দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যেখানে ট্রাকে ভরে কুকুরগুলোকে ফেলে দিয়ে আসছে ঢাকার বাইরে, সেখানে উত্তরের মেয়র জানালেন, এমন অমানবিক কিছু তারা করবেন না। কুকুর বন্ধ্যাত্বকরণের পথেই হাঁটবেন তারা...

ঢাকার রাস্তা থেকে কুকুরদের ই অজ্ঞান করে বা জাল দিয়ে ধরে ট্রাকে তোলা হচ্ছে, তারপর সেগুলোকে ফেলে আসা হচ্ছে ঢাকার বাইরে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল্ডে। কাজটা করা হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে। ট্রাকে বসেও কুকুরগুলো চোখে বিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে, তাদের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, সেটা তারা বুঝতেই পারছে না। কিংবা মানুষকে তারা বন্ধু মনে করে, দুটো বিস্কুট খাইয়ে বিশ্বাস জিতে নেয়া মানুষদেরই একটা অংশ যে তাদের আপদ ভাবছে, সেটা তারা জানে না। 

প্রাণীপ্রেমীদের প্রবল আপত্তি স্বত্বেও নিজেদের অবস্থানে অটল থেকেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। কুকুর বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্পের দিকে না হেঁটে বেওয়ারিশ কুকুরদেরকে শহরছাড়া করাটাই তাদের কাছে সহজ কাজ বলে মনে হয়েছে। অথচ যেখানে নিয়ে ফেলা হচ্ছে কুকুরগুলোকে, সেখানে তাদের পর্যাপ্ত খাবারর ব্যবস্থা নেই। না খেয়েই মারা যাবে অবলা এই প্রাণীগুলো। এ যেন মাথার ব্যথায় মাথা কেটে ফেলারই নামান্তর। কুকুর নিধনের সপক্ষে একদল আবার রাস্তায়ও নেমেছে, প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানববন্ধন করেছে! তাদের ভাবগতি দেখলে মনে হয় এই শহরের সব সমস্যার গোড়া বুঝি বেওয়ারিশ কুকুরেরাই! 

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে ধন্যবাদ, দক্ষিণের মতো নির্মম পথে তিনি হাঁটবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। কুকুর নিধন বা অপসারণ না করে তারা বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচী চালাবেন বলেও জানিয়েছেন মেয়র আতিক। এজন্য উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ‘অভয়ারণ্য’ নামে একটি এনজিও’র সঙ্গে আগের করা চুক্তি নতুন করে নবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এভাবেই ট্রাকে তোলা হচ্ছে বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে

বাংলাট্রিবিউনে মেয়র আতিকের সাক্ষাৎকার পড়লাম। অবলা প্রাণীগুলোর জন্য দরদ আর আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি, কুকুর স্থানান্তর যে সমাধান নয়, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন- "আমাদের মহাখালীতে যে মার্কেট রয়েছে, সেখানে কুকুরের জন্য আমরা একটা হাসপাতাল করেছি। আমি নিজেও করোনার সময় বিভিন্ন স্থানে কুকুরকে খাবার দিয়েছি। আমি এখনও তাদের জন্য খাবার পাঠাচ্ছি। আমরা মনে করি, কুকুরকে স্থানান্তর করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের ২০১৯ সালের আইনে কুকুর বা বন্যপ্রাণীকে কীভাবে দেখতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে।"

মেয়রের কথায় উঠে এসেছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার কথা, তিনি বলেছেন- "কুকুর আমাদের অনেকের বাসাবাড়ি ও রাস্তার সামনে থাকে। এটা কিন্তু পরিবেশের ব্যালেন্স রক্ষা করে। ইঁদুরসহ ক্ষতিকর অনেক প্রাণী মেরে ফেলে। অনেক অপরিষ্কার জায়গাকে পরিষ্কার করে। আবার অপরিষ্কারও করে। আমি যেটা মনে করি, কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করতে হবে। তাদেরকে জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিতে হবে। ‘অভয়ারণ্যে’ সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি ছিল সেটার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আমরা আবারও চুক্তিতে যাচ্ছি।"

উত্তরের মেয়র নগরবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন, লুকোছাপা না রেখে সরাসরিই তিনি বলেছেন- "আমার মেসেজ খুবই স্পষ্ট—আমাদের উত্তর সিটিতে কোনও ধরনের কুকুর উচ্ছেদ বা অপসারণ বা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হবে না। যদি কোনও নাগরিক তা করে, তাহলে আমরা ২০১৯-এর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।"

মেয়র আতিকুল ইসলাম

মেয়র আতিক যেটা করেছেন, মানবিক যে কোন জনপ্রতিনিধিরই সেটা করার কথা। এই শহরটা শুধু মানুষের নয়, এই শহরে মানুষের যতটা অধিকার, ততটুকুই অধিকার আছে গাছপালার, কুকুর-বেড়াল কিংবা পাখিদেরও। কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেছে, খাবার না পেয়ে উৎপাত করছে- এই অজুহাতে কুকুরদের শহর থেকে তাড়ানোটা অমানবিক একটা কাজ, যেটা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন করে চলেছে। 

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলেছে তাদের কাছে বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প চালিয়ে নেয়ার ফান্ড নেই। অথচ দিনে ত্রিশটি করে ৭ দিনে ২১০টি কুকুর সরানোর জন্য খরচ হিসেবে ৫৯৫০০ টাকার অগ্রিম ভাউচার করা হয়েছে! এই টাকাটা কুকুরগুলোকে বন্ধ্যা করার জন্য খরচ করা যেতো না? দক্ষিণের মেয়র বলেছিলেন, জনগণের দাবীর কারণেই নাকি তারা কুকুর অপসারণ করছেন! হাজার হাজার মানুষ যে কুকুর অপসারণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন, এখনও জানাচ্ছেন, তারা কি জনগণ নন?

নানা সময়ে মেয়র আতিকের সমালোচনা করেছি, যখন তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে চা দোকানে বসে 'চা গরম! চা গরম!' বলে হাঁক দিয়েছিলেন, তখন এই হাস্যকর কাজের প্রতিবাদ করেছি। করোনার সময় বেসিন স্থাপন করতে গিয়ে জনসমাগম করায় সেই কাজের সমালোচনা করে লিখেছি। কিন্ত আজ যখন মানবিক এক জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি ঢাকা শহরে মানুষ আর নিরীহ পশুর সহাবস্থান ঘটাতে চাইছেন, নিজের এলাকার কুকুর নিধন বা অপসারণ না করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি চালাবেন বলে জানাচ্ছেন, তখন তার প্রতি জন্ম নেয়া শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাটা প্রকাশ না করলে অন্যায় হবে। সমালোচনা যে করতে পারে, ভালোবাসার কথা জানানোর অধিকারও তারই আছে... 

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- বাংলাট্রিবিউন

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা