মীরাবাঈ ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত, মনসুর আল হাল্লাজ ছিলেন আল্লাহ ভক্ত। অথচ একই সুর, একই ভাষা। এই গানে সেই কথাও বলে, এক থা সাজান মন্দির মে, অর এক থা প্রীতম মসজিদ মে।

রাজস্থানের রাজপুত বংশের রাজকন্যা ছিলেন মীরা কিংবা মীরাবাঈ। তাঁর বিবাহ হয় রাজস্থানেরই মেওয়ার রাজ্যের রাজপুত্রের সাথে। মীরাবাঈ ছিলেন প্রচন্ড কৃষ্ণভক্ত। জানা যায়, কৃষ্ণভক্তির কারণে শ্বশুরগৃহে তাকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো। দিল্লীর সুলতানদের সাথে যুদ্ধে তাঁর স্বামী, এবং মুঘল সম্রাট বাবরের সাথে যুদ্ধে তার পিতা ও শ্বশুর মৃত্যুবরণ করেন। এরপর রাজা হন বিক্রম আদিত্য। 

বিক্রম ও তার পরিবার মীরাবাঈকে অনেকবার হত্যা করবার চেষ্টা করে। কখনও ফুলের বাকশো বলে সাপ ভর্তি বাকশো প্রেরণ করে, কখনও বা মধু/ফলের রস এর বদলে বিষভর্তি পাত্র প্রেরণ করে। বলা হয়, প্রতিবারই তা কৃষ্ণের মুর্তিতে পরিণত হয়ে যেতো, তার কোন ক্ষতি হতো না। এক সময় রাজা বিক্রম আদিত্য তাকে ডুবিয়ে মারতেও চেষ্টা করেন, প্রতিবারই মীরা ভেসে উঠতেন। এক সময় মীরা রাজদরবার ত্যাগ করে বৃন্দাবন চলে যান। রচনা করেন কৃষ্ণস্তুতি। সেই কৃষ্ণস্তুতিই আজ মানুষের মুখে মুখে ভজন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ বলেন মীরা স্বাভাবিক মৃত্যু লাভ করেছিলো, কেউ বলে মীরা কৃষ্ণের মুর্তিতে মিলিয়ে গিয়েছিলো।

'সাসো কি মালা পে' নামের এই গানটা মীরাবাঈ এর রচিত। এই গান জনপ্রিয় হয়েছে জগত বিখ্যাত এক মুসলমান কাওয়ালী শিল্পীর কণ্ঠে, উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান। কী অদ্ভুত, কী সুন্দর তার কথা! সিমরু অর্থ আমরা যে জিকির করি, দমে দমে খোদার নাম নেই। বলছে, এটাই আমার বন্দেগী, এটাই আমার পূজা। এই গান শুনতে শুনতে আমার মনে চলে আসে সুফী সাধক মনসুর আল হাল্লাজের কথা। যিনি আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে চলে গিয়েছিলেন ফানা ফিল্লাহ স্তরে, যে স্তরে খোদার সাথে তার বান্দার আর কোন দুরত্ব থাকে না। তিনি বলতেন, আ'নাল হক, অর্থাৎ আমিই পরম সত্য।

মনসুর আল হাল্লাজ

প্রথমে তাকে কারাবাসের দণ্ড দেয়া হয়, পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তার পা কাটা হয়, তিনি হাসিমুখে বলেন, জান্নাত থেকে আমি আর মাত্র এক কদম দূরে। পারলে সেই পা কাটো। তার হাত, পা, মাথা কেটে ফেলার পরে সে অঙ্গ থেকেও বলতে থাকে, আ'নাল হক অর্থাৎ আমিই পরম সত্য। তাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়া হয়, সে ভস্ম সাগরে ভাসিয়ে দিলে জোয়ার উঠে, সে জোয়ার থেকে আওয়াজ আসে, আ'নাল হক, আমিই পরম সত্য। মৃত্যুর আগে তাকে এক সুফি জিজ্ঞেস করেছিলেন, প্রেম কি? তিনি বলেছিলেন, তুমি আজ, কাল আর পরশু, তা নিজের চোখেই দেখবে।

মীরাবাঈ এর গানে উঠে আসে তেমনই কথা, প্রেমের রঙে আমি এমনই রঙীন যে দুজনেই হয়ে যায় একই নুর। সেই ফানা ফিল্লাহ, খোদা প্রেমের সর্বোচ্চ স্তরের কথা। মীরাবাঈ ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত, মনসুর আল হাল্লাজ ছিলেন আল্লাহ ভক্ত। অথচ একই সুর, একই ভাষা। এই গানে সেই কথাও বলে, এক থা সাজান মন্দির মে, অর এক থা প্রীতম মসজিদ মে।

এ গানে বলে, খোদার কোন দোষ নেই, খোদা নির্দোষ। নিজেকে নিজে চিনতে চিনতেই আমি আমাকে চিনি, আমার রিপুকে চিনি। কেউ যদি এই গান শুনে মনে করে, এটা মানবপ্রেমের কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে, সে কি ভুল ভাবে? মানুষের কলবেই কি ঈশ্বরের বাস না? মানুষেরে ভালোবাসাতেই কি ঈশ্বরকে ভালোবাসা না? খোদাকে ভালোবাসা না?

সাসো কি মালা পে সিমরু মে, পি কা নাম। রমজানে মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে শিখুক। এই চরম বিপদে মানুষ মানুষেরে ভালোবেসে পাশে দাঁড়াক। ভালোবাসার উপরে আর কোন সত্য নাই। 

কথা বলুন নিঃসংকোচে

প্রিয় পাঠক, করোনার এই দিনগুলিতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হতেই পারেন আপনি। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক- বা অন্য কিছু। আপনার সমস্যার কথা জানান আমাদের, আমরা চেষ্টা করব সেটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করার, যাতে বেরিয়ে আসে সমাধানের পথ।

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা