শিশুর যৌনশিক্ষা, কিছু প্রচলিত ধারণা ও আমাদের করণীয়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আপনার শিশুর উপর যে যৌন নিপীড়ন হবে না, সেই বিষয়ে আপনি কখনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। তাই 'আমার শিশু নিরাপদে আছে, থাকবে' ভাবনা বাদ দিয়ে শিশুটি যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনার মুখোমুখি না হয়, সেটি নিশ্চিত করুন। জেনে নিন আপনার করণীয়।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত- এ কথাটি আমরা সবাই জানি। শিশুর প্রথম শিক্ষা শুরু হয় তার নিজ পরিবার থেকে। সামাজিক আচরণ, কথা বলা, আদব কায়দা- সবই একটি শিশু তার পরিবার তথা বাবা, মা, ভাই ,বোন ও অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে শেখে। অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি শিশুর যৌনশিক্ষা বা সেক্স এডুকেশন নিয়ে আমরা কিছু ক্ষেত্রে খুবই অনুৎসাহী। আমরা অনেক সময়ই ভেবে নিই শিশুর কোমল মনে এ ধরনের শিক্ষা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুকে সঠিক বয়সে সঠিক যৌন শিক্ষা না দিলে তারা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়, এমনকি যৌন নিগ্রহের স্বীকার হয়- তা অভিভাবকদের বোঝা উচিত এবং এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার আপনি এখন আপনার শিশুকে যা জানাতে সংকোচ বোধ করছেন, একদিন তা সে অন্যের কাছ থেকে জানবে, যার মধ্যে থাকবে ভুল-ভ্রান্তি-অভিনয়-কুসংস্কার- মিথ্যা। অনেক সময় এ সম্পর্কে বাচ্চাটি জানতে জানতে অনেক বেশী দেরী হয়ে যাবে, তাই আপনার উচিত নিজ দায়িত্বে সঠিক কাজটি সঠিক উপায়ে সঠিক সময়ে নিঃসঙ্কোচে করা।
শিশুরা সাধারণত অনুকরণপ্রিয় হয়। তাই শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য জৈবিক ও পরিবেশের সমন্বিত সহায়তা প্রয়োজন। প্রাকৃতিকভাবেই শিশুরা বেড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে মেধা ও মননে। শিশুর এই মানসিক বিকাশ অনেকখানিই নির্ভর করে তার পরিবেশ-পরিবার-পরিচর্যার ওপর। তাই শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশে অভিভাবকদেরও কিছু দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে।
শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে বাবা-মায়ের আচরণ, পারিবারিক পরিবেশ এবং শারীরিক সুস্থতা খুবই জরুরী। আপনার শিশুর উপর যে যৌন নিপীড়ন হবে না, সেই বিষয়ে আপনি কখনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। প্রতিটা শিশুই যৌন নিপীড়নের ঝুঁকিতে থাকে। আপনার শিশু কখনো যৌন নিপীড়নের শিকার হবে না এমনটা আশা করে কিংবা ভেবে থাকলে তা আপনার শিশুর উপর যৌন নিপীড়নের আশঙ্কা কমাবে না, বরং যদি তারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তখন তারা কীভাবে সাহায্য লাভ করবে সেই সম্পর্কে আপনার প্রস্তুতি থাকবে না।
শিশু যৌন নিপীড়নের বাস্তবতা খুবই ভয়াবহ, কিন্তু প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত বাস্তবতা মেনে নিয়ে যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে শিশুকে এ সম্পর্কে ধারণা দেয়া এবং তাকে সচেতন করা।
আমরা সবাই সাধারণত এই ধারণাই করি যে, পরিচিতদের কাছে আমার শিশু সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে , ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তার খুব কাছের পছন্দের মানুষগুলোর দ্বারা। বাংলাদেশে বোধহয় এমন মেয়ে বা ছেলে খুব কমই পাওয়া যাবে যারা শিশুকালে তাদের নিকটাত্মীয়দের (প্রতিবেশি, মামা-চাচা-দেবর-দুলাভাই-খালু-ফুফা-কাজিন ) দ্বারা যৌন নিপীড়নের (স্পর্শ-টিজ-আকার ইঙ্গিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চাওয়া-জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা-ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি) শিকার হয়নি।
এই যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো শিশুরা সাধারণত কারো কাছে প্রকাশ করে না বা পরিবারের কাউকে জানালেও লোকলজ্জার ভয়ে তা পরিবার থেকেই ধামাচাপা দেওয়া হয়। কাজেই এই সম্পর্কগুলো নিয়ে খুব সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
শিশু যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে প্রচলিত কিছু কথা
১। আমার বাচ্চাকে যৌনতার বিষয়ে জানালে সে তার শিশুসুলভ সরলতা হারিয়ে ফেলবে।
২। যেহেতু আমি জানি আমার শিশু কখনোই যৌন নির্যাতনের শিকার হবে না, সেহেতু তাকে এই বিষয়ে জানানোর প্রয়োজন নেই।
৩। অপরিচিতরাই যৌন নিপীড়ন করে থাকে।
৪। খালি পুরুষেরাই শিশুদের ধর্ষণ করে।
৫। আমার শিশুর ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটলে সে আমাকে বলবে কারণ সে সব কথা আমাকে বলে।
৬। আমার শিশুর উপর এমন কিছু ঘটবে না।
৭। যৌন নিপীড়নকারীরা দেখতে ভয়ংকর ও কুৎসিত হয়।
৮। শিশু যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে শিক্ষা দিলে শিশুরা ভয় পাবে,তাই এই বিষয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়।
৯। শুধুমাত্র সমকামী ছেলেরাই ছোট ছেলেদের কষ্ট দেয়।
১০। আমার পরিবারে এরকম কিছু ঘটবে না।
১১। যৌন নিপীড়ন একটি পারিবারিক ব্যাপার এবং সেই অনুযায়ী এটার ব্যবস্থা নিতে হবে।
১২। শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পেলে শিশু সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবে, তাই এসব ঘটনা ধামাচাপা দেয়া উচিত।
আমাদের করণীয়
১। প্রথমেই এই ধারণা ভেঙ্গে ফেলুন যে যৌনশিক্ষা আপনার শিশুর শৈশব কেড়ে নেবে। বরং এটা তাদের আরো বেশি আত্নবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলবে।
২। কোন কিছু বাচ্চাদের বুঝানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হলো সেই বিষয় সম্পর্কিত চিত্র বা কোনো ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে দেখানো। ঠিক একই ভাবে শিশুকে তার নিজের শরীরের সাথে পরিচয় করাতে হবে এবং ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো সম্বন্ধে তার বয়সোপযোগী করে বুঝিয়ে বলতে হবে।
৩। ৩-৮ বছরের বাচ্চাদের সাথে সাধারণত যৌন নিগ্রহের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। তাই এটিই উপযুক্ত বয়স তাদেরকে এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলার ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়ার। যত দ্রুত তাদের এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলা যাবে ততই মঙ্গল।
৪। যৌন নির্যাতনকারী কেবল অপরিচিত ব্যক্তিই হবেন- এটি একটি সম্পুর্ণ ভুল ধারণা। ৮৫% ক্ষেত্রেই দেখা যায় নির্যাতনকারী আমাদের খুব কাছের বা পরিচিত কেউ হয়। শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে আত্নীয় বা বাইরের যে কেউ হোক, অনাকাংখিত আচরণ করলেই সাথে সাথে এসে বাবা বা মাকে এ বিষয়ে বলতে হবে।
৫। যৌন নির্যাতন বাচ্চাদের মনস্তত্ত্বে মারাত্নক প্রভাব ফেলে। খুব চঞ্চল ও হাসিখুশি শিশু যদি হঠাত চুপচাপ হয়ে যায়, পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে, খিটখিটে মেজাজী হয় বা অল্পতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে তাহলে তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। একাকী আদর করে কথা বলুন তার সাথে, অভয় দিন।
৬। বাচ্চা আপনার সাথে সব শেয়ার করে তার মানে এই নয় যে সবসময় পরিস্থিতি একই রকম থাকবে। বেশিরভাগ বাচ্চারাই যৌন নির্যাতনের পর বাবা-মাকে বলতে পারে না সংকোচের কারণে। বড় হবার সাথে সাথে শিশুর সাথে হৃদ্যতা বাড়ান। ভরসা ও আশ্রয়স্থল হয়ে উঠুন। শুধু পড়াশোনার না, নিয়মিত খবর নিন তার মনের।
৭। শিশুর কথাকে গুরুত্ব দিন। শিশুরা সাধারণত সত্যি কথা বলে। শিশু বলে তার কথাকে স্রেফ উড়িয়ে দিলে পরবর্তীতে সে আর কোন কথাই আপনার কাছে বলতে আসবে না।
৮। বাসায় কোন আত্নীয় এলে তার সাথে নিজের বাচ্চাকে শুতে দেবেন না একই বিছানায়।
৯। শিশু কারো কাছে যেতে না চাইলে তার অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিন এবং সহজভাবে প্রশ্ন করে কারণ জেনে নিন।
১০। যদি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেই যায়, কোনভাবেই শিশুকে দোষারোপ করবেন না। তাকে অভয় দিন এবং বলুন যে তার কোন দোষ নেই এতে। সে যেন কোনভাবেই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। হাসিখুশি থাকুন।
১১। শিশুকে বলুন, এ ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা ঘৃণিত। যাদের সাথে এ ধরনের অপরাধ ঘটে তাদের উচিত বাবা-মাকে সংকোচ না করে সবটা বলা।
১২। প্রয়োজনবোধে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে শিশুকে কাউন্সিলিং করান।
আপনার সন্তানের সুরক্ষার বিষয়টি আপনার উপরেই নির্ভর করে। সন্তানকে 'না' বলা শিখাতে হবে, অপ্রয়োজনীয় এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধ স্পর্শগুলোর প্রতি। সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্ক যেন এমন হয় যাতে সে আপনাকে সহজেই প্রশ্ন করতে পারে এবং তার কোন সমস্যার কথা খুলে বলতে পারে। সে যেন কখনই ভাবতে না পারে যে সে একা।
একটি শিশুর শৈশব যেন আনন্দময় হয়, সেটি নিশ্চিত করা সমন্বিতভাবে আমাদের সবার দায়িত্ব। তবে সবার আগে এটি পরিবারের দায়িত্ব। পারিবারিক শিক্ষা ও সম্পর্কের প্রতিফলনেই একটি শিশু হয়ে থাকে আত্নবিশ্বাসী ও সুনাগরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ। শিশুর মানসিক সুস্থতার দিকে লক্ষ্য রাখা তাই আমাদের অন্যতম কর্তব্য।
তথ্যসূত্র-
- শিশুর বয়সভিত্তিক যৌনশিক্ষা: কী, কেন, কখন, কীভাবে
- আপনার সন্তানকে যৌনশিক্ষা দিবেন যেভাবে
- সহজ হোক যৌন শিক্ষা
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে
আরও পড়ুন-