সত্যিই কি ময়ূরাক্ষী নদীর অস্তিত্ব আছে? নাকি ময়ূরাক্ষী নামক কাল্পনিক নদী কেবল হিমুদেরই থাকে!

হিমু সিরিজের প্রথম বইটির নাম ময়ূরাক্ষী। স্কুলে হিমুকে একটি নদীর নাম জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে আড়িয়াল খাঁ। শুনেই জিওগ্রাফির মাস্টার মফিজ মিয়া, যে বিভিন্ন বিচিত্র নামের থাবড়া মারার জন্য বিখ্যাত, তিনি মারাত্মক ক্ষেপে যান। হিমুকে একটা থাবড়া দেন। পরে অবশ্য মন গলে। তখন তিনি হিমুকে একটি সুন্দর নদীর নাম বলতে বলেন। হিমু বলে, ময়ূরাক্ষী। স্যার বলেন, এই নামে কি কোনো নদী আছে? জানি না স্যার, হিমু উত্তর দেয়। স্যার মারা যাওয়ার পর হিমু এই নদী স্বপ্নে দেখতে পায়। নদীর অপূর্ব দৃশ্য তার মনে গেঁথে যায়। এরপর সে চেষ্টা করলে যখন তখন ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে চলে যেতে পারে, কল্পনায়। 

এই হলো সারকথা। এরপর ময়ূরাক্ষী হয়ে গেলো হিমুর একক সম্পদ। ময়ূরাক্ষী নামক কাল্পনিক নদী কেবল হিমুদেরই থাকে। পাঠকরাও কল্পনায় ময়ূরাক্ষী দেখে হিমুর সাথে সাথে। কিন্তু ময়ূরাক্ষী নদীটির জন্ম হয়েছিলো বহু আগেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কাল্পনিক ময়ূরাক্ষী নদীটির উল্লেখ করেন একটি গল্পে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ খুব বেশি একটা লেখেননি। মাত্র তিনটি উপন্যাস, দুটি গল্পগ্রন্থ আর কিছু নাটক, প্রবন্ধ মিলিয়ে তার সাহিত্য জীবন। কিন্তু অল্প লিখেও বেশ ভালো নামডাক করেছেন লেখক হিসেবে। বিশেষ করে, তার লালসালু উপন্যাসটির জন্য অধিক পরিচিতি পান। 

নয়নচারা (১৯৪৫) তার প্রকাশিত প্রথম গল্প-গ্রন্থ। এই গ্রন্থে নয়নচারা নামের একটি গল্পে ময়ূরাক্ষী নদীর কথা পাওয়া যায়। গল্পটির প্রথম দুই লাইন এরকম, "ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ূরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। কিন্তু মনের চরে যখন ঘুমের বন্যা আসে, তখন মনে হয় ওটা সত্যিই ময়ূরাক্ষী..." আরো একটি লাইন বলছি গল্পটা থেকে- “তবে, ঘুমের স্রোত সরে গেলে মনের চর শুষ্কতায় হাসেঃ ময়ূরাক্ষী! কোথায় ময়ূরাক্ষী! এখানে-তো কেমন ঝাপসা গরম হাওয়া। যে-হাওয়া নদীর বুক বেয়ে ভেসে আসে সে-হাওয়া কি কখনো অত গরম হতে পারে?” 

নয়নচারা গল্পগ্রন্থটি ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। তখন লেখক ওয়ালিউল্লাহ’র বয়স মাত্র ২৩। তার ঠিক ৪৫ বছর পর একাত্তর পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিমু সিরিজের প্রথম বই বের করেন। বইটির নাম ময়ূরাক্ষী। ওয়ালিউল্লাহ’র ময়ূরাক্ষী আবার কল্পনায় ফিরে এসেছে হিমুর হাত ধরে, তবে গল্পগত আর কোনো মিল নেই তাদের মধ্যে। যদিও বাংলা সাহিত্যের আরো একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র তারাশংকর তার তারিণী মাঝি গল্পেও ময়ূরাক্ষী নদীর কথা বলেছিলেন। তার গল্প থেকে একটি লাইন তুলে দিচ্ছি-

“আষাঢ় মাস। অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে ফেরত যাত্রীর ভিড়ে ময়ূরাক্ষীর গনুটিয়ার ঘাটে যেন হাট বসিয়া গিয়াছিলো...”

তারাশংকরের ময়ূরাক্ষী অবশ্য কাল্পনিক নয়। ময়ূরাক্ষী নদীর নামটিকে কল্পনায় যেমনটা ব্যবহার করেছিলেন ওয়ালিউল্লাহ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ। কৌতূহলী পাঠকদের কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে আসলেই কি এমন কোনো নদী বাস্তবে আছে কিনা? পাঠকদের জন্য বলছি, বাস্তবে ময়ূরাক্ষী নামে নদী আছে।

ময়ূরাক্ষী শব্দের অর্থ হলো ময়ূরের চোখ। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বয়ে যায় যার নাম ময়ূরাক্ষী। তবে বাঙ্গালী পাঠকমাত্রই ময়ূরাক্ষী নদীটিকে কল্পনায় দেখে অভ্যস্ত। আর এই কল্পনায় একটা গোটা নদীর তীরে বসে নিজেকে শীতল করার বুদ্ধি শিখিয়েছেন সাহিত্যিকরাই। তাই বাস্তবের নদীর চেয়ে কল্পনার নদীর শক্তি অনেক, বলাই যায়। 

এত তথ্য লিখার একটা কারণ হচ্ছে, লেখক হতে গেলে যে মস্তবড় পাঠক হতে হয় সেই ব্যাপারটির গুরুত্ব বোঝানো। লেখক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা আসলে রাতারাতি ঘটে যাওয়া কোনো জাদুকরী ঘটনা না। কোনো তাবিজ কবজের বলেও এটি ঘটেনি। তার প্রস্তুতি ছিলো খুব প্রাকৃতিক। তিনি প্রচুর বই পড়েছেন এক জীবনে। শুধু একজনের লেখা না, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের বই পড়েছেন। যেমন মধ্যবিত্তজীবন নিয়ে লেখা তার প্রথম মাস্টারপিস দুটি বই নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সোমেন চন্দ্রের ছোটগল্প ইঁদুর পড়ে। হিমুর প্রথম বইয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন ওয়ালিউল্লাহ'র কাল্পনিক নদী ময়ূরাক্ষীকে। এর মানে হচ্ছে, আপনি যত পড়বেন তত নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা পাবেন। আপনাকে আইডিয়া দিয়ে সাহায্য করবে আপনার পাঠ্যাভ্যাস।

আমাদের জন্য একটি দারুণ শিক্ষণীয় ব্যাপার হতে পারে এটি। বিশেষ করে আমরা যারা হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়লে আর কাউকে লেখকই মনে করতে চাই না, কিংবা অন্য সবাই ভারী লেখক, শুধু হুমায়ূন আহমেদ সস্তা রচনা লিখেন এই ধারণা পোষণ করি তাদের বোঝা উচিৎ। একজন হুমায়ূনের মতো 'সস্তা' হওয়া সহজ কথা নয়। এর জন্য কি পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে সেটা কল্পনাও করা যাবে না।

অনেকে লেখালেখিকে কোনো পরিশ্রমের কাজ মনে করে না। বিশেষ করে এই ফেসবুক জমানায়। সত্যি বলতে, আপনি যত ভিন্ন ভিন্ন লেখকের লেখা পড়বেন তত নতুন নতুন আইডিয়া পাবেন। এবং আশ্চর্য হবেন লক্ষ্য করে, কিছু কিছু কমন ব্যাপার থাকে লেখকদের। তারা একজন আরেকজনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে, অনুপ্রাণিত হয়। যে লেখকরা তাদের লেখা দিয়ে পাঠকের আত্মা মন প্রাণ জুড়িয়েছেন, তারা সবাই প্রচুর পরিশ্রমী। প্রচুর পড়েছেন। কিন্তু আমরা পাঠকরাই কেমন যেন। নিজেদের এক ঘরে করে রাখতে চাই। এটা সাহিত্যের জন্য সুখকর নয়। এভাবে সাহিত্যের মোহময় জগতের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য থেকে আমরা নিজেদের বঞ্চিত রাখি। অথচ, পাঠকের মন আরেকটু উদার হলেই সাহিত্যের আসল স্বাদ পাওয়া সম্ভব। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা