গ্ল্যামারের জন্যে আমাদের নায়িকা বা মডেল হয়তো দরকার, কিন্ত এর চেয়ে বেশি দরকার মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার মতো মানুষের, যারা যেকোন বিপদে-বিপর্যয়ে সবার আগে এগিয়ে আসবেন জাতির ত্রাণকর্তা হয়ে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের টেলিভিশন, প্রিন্ট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, তার নাম ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি একজন রোগতত্ত্ববিদ এবং পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এই ভদ্রমহিলা। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হচ্ছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে সবশেষ আপডেট জানাচ্ছেন, সতর্ক থাকার উপায় বাতলে দিচ্ছেন, দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন সচেতনতার বার্তা।

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার এই ভূমিকা কিন্ত এবারই প্রথম নয়। এর আগেও তাঁকে দেখা গেছে চিকুনগুনিয়ার সময়, জিকা ভাইরাসের আক্রমণের সময়টাতেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন দুর্যোগে তিনি এগিয়ে এসেছেন সাহসের সঙ্গে, মানুষের কাছে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছেন বার্তাগুলো, সবাইকে অভয় দিয়েছেন বরাবর। এখন তো তিনি আমাদের প্রতিবেশীর মতোই হয়ে গেছেন, তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।

জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়টায় মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ায় যখন ছেয়ে গিয়েছিল ঢাকা শহর, তখনও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। করোনাভাইরাসের মহামারী ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে, এখনও ফ্রন্টলাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেব্রিনা ফ্লোরা। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষদের একজন তিনি, সারাক্ষণই খোঁজ খবর রাখতে হচ্ছে তাঁকে, আপডেট দিতে হচ্ছে মিডিয়াকে। নতুন করে কারো মধ্যে করোনার সংক্রমণ দেখা দিলেই সেটা জানাচ্ছেন তিনি, সবকিছু সামলাচ্ছেন দক্ষ হাতে, চমৎকারভাবে। রাষ্ট্র আর জনগনের মাঝখানে আরও একবার সেতুবন্ধন রচনা করছেন মীরজাদা সেব্রিনা ফ্লোরা।

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে, নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলীটা সেখানেই আয়ত্ব করেছেন তিনি। প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কাটতে তিনি শিখেছিলেন ঢাকা মেডিকেলের ডরমিটরিতে কাটানো দিনগুলোতেই। জড়িত ছিলেন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও। কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাশ করার পরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করেছিলেন। পরে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, যেটাকে এখন সবাই ‘নিপসম’ নামে চেনে- সেখান থেকে রোগতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করে তিন বছর গবেষণা করেছেন। তিনি নিপসমে সহকারী অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন দেশের বাইরে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি।

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে ২০১৬ সালে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পাবার পর তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মহামারী সৃষ্টিকারী ভাইরাস ও রোগ বিস্তার প্রতিরোধে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গবেষণা করেন। সেব্রিনা ফ্লোরা পরিচালক হবার পরে সংস্থাটির কাজে অন্যরকম একটা গতি এসেছে, নিরসন হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে লেগে থাকা অনেক জটিলাবস্থার। তার তত্ত্বাবাধানেই ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে জিকা ভাইরাস, মধ্য প্রাচ্যের শ্বাসযন্ত্রের সিন্ড্রোম সম্পর্কিত ভাইরাস এবং অতি সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী প্রতিরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অপ্রতুল ব্যবস্থাপনার মধ্যেও তিনি এবং তার দল ২০১৭ সালে বাংলাদেশে চিকনগুনিয়া প্রতিরোধে কাজ করেছেন, সফলতাও পেয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলন করছেন মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ইন্টারন্যাশনাল এসাসিয়েশন অব দ্য ন্যাশনাল পাবলিক হেল্‌থ ইনস্টিটিউটের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ফাউন্ডেশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের একজন সম্মানিত ফেলো তিনি। মানুষের জন্যে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই বাস করছে তার ভেতরে, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারলে খুশি হন তিনি। করোনার উপদ্রবের এই দিনগুলোতে তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, সারা দেশের মানুষ সবশেষ তথ্য জানার জন্যে তাকিয়ে থাকছে তার দিকে। এটাকে অবশ্য চাপ হিসেবে নিচ্ছেন না মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা, তার ভাষায়-

‘একজন রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি নিজে থেকেই এক ধরনের তাড়না বা চাপ বোধ করছি। কারণ এই গোটা বিষয়টি আমাদেরসহ সমগ্র পৃথিবীর জন্যই বেশ উদ্বেগের। যেহেতু আমরা এখন পর্যন্ত নিরাপদে আছি, আমাদের বাড়তি সচেতনতা খুব জরুরি।’

আমাদের দেশে কিশোরী বা তরুণী মেয়েরা নিজেদের আইডল হিসেবে মানে জনপ্রিয় নায়িকাদের, তারা মডেলদের অনুসরণ করে, তাদের মতো আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারী হতে চায়। অথচ মানুষের জন্যে, দেশের জন্যে অকাতরে কাজ করে যাওয়া মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাদের অবদান যে হাজার হাজার নায়িকা বা মডেলের চেয়ে কোটিগুণ বেশি- সেটা আমরা ভুলে যাই। বিপর্যয়ের দিনগুলোতেই তাদের কথা শুধু মনে পড়ে, নইলে সারা বছর কে রাখে সেব্রিনা ফ্লোরাদের খোঁজ? গ্ল্যামারের জন্যে আমাদের নায়িকা বা মডেল দরকার হয়তো, কিন্ত এর চেয়ে বেশি দরকার মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার মতো মানুষের, যারা যেকোন বিপদে সবার আগে এগিয়ে আসবেন জাতির ত্রাণকর্তা হয়ে। আয়রন লেডি বলতে তো সেব্রিনা ফ্লোরাদেরকেই বুঝি আমরা!

Featured Image Credit- Ice Today


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা