নয়তলা বাড়ির বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে চাইছে এক ব্যক্তি। খবরটা শুনেই আলী ছুটলেন তাকে বাঁচাতে, মানুষের ভীড় ঠেলে চলে গেলেন লোকটার কাছে। তারপর?

মোহাম্মদ আলীকে আপনি কি হিসেবে চেনেন? একজন লিজেন্ড হিসেবে, তার উক্তির জন্য, একজন সফল বক্সার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে যে রিংয়ের মধ্যে প্রত্যেকবার প্রতিপক্ষকে কাবু করে? কিন্তু, একজন মোহাম্মদ আলী শুধু একজন সফল খেলোয়াড়ই নন, তিনি তার চেয়েও বেশি কিছু৷ মোহাম্মদ আলীর অনেক উক্তি আমাদের জানা। অনেক গল্প আমাদের জানা। তার একটা অন্যরকম গল্পও আছে৷ যে গল্পটি খুব বেশি প্রচলিত নয়, তবে এই গল্প আপনাকে মোহাম্মদ আলীর অন্য একটি দিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। 

ঘটনাটা ১৯৮১ সালের৷ সেবছর মোহাম্মদ আলী এমন একজন মানুষকে বাঁচান, যে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। লস এঞ্জেলেসের একটা বাড়ির নয়তলায় এই নাটকীয় ঘটনার অবতারণা হয়। নয়তলার জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে মানুষটা আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কেউ কেউ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হচ্ছে৷ কেউ ভয়ে কাছেই এগুচ্ছে না। এমন একটা পরিস্থিতি। 

মোহাম্মদ আলীর কাছে এই খবরটা জানালেন তার বন্ধু হোয়ার্ড বিংহাম। ঘটনা শুনে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। তার মনে হলো এই মানুষটাকে বাঁচানোর দরকার। একটা মানুষ নিজে নিজে মরে যাওয়ার চেষ্টা করছে এই খবর শুনে তিনি চেষ্টা করবেন না কিছু করার, এই বোধ তাকে পীড়া দেবে। কিন্তু, তিনি কি সময়মতো যেতে পারবেন স্পটে? পারবেন কি লোকটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলার আগেই কিছু করতে? আলী জানেন না। জানতেন না আসলে কি করা দরকার। তার কেবলই মনে হলো, তাকে যেতে হবে। তিনি হুট করেই বেরিয়ে পড়লেন।

তার রোলস রয়েস গাড়িটাকে পাগলা ঘোড়ার মতো ছোটালেন। এমনকি রাস্তার রঙ সাইডে ঢুকে পড়লেন, এমন ভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন যেন তিনি রেসে নেমেছেন। হয়ত আজন্মই হারতে না চাওয়া মোহাম্মদ আলীর কাছে এটা একটা রেসই। কিন্তু এই রেসটা প্রতিপক্ষ নক আউট করে বিজয়ী হওয়ার রেস না, এটা তার চেয়ে বড় কিছু। 

মোহাম্মদ আলীর মতো একজন মানুষ নিজে আসবেন, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। কেনই বা আসবেন? তার কি দায় পড়েছে? কত লোকে মারা যায়! তাতে বিখ্যাতদের কি আসে যায়। কিন্তু, আলীর তখন মাথায় এভারেজ বিখ্যাত মানুষের মতো এতো কিছু ছিল না ভাবনায়৷ তার মাথায় শুধুই একটা চিন্তা। একটা লোক আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে, নিজে হেরে যেতে চাইছে, তাকে হারতে দেয়া যাবে না। 

আলীর মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা- লোকটাকে বাঁচাতে হবে

শুধু বোধহয় বাংলাদেশে না, পৃথিবীর সব জায়গায় এই ব্যাপারটা আছে- অতিউৎসাহী লোকের ভীড়। যাদের কাজ নেই, যাদের দায় নেই, যাদের মনুষ্যত্ব নেই, যাদের কিছু করার মুরোদ নেই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া। লস এঞ্জেলেসের সেই জায়গাও সেই নাটকীয় ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ায় কিছু লোক জমে গিয়েছিল। তারা উত্তেজিত, কি হবে কি হবে একটা কৌতূহল নিয়ে তারা অধীর আগ্রহে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। এছাড়া আর কি ই বা করার আছে। 

যে লোকটা মারা যাবে বলে পণ করেছে, তার নাম জো। সে বলছিল চিৎকার করে, আমার দ্বারা ভাল কিছু সম্ভব না। আমি আত্মহত্যাই করব। এখান থেকে ঝাপ দিব। সেই লোকটা নয়তলায় চারঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল। একটা গল্প তৈরি হতে যাচ্ছে, এটা নিয়ে আজ শহর কথা বলবে, সেই গল্পে নিজেরাও ছিলেন, দেখেছেন, গল্পের স্বাক্ষী হয়েছেন এই জন্যই এমন মানুষেরা ভীড় জমান। 

লস এঞ্জেলেসের সেই নয়তলা বাড়ির সামনে যখন স্বয়ং মোহাম্মদ আলী এলেন, ভীড় জমানো লোকেরা পাগল হয়ে গেল। তারা একটা মানুষের মরে যাওয়ার চেয়ে মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে মাতামাতি করার একটা চেষ্টা দেখাল। আলীর নাম ধরে জনতা চিৎকার করছিল। কিন্তু মোহাম্মদ আলী এখানে তালি পেতে আসেননি। তিনি জনতাকে এড়িয়ে দ্রুত উঠে গেলেন বাড়ির সিঁড়িতে। 

নয়তলার যে খোলা জানালায় লোকটা আত্মহত্যা করবে বলে দাঁড়িয়ে আলী তার পাশের জানালায় দাঁড়ালেন এবং সেই মানুষটিকে অনুরোধ করতে থাকলেন সে যেন আত্মঘাতী না হয়। মোহাম্মদ আলী বললেন, "হেই, তুমি জানো তুমি আমার ভাইয়ের মতো। আমি ভালবাসি তোমাকে এবং আমি তোমাকে এক বিন্দুও মিথ্যা বলছি না। তোমাকে শুনতে হবে, তুমি শুনো দয়া করে। আমি তোমাকে আমার সাথে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আমার কিছু বন্ধুর সাথে তোমাকে পরিচয় করে দেব।"

তিনি বলেন, 'তুমি আমার ভাইয়ের মতো'

সেই মানুষটা বললো, "কেন আপনি আমায় নিয়ে ভাবছেন? আমি নোবডি৷ আমি কেউ না।" আলী সেখান থেকে ফিরে আসলেন না। তিনি সেই মানুষটাকে বোঝাতে থাকলেন, সে 'নোবডি' এটা সত্য নয়। এই পৃথিবীর সেও একটা অংশ। তারও বেঁচে থাকা জরুরি। এভাবে সে আত্মঘাতী হতে পারে না। মোহাম্মদ আলী বুঝানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। 

২০ মিনিটের মধ্যে আলী সেই আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করা জো'কে বুঝাতে সক্ষম হলেন। তিনি তাকে নিয়ে নিচে নেমে আসলেন এবং দেরি না করে মানুষটাকে নিজের গাড়িতে বসালেন। হাসপাতালে জো'য়ের প্রাথমিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা করলেন। এমনই মানুষ ছিলেন মোহাম্মদ আলী। সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন মানুষ বোধহয় এমনই হয়। আসলে, মোহাম্মদ আলীই দ্যা ট্রু পিপলস চ্যাম্প! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা