ জায়গায় নির্মাণ করা, বা সব মসজিদ মার্কেটেই ধান্ধাবাজি চলে; কিন্ত অনেক জায়গায় এসব দোকানের ভাড়া কারা আদায় করে, কার পকেটে টাকা যায়- এটা একটা রহস্য, প্রশ্নের জবাব মেলে না।

কোথাও কোথাও আবার দখলকারীরা নিচতলায় দোকান ভাড়া দেয়, দোতলায় মসজিদ বানায়, তার ওপরে বানায় মাদ্রাসা। তারা চিন্তা করে, যেহেতু মসজিদ-মাদ্রাসা আছে, তাই তা কেউ এগুলো ভাঙ্গতে পারবে না, উচ্ছেদও করতে পারবে না। কারণ এদেশের মানুষ ধর্মভীরু, মসজিদ ভাঙার বা উচ্ছেদের কথা বললেই ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগবে। আর এটাকে পুঁজি করে এভাবেই সারাজীবন একদল লোক অন্যের সম্পদ ভোগ করতে থাকে। 

পুরো ব্যাপারটাই কিন্ত দারুণ একটা ব্যবসা হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুদের জন্য। জায়গা দখল করে মসজিদের কাজ শুরু করাটাই বাকি, এরপরে ইনভেস্ট বলতে চাপার জোর। অমুক জায়গায় মানুষের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ বানানো হচ্ছে শুনলে অবস্থাসম্পন্ন যে কেউই সাহায্য করতে রাজী হবে, আপনিও হবেন। আপনাদের দানের টাকায় বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে যাবে, যার নিচে দোকান, ওপরে মসজিদ, তারও ওপরে মাদ্রাসা। এই ব্যবসা কিন্ত চলমান, মসজিদের দানবাক্সে টাকা জমা পড়বে, দোকানের ভাড়া আসবে, মাদ্রাসার ছাত্রদের বেতন তো আছেই। ভূমিদস্যুরা এসব মসজিদ কমিটির নেতার পদও দখল করে রাখেন, যাতে ব্যবসার রাশটা হাতছাড়া না হয়। এধরণের মসজিদ আশেপাশে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। 

মসজিদে নববীর জায়গার বিনিময়ে বাজারমূল্য পরিশোধ করেছিলেন মহানবী

অথচ ইসলামে বলা আছে, মসজিদ নির্মাণের জন্য মসজিদের নামে স্বেচ্ছায় জমি ওয়াকফ হওয়া জরুরি। তাই তো মদীনার দুইভাই মহানবী (সা) কে মসজিদে নববীর জমি বিনামূল্যে উপহার হিসেবে দিতে চাইলেও তিনি সেটা গ্রহণ করেন নি। নবীজি (সা) জমির মূল্য বাজারদর অনুযায়ী পরিশোধ করার পরই মসজিদ নির্মাণ করেছেন। সৈয়দ আমির আলী লিখেছেন, ‘যে জমির ওপর মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, তা ছিল দুই ভাইয়ের মালিকানাধীন। জমিটি তারা দান করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তারা ছিল এতিম, তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের জমির মূল্য প্রদান করেছিলেন।’ (দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, অনূদিত, পৃষ্ঠা ১১৭)

জবরদখলি জমিতে মসজিদ নির্মাণ করলে সেটি শরিয়তের বিধান মতে মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে না। এই বিষয়ে বিজ্ঞ মুফতিদের ফতোয়া হলো, ‘কারো মালিকানাধীন জমিতে জোরপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ নেই। মসজিদ নির্মাণ করতে হলে নির্ভেজাল জমি মসজিদের নামে ওয়াক্ফ হওয়া জরুরি। ওয়াকফবিহীন জমিতে মসজিদ নির্মাণ করা হলে সেটা শরয়ি মসজিদ হবে না। যদি কোনো জমির মালিক তাঁর জমি ওয়াক্ফ করতে রাজি না হন এবং জোরপূর্বক তাঁর জমিতে মসজিদ নির্মাণ করা হয়, তাহলে ওই মসজিদ ভেঙে জমি তার মালিককে ফেরত দিতে হবে। কোনো জমিতে মালিকের অনুমতি নিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হলে তাতে নামাজ পড়া জায়েজ হবে। অনুমতি ছাড়া মসজিদ নির্মাণ করা হলে তাতে নামাজ পড়া মাকরুহ হবে।' (ফাতওয়া হিন্দিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৪৮; রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৯০; আদদুররুল মুখতার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৮১)

তিতাসের দুর্নীতি, খামখেয়ালিপনার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের দুর্ঘটনাকবলিত মসজিদটি অবৈধভাবে জমি দখল করে বানানো হয়েছিল কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদি সেরকম কিছু হয়, তাহলে মসজিদ বানানোর পেছনে কারা জড়িত ছিল, রাজউক বা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কেন এসবের দেখভাল করেনি, সেটাও যাচাই করা প্রয়োজন। ছয়টা এসি স্থাপনের মতো প্রয়োজনীয় জায়গা মসজিদের ভেতরে ছিল কিনা, না থাকলে কার নির্দেশে এতগুলো এসি লাগানো হয়েছে- বের করতে হবে সেসব তথ্যও। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, অবশ্যই এখানে ইবাদতের জন্য মসজিদ অবশ্যই বানানো হবে। কিন্ত অবৈধ জায়গায় বিপজ্জনকভাবে মসজিদ বানিয়ে সেটাকে মৃত্যুকূপে পরিণত করার অধিকার কারো নেই, এই বার্তাটাও স্পষ্টভাবে দিতে হবে সবাইকে...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা