চাইলেই পারতেন পরিবার নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে। সেটা না করে ম্যাথিউস নিজের কাঁধে তুলে নিলেন দেশের লাখো অসহায় মানুষের দায়িত্ব। সেদিন ম্যাথিউস না থাকলে লক্ষাধিক ভারতীয় প্রবাসীর কী হতো, কেউ জানে না। ম্যাথিউসের এই ঘটনা নিয়ে এয়ারলিফট নামে একটা সিনেমাও হয়েছে বলিউডে...

২ আগস্ট, সাল ১৯৯০। আনুমানিক মধ্যরাতের সময় হঠাৎ করেই পার্শ্ববর্তী কুয়েতের সীমান্ত অতিক্রম করে সুবিশাল বহর নিয়ে ঢুকে গেল ইরাকি সেনাবাহিনী। রাতের আচমকা অনভিপ্রেত ঝড়ে প্রায় হতভম্ব কুয়েতের একুশ লক্ষ নাগরিক। ভোরের আলো যখন জানালায়, সরকারি রেডিও তখনো বেজে চলেছে। পুরো বিশ্বের নিকট সাহায্যের জন্য আকুতির বার্তা চলছে ক্রমাগত। যুদ্ধ স্থায়ী হয় মাত্র দুদিন। প্রথমে সীমান্তবর্তী এল-সামিতাহ, ধীরে ধীরে পুরো কুয়েতই মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে ইরাকের। 

সাদ্দাম হোসাইন এর সোজাসাপ্টা অভিযোগ ছিল, কুয়েত অবৈধ প্রক্রিয়ায় ইরাকের সীমানায় প্রবেশ করে তেল চুরি করে চলেছে৷ যদিও পরবর্তী সময়ে তা কেবলই অজুহাত হিসেবে প্রমাণিত। পরাজিত কুয়েত সৈন্য ও অধিবাসীরা শরণার্থী হিসেবে বাহরাইন, সৌদি আরবে আশ্রয় নেয়। কুয়েতের আমির পালিয়ে সৌদি আরবের রাজপরিবারে আশ্রিত হোন, তাঁর ভাইকে গুলি করে হত্যা করে হত্যা করে ইরাকি সৈন্যরা। সাদ্দাম হোসেন কুয়েত-কে ইরাকের উনিশতম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু কুয়েতবাসী থেমে থাকেনি। ধীরে ধীরে প্রতিরোধ যুদ্ধেরও চেষ্টা চালায় তারা।

সুতরাং নতুনভাবে উপসাগরীয় যুদ্ধ দানা বাঁধতে শুরু করলে এমতাবস্থায় তৈরি হয় আন্তর্জাতিক সংকট। ঠিক এই পরিস্থিতিতে কুয়েতে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লক্ষ। একে তো যুদ্ধবিদ্ধস্ত পরিস্থিতি, এর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি খাদ্যসংকটসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন তারা।

ভারতের দক্ষিণের কেরালা রাজ্যের ম্যাথুনি ম্যাথিউস, ওই সময়েরও প্রায় বছর ত্রিশেক আগে ভাগ্য বদলের আশায় কুয়েতে পাড়ি জমিয়ে গাড়ি ব্যবসায় নামেন। কয়েক বছর ঘুরতেই, দারুণ কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি করতে সমর্থ হন তিনি। পরিণত হন ব্যবসায়িক টাইকুনে। কিন্তু এতটুকুতে তাঁর অবস্থান সীমাবদ্ধ ছিল না। কুয়েতে আগত ভারতীয়দের প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা প্রদান, বিভিন্ন বিষয়ে পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা তাঁকে নিজ দেশের কমিউনিটির কাছে চমৎকার গ্রহণযোগ্যতা পাইয়ে দিয়েছিলো। অচিরেই কুয়েত সরকারেরও আশীর্বাদপুষ্ট হন ব্যবসায়ী ম্যাথিউস৷ 

সাদ্দাম হোসেনের ইরাকী বাহিনী আচমকা আক্রমণ করেছিল কুয়েতে

বলে রাখা ভালো, সময়ের পরিক্রমায় ম্যাথিউস নামটা বদলে গিয়ে, 'টয়োটা সানি' নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেন তিনি। কুয়েতের 'ইন্ডিয়ান স্কুল' এর চেয়ারম্যান, 'ইন্ডিয়ান আর্ট সার্কেল' এর প্রতিষ্ঠাতাসহ বেশ কিছু দেশীয় কমিউনিটির সংগঠনকে তিনি সামনে থেকে প্রতিনিধিত্ব করতেন। এমনকি নিজ রাজ্য কেরালা থেকে অসংখ্য পরিচিত, আত্মীয়স্বজনকে তিনি কুয়েতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের চাকরিও দিয়েছিলেন।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো বটে, কিন্তু উপসাগরীয় যুদ্ধের দামামার ভয়ংকর আর্তনাদ বাড়ির আঙিনায় এসে পৌঁছালে বড় ধাক্কাটা লাগলো ম্যাথিউসের গায়েও। নিজের পরিবারকে রক্ষার পাশাপাশি, ম্যাথিউস শুধু মানবিক নয় বরং দেশপ্রেমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেশের মানুষের প্রতি প্রচন্ড দায়বদ্ধতা অনুভব করলেন। চাইলেই ম্যাথিউস নিজের পরিবার নিয়ে কুয়েত ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারতেন। কিন্ত নিজের দেশের লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুভয়ে কাতর, এদেরকে এভাবে একা ছেড়ে তিনি বিশেষ সুবিধায় স্বদেশ কিংবা অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যেতে পারলেন না। বুঝতে পারলেন, পুরো কমিউনিটিকে বাঁচানোর স্বার্থেই বড়কিছু করে দেখাতে হবে।

সময় যত গড়াচ্ছিলো, পরিস্থিতি আরো ভয়াবহতার দিকে মোড় নিচ্ছিলো। কারণ ইতিমধ্যেই প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে ভূখন্ড ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলো কুয়েত। পাশাপাশি কুয়েতে ভারতীয় হাই কমিশন বলেও কিছু অবশিষ্ট আর ছিল না। অন্যান্য সমস্যা তো ছিলই। অগত্যা সকল ঝুঁকি মোকাবেলা করে সমস্যা সূত্রপাতের প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পরে ইরাকের বাগদাদে রওনা হলেন তারা। গন্তব্য ছিল ভারতীয় হাই-কমিশন। তাঁর সাথে ছিলেন আরো দুই ভারতীয় ব্যবসায়ী হরভজন বেদী, থমাস চান্দি এবং ছেলে জেমস।

অবশেষে ইরাকের ভারতীয় হাই কমিশনারের সাথে জরুরি আলাপ শেষ করে ভারতীয় সরকারের নিকট সাহায্য চেয়ে তারা আবার কুয়েত ফিরে আসেন। কিন্তু কুয়েতে বিপত্তি বেড়েই চলছিলো। ক্রমশঃ খাবার ও পানি ফুরিয়ে চলেছে। জায়গার অভাব দেখা দেয়ায়, ইন্ডিয়ান স্কুলেই নিজেদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করলেন তারা। যথাযথভাবে ক্যাম্পের সব কার্য পরিচালনা ও অন্যান্য শরণার্থীদের সহায়তা প্রদানের জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হয়৷ এদিকে বসরা বন্দরে একটি ভারতীয় জাহাজের মাধ্যমে কিছু ভারতীয়কে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুজরাল কুয়েতের পরিস্থিতি একটি ঝটিকা সফরের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে এসে নিজের সঙ্গে কিছু ভারতীয়কে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু সমগ্র বিবেচনায় এই সংখ্যা ছিল অতি নগন্য।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন ম্যাথিউস (ডান থেকে দ্বিতীয়)

তাই ভারত সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো জর্ডান বর্ডারের মাধ্যমে ভারতীয়দের প্রাথমিকভাবে বিপত্তি থেকে উত্তরণের মাধ্যমে নিরাপদে আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার৷ এই সুযোগটা লুফে নিতে ভুলেননি ম্যাথিউস। বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন। নিজে গাড়ি ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে জর্ডান ও ইরাককেন্দ্রিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীদের সাথে চমৎকার সম্পর্ক ছিল ম্যাথিউসের। তিনি পুরোপুরিভাবে নিজের দীর্ঘ পরিশ্রমে বানানো সংযোগগুলোকে কাজে লাগান। 

তিনি একইসাথে ইরাকি ট্রান্সপোর্টার, ভারতীয় কতৃপক্ষ ও জাতিসংঘের সাথে সমঝোতা করেন এভাবে যে, বাগদাদ থেকে বিমানযোগে জর্ডানের রাজধানী আম্মান-এ ভারতীয়দের নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর সেখান থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে শরণার্থীরা। আর বাগদাদ পর্যন্ত যেতে ২০০ টি বাসের ব্যবস্থা করেন। প্রতিটি বাস ১০ টি করে ট্রিপ দিবে, ৬০ জন করে যাবে। এজন্য একেকটি বাসকে প্রতিবার পাড়ি দিতে হয়েছিলো প্রায় ১২০০ কিলোমিটার! 

এর মধ্যেও বিভিন্ন জায়গায় পিক-আপ পয়েন্ট, কিভাবে যথাযথ নিরাপত্তা দেয়ায় বাস কতৃপক্ষকে টাকা প্রদান (যাদের একেবারেই ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পুরো খরচ কমিটিই বহন করে), পাসপোর্টে স্টাম্পিং এসব কার্য পরিচালনার স্বার্থে তৈরি করা কমিটিই কাজ করতে থাকে। এভাবেই অস্বাভাবিক ও ঝুঁকিপূর্ন পরিকল্পনাগুলোকে ধৈর্য্যের সাথে ধারবাহিকভাবে পূর্ণতা দেন ম্যাথিউস। বলে রাখা ভালো, ভারতীয় সরকার, জর্ডান সরকার, জাতিসংঘ ও পরবর্তীতে সাদ্দাম হোসেনের সরকারও এই বিষয়ে আন্তরিক ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি ম্যাথিউসের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন হরভজন বেদী, টনি জাসনামাল, কে.টি.বি মেনন, আলি হুসেনসহ কুতে-ইরাক-জর্ডান কেন্দ্রিক আরো অনেক প্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।

অবশেষে ১৮ আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর অবধি ভারতীয় পতাকা সম্বলিত ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনের ৪৮৮ টি ফ্লাইট মুম্বাই থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার দূরে জর্ডানের রাজধানী আম্মান-এ উড়ে যায় এবং ভারতীয়দের ফেরত আনা শুরু করে৷ এভাবে প্রায় ৬৩ দিন এই 'এয়ারলিফটিং' চলে, এতে এক লক্ষেরও বেশি কুয়েত প্রবাসী ভারতীয় নিরাপদে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। পুরো ঘটনাটি কেবল আশ্চর্যজনক এবং অসম্ভব বাস্তবতাকেই অতিক্রম করেনি, বরং গিনেস বুকের রেকর্ডেও জায়গা করে নিয়েছিলো।

এই ঘটনা নিয়ে বলিউডে নির্মিত হয়েছে এয়ারলিফট সিনেমাটা

হ্যাঁ, ম্যাথিনু ম্যাথিউস। সিনেমার চিত্রনাট্যও ১৯৯০ সালের পূর্বে এভাবে কেউ কখনো ভেবে দেখেছে কিনা জানি না। নিজের ভাগ্য বদলের আশায় কুয়েত যাওয়া এক সাধাসিধে লোক, আজকেও ভারতীয়দের কাছে ত্রাতার মর্যাদা পান। ২০১৬ সালে অক্ষয়কুমার এর 'এয়ারলিফট' এই ঘটনারই একধরনের সিনেম্যাটিক প্রতিচ্ছবি৷ এমন সুবিশাল ঘটনার জন্ম দেয়ার পরেও, একজন ত্রাণকর্তা বা বীরের ভূমিকায় নয় বরং ম্যাথিউস নিভৃতেই জীবনযাপন করে গেছেন। 

ভারত এমন এক দেশপ্রেমিকের প্রতি ঋণী হয়ে থাকলেও, ম্যাথুনি ম্যাথিউসের কাছে আমৃত্যু বিষয়টি কেবলই দেশের মানুষের প্রতি অগাধ দায়িত্ববোধের দৃষ্টান্ত ছিল যা তিনি পরিপূর্ণভাবে করতে পেরেছিলেন৷ এমন সৌভাগ্যবান বটে কয়জন আছেন, যারা বাস্তবিক অর্থেই দেশের জন্য সিনেমা বা কমিক্সের সুপারহিরো চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা