আমি জিজ্ঞেস করলাম- তোমার পার্টনার নিজেকে কী মনে করে? সে উত্তর দিল- কুকুর...

আমার হাতে এই মুহূর্তে সাতাশটি ক্লেইম। এরমধ্যে সাইকোলজিকাল ইনজুরি বিশটি। যেকোনো সরকারী ডিপার্টমেন্টে আমার পজিশনে যে কাজ করে, তার পনেরোটির বেশি ক্লেইম ডিল করার ক্যাপাসিটি থাকে না এবং কোয়ালিটি নেমে যায় বলে তাকে সর্বোচ্চ পনেরোটি ক্লেইম-ই দেয়া হয়।

এই করোনার জন্য, প্যারা খেয়ে গেলাম। নতুন লোক নেয়া হবে না এবং এইমুহূর্তে সরকারের টাকা পয়সার সামান্য শর্ট আছে।

ক্লেইম বলতে বুঝায় কোর্টে কোনো এমপ্লয়ী আঘাত পেলে (মানসিক এবং শারীরিক), সেটার ওভারঅল ম্যানেজমেন্ট। তাকে সাহায্য করা, সাহায্যের রাস্তাগুলো চেনানো এবং সে যেন ভালো হয়ে যায় তার সবরকম ব্যবস্থা নেয়া। তবে সবাই ভালো হয় না। ভালো না হয়ে যাওয়ার অনেক সুবিধা আছে এই দেশে। যেমন মেডিকেল খরচ, রিহ্যাব, কাজ না করে বাসায় বসে বেতন পাওয়া নানাবিধ সুবিধা।

আমার কাজের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে- যে মানুষটা আঘাত পেয়েছে, তার আশে-পাশের মানুষকে কাউন্সিল করা। যেমন বাবা-মা, পার্টনার, সন্তান, টিমমেট, উপরের ম্যানেজমেন্ট, সাবর্ডিনেট, ইত্যাদি। ধরে নেন এই যে আমি লিখি, এগুলোই আমি টেকনিক্যাল ওয়েতে সেসব মানুষকে বুঝাই।

তাদের বুঝাই যে মানুষটা আঘাত পেয়েছে, সে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে, তোমার-আমার থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। তার কষ্ট কমানোর ক্ষমতা ডাক্তার সাইকোলজিস্টদের আছে, কিন্তু তুমি আমি পাশে না থাকলে সে সুস্থ্য হবে না।

মানসিক বা শারীরিক আঘাত পেলে আমরা চিকিৎসা নেই, কিন্তু তার পাশাপাশি কাছের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যত্ন খুব খুব জরুরি। অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল গাইডলাইনে ৪০ ভাগ চ্যাপ্টার শুধু এইটার উপরে কথা বলেছে।

যত্ন মানে যে ডিপ্রেশনে আছে তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা না। যত্ন মানে তার নিয়মিত খোঁজ নেয়া, তাকে জানানো- আমি, আমরা তোমার পাশে আছি। তাকে বোঝানো- জীবন সুন্দর এবং এই সুন্দর জীবনের উপর তোমার পুরোপুরি অধিকার আছে। সংক্ষেপে বললে, দুম করে তার হাতটা ধরে ফেলা, তারপর তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে রেখে বলা ‘পাশে আছি’...

এত বৃত্তান্ত দিলাম এইজন্য যে, গত সোমবারে আমার সাতাশ নাম্বার কেসটা এসেছে। আমি নিজে একটু অসুস্থ, তার উপর এতো কেসলোডের মধ্যে আরো একটা জটিল কেস আমাকে সামলাতে হবে। মেজাজ অত্যন্ত খারাপ।তবে মেজাজ বেশিক্ষন খারাপ রাখা গেলো না। যে কেস এসেছে সেই কেসের মেয়েটির নাম ‘নিরা’। নামটি নিরা না হয়ে কোনো বিদেশী নাম হলে ঘটনা অন্যরকম হতো। এই নামটির জন্যই আমার কেমন যেন একটা সফ্ট কর্নার তৈরী হলো।

নিরা... কী সুন্দর নাম! অর্থ কী, কে জানে? কিন্তু নামটা যতবার বলি ততবার একটি কোমলমতি মেয়ের ছবি চোখে ভাসে।

পঁচিশ বছর বয়সী নিরার পিটিএসডি, ওসিডি এবং জেনারেল এংজাইটি ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসড হয়েছে। দুই সপ্তাহ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিক বিভাগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। গত সপ্তাহেই রিলিজ পেয়েছে, তাই নিরার মন মেজাজ অত্যন্ত ফুরফুরে।

নিরাকে ফোন দিয়ে বললাম- তোমার নাম অনেক সুন্দর। রেস্ট্রিকশন পুরোপুরি উঠলে আমি মেলবোর্ন যাবো তোমার সাথে দেখা করতে। নিরা খুশি হয়ে গেলো, বললো আমার মা নিউক্যাসল থাকে। তাকে বলেছি আসতে, সে বলেছে তার ছুটি নেই। ক্রিসমাসে আসবে হয়তো।

আমি জানি নিরার একটা পার্টনার আছে। গত ছয় বছর ধরে তারা একসাথে থাকে। তাকে বললাম, তোমার পার্টনারের সাথেও একটু কথা বলবো আমি, যদি অনুমতি দাও। নিরার মন খারাপ হয়ে গেলো। বললো- ওর সাথে কথা বলে লাভ নেই, তুমি বরং আমার বান্ধবীর সাথে কথা বলো, ও আমার সবকিছু জানে। আমি বললাম অবশ্যই বলবো, তবে তোমার সাথে যে মানুষটা একই ছাদের নিচে থাকে, তার সাথেও কথা বলাটা জরুরি, যদি তার এবং তোমার পারমিশন থাকে।

নিরা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো আচ্ছা তোমাকে আমি জানাবো।

আজ সকালে নিরা ফোন দিয়ে বললো- শাহিদা তোমাকে কিছু কথা বলবো আমার পার্টনারকে নিয়ে। শুনেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। এই ‘বিশেষ’ পার্টনার নিয়ে আমার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। নিরার সাইকোলজিস্ট তেমন কিছু বলতে পারেনি এই ব্যাপারে। এই পার্টনার নিরার সাথে থাকে, কিন্তু হাসপাতাল বা সাইকোলজিস্ট এপয়েনমেন্টে নিরার সাথে আসে না। এমন নেপথ্যে থাকা পার্টনাররা ধুরন্ধর টাইপ হয়। আনন্দ-ফুর্তিতে তাদের গার্লফ্রেন্ড লাগে, কিন্তু বিপদে আপদে তারা ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি হয়ে যায়।

নিরা তার পার্টনার নিয়ে কোথাও মুখ খুলেনি, যখন আমাকে বললো কিছু বলবে তখন আমার মনে হলো শিউর সেই ব্যাটা ওকে ছেড়ে চলে যাবে বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ইস্যু।

নিরা বললো- জোনাথনের (পার্টনার) সাথে কথা বলে আসলে লাভ হবে না, ও বেশিরভাগ সময় নিজেকে কুকুর মনে করে। ও'র আসলে আমার সমস্যা বুঝে আমাকে সাপোর্ট দেবার ক্ষমতা নেই। আমি জানি আমার ইংরেজি অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু শুনতেও যে ভুল করবো, সেটা বুঝিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম- তোমার পার্টনার নিজেকে কী মনে করে?

সে বললো- কুকুর। সে চার হাত পায়ে ঘুরাঘুরি করে, ঘ্রান শুকে, সে আমার ঘ্রান শুকেই বলে দিতে পারে আমি ভালো আছি নাকি খারাপ আছি। যেমন আমার মন খারাপ হলে সে আমার কাছে এসে ঘ্রান নেবে, তারপর অস্থির হয়ে চার হাত পায়ে সারাবাড়ি ঘুরবে। তবে সবসময় সে এমন করে না। যখন আমার মন-মেজাজ খারাপ থাকে বা তার ওষুধ শেষ হয়ে যায় অথবা সে কোনো ভয়ের মুভি দেখলো বা গল্প শুনলো তখন এমন হয়।

আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম উনার কি লাইকানথ্রপি আছে? নিরা উদাস হয়ে বললো হুম, বারো বছর বয়স থেকে।

‘লাইকানথ্রপি’ কী যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, এইটা খুব খুব খুবই রেয়ার মেন্টাল ডিজর্ডার। এই রোগে ভুগে মানুষরা নিজেকে কুকুর-বেড়াল-বাঘ-ভাল্লুক ইত্যাদি মনে করে। সমস্যা শুধু মনে করাতে না, তারা ব্যাসিকেলি সেসব পশুদের ফিজিকাল নিড ধারণ করতে শুরু করে। যেমন- কুকুর বা বেড়ালের মতন একটু পর পর তাদের জিভ বের করতে হয়, কারণ তাদের জিভ নরমাল মানুষের চাইতে বেশি থুতু বা লালা তৈরী করে। আবার তারা প্রচন্ড শীতেও দিব্যি বাইরে থাকতে পারবে কোনো এক্সট্রা গরম কাপড় ছাড়া। কারণ তাদের ব্রেইনের নিউরোলোজিকাল যে অংশ ঠান্ডা গরমের সিগন্যাল শরীরকে দেয়, সেই সিগন্যাল ফ্রিকোয়েন্সি মানুষের চেয়ে পশুর ব্রেইনের মতন হয়ে যায়।

লাইকানথ্রপি বেশিরভাগ সময় ম্যানেজেবল। মানে লাইকানথ্রপি রোগীকে বেঁধে রাখতে হবে বা পাগলা গারদে পাঠাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কুকুর বিড়ালকে কি আমরা মেন্টাল হাসপাতালে পাঠাই? পাঠাই না। বেঁধে রাখি? রাখি না। তারা কি ভয়ংকর? নাহ, ভয়ংকরও না। তবুও মানুষ হয়ে কুকুরের মতন আচরণ করলে আমরা ভয় পেয়ে যাই। অথচ এরা সিজোফ্রেনিয়া ক্যাটাগরির সবচেয়ে কম রিস্কের থাকা রোগী।

তবে যেসব লাইকানথ্রপিরা নিজেকে বাঘ ভাল্লুক মনে করে, তাদেরকে সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে থাকতে হয়। বাঘ ভাল্লুক তো আর আপনি খোলা রাখবেন না। এইটা তখন ওয়ারওল্ফ সিনড্রোমে চলে যায়।

এ মেন্টাল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীরা নিজেদের বিভিন্ন পশু ভেবে থাকে

উফফ, মানবজাতি এবং তার মস্তিস্ক। এতো অদ্ভুত, এতো ডিপ, এতো কিছু ডিপেন্ড করে এই মস্তিস্ককে সুস্থ্য রাখতে, তা যখন ভাবি চমকে যাই। সমাজ কেন পারভার্টে ভরে যাচ্ছে, কত কত সূক্ষ কারণ যে থাকে, তার কিছুই আমি জানি না। ইশ জীবন এতো ছোট কেন?

যাইহোক, জীবন ছোট কেন সেই আফসোস করার আগে, লাইকানথ্রপি কেন হয় বলি।

মায়ের পেট থেকে লাইকানথ্রপি হয় না, এনথ্রোপোলজি যারা পড়েছেন, তারা জানেন- লাইকানথ্রপি মনুষ্য আচরণেরই একটা বিবর্তনধারা। যেসব শিশুরা অতিরিক্ত শাসনে থাকে এবং এই শাসন বিভিন্ন শাস্তি দ্বারা নির্ধারণ হয় যেমন- কান ধরে ব্যাং হয়ে বসে থাকার শাস্তি, আলমারিতে বন্ধ করে রেখে শাস্তি, ঘর অন্ধকার করে দরজা আটকে রেখে শাস্তি, সূর্যে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি ইত্যাদি যেইটা চোখ রাঙানো ছাড়িয়েও দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত বহাল থাকে। যেই শাস্তির পেছনে শারীরিক কষ্টের চেয়ে, মানসিক ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য থাকে, তাদের মধ্যে লাইকানথ্রপি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

লাইকানথ্রপি না হলেও, দিনের পর দিন বাবা মা শিক্ষকের কাছে থেকে এই শাস্তি পেয়ে আমাদের মস্তিস্ক একটা প্যারালাল জগৎ তৈরী করে, যেই জগতে এই শাস্তি কোনো শাস্তি না। যেমন এক বাবা তার ছেলেকে আলমারিতে বন্ধ করে রাখতো হোমওয়ার্ক না করলে। কখনো সেইটা ঘন্টাখানেকের উপরে চলে যেত। সেই ছেলে লাইকানথ্রপি সিনড্রোম থেকে বেড়ে ওয়ারওল্ফ হয়ে গেছে।

প্রথমে সে বিড়াল ছিল, তারপর ভাল্লুক। এই দুই প্রাণী অন্ধকারে ভালো দেখে। আলমারিতে থাকতে থাকতে সেই ছেলে যে প্যারালাল জগৎ তৈরী করেছে সেখানে এই আলমারি শাস্তি কোনো শাস্তি না। কারণ সেখানে অন্ধকারে তার ভয় নেই। তবে তারমধ্যে এক ধরনের হিংস্রতা তৈরী হয়েছে। কারণ মানুষকে অমানুষের মতন শাস্তি দিলে সে অমানুষ হবে। এইটা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। প্রকৃতিও তাকে সাহায্য করে সেটা হয়ে যেতে।

লাইকানথ্রপির সবচেয়ে ইন্টারেষ্টিং ফ্যাক্ট হলো 'সেরিব্রাল কর্টেক্স'। আমাদের খুলির উপর যে পাতলা চামড়া আছে, যেখানে অসংখ্য সুক্ষ ভেইন আছে। সেই ভেইনগুলোই- আমরা যে মানুষ, আমরা হাসি, কাদি, রাগ-অভিমান করি তা নির্ধারণ করে। পশুদের সেরিব্রাল কর্টেক্স মোটা, তাদের এতো কিছু বোঝার ক্ষমতা থাকে না। লাইকানথ্রপিতে ভোগা মানুষগুলোর সেরিব্রাল কর্টেক্স পাল্টে যায়। তারা অত্যাচারে, চাইল্ডহুড ট্রমায় যে প্যারালাল জগৎ তৈরী করে, সে জগতের মানুষের অনুভূতি পশু লেভেলের হয়ে যায়।

এক্সটেসি নামক একটা ড্রাগ আছে, এই ড্রাগ নিয়মিত সেবন করলেও তাদের লাইকানথ্রপি ডেভেলপ হতে পারে। চাইল্ডহুড ট্রমা বা উদ্ভট শাস্তি যেমন- কানে ধরে বেঞ্চের উপর সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পড়া না পারার জন্য, যেটার পেছনে আসলে লজ্জা দেয়া ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, এই শাস্তি সেলফ এস্টিম নষ্ট করে দেয়। এই শাস্তি মনে করিয়ে দেয় তুমি নিগৃহীত।

যারা যারা ছোটবেলায় কানে ধরে দাঁড়ানো শাস্তি খেয়েছেন, তাদের বলি আপনাদের হয়তো লাইকানথ্রপি হয়নি, তবে এই ধরণের অর্থহীন নিষ্ঠূর শাস্তির জন্য, এই জেনেরেশনে সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশন এবং এংজাইটি। কিছু না পারার লজ্জা একটা শিশু/কিশোর বয়সে যখন দেয়া হয়, সেই লজ্জা বড় হলে চলে যায় না। সেই লজ্জা, ক্লান্তি আর অস্থিরতার মাধ্যমে যৌবনে ফেরত আসে। তারপর বাকি জীবন থেকে যায়।

যাইহোক, নিরার জন্য মন খারাপ হচ্ছে। মেয়েটা কি যত্নেই না তার পার্টনারকে আগলে রেখেছে। উনিশ বছর বয়সী তরুণী কী বুঝে একজন লাইকানথ্রপি রোগীর সাথে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে জানি না। মানুষ বড়ই বিচিত্র, অদ্ভুত মায়া তারা বহন করে চলে। আজকাল সম্পর্ক ছয় মাস টেকানোই মুশকিল, আর ছয় বছর এমন একজন মানুষের সাথে জীবন যাপন করা...

নিরাকে বলেছিলাম, তোমার কি মনে হয়নি তোমার মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হবার পেছনে হয়তো এই বিষয়টাও কাজ করে? নিরা বলেছে- জোনাথনের যখন চার বছর বয়স, তখন থেকেই ওর বাবা ওকে কোনো দুষ্টামি করলে কোমরে রশি দিয়ে টেবিলের সাথে বেঁধে রাখতো। ছোট্ট জোনাথন এই শাস্তির একটা ভালো দিক বের করে ফেলে, সেটা হলো টেবিলের নিচে কুকুরের সাথে একই প্লেটে খাওয়া।

ছোটবেলার বিভিন্ন দুঃসহ স্মৃতি থেকে লাইকানথ্রোপি হতে পারে

ওদের বাসায় একটা কুকুর ছিল, সেই কুকুরটাকে দেখে ওর মনে হতো আমি বোধহয় কুকুর হলেই ভালো হতো, কোমরে রশি থাকতো না কিন্তু খাবার দাবার সব মাটিতে বসেই খেতে পারতাম। তাছাড়া সবার আদর পেতাম। কুকরকেতো বাসার সবাই কোলে নিয়ে কত আদর করে। আহা আমি যদি কুকুর হতাম।

নিরার মা প্রচন্ড বিরক্ত, সে চায় নিরা ওকে ছেড়ে দেক। নিরা নিজেও এটা ভেবেছে অনেকবার, কিন্তু যতবার জোনাথনের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের সিদ্ধান্তের কথা বলতে গিয়েছে, ততবার নিরা সেই কোমরে রশি পরা, চার বছরের জোনাথনকে দেখেছে।

নিরা বলেছে- অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো শাহিদা? জোনাথন নিজেও দেখতে পায় আমার চোখে সেই মায়া। চার বছরের জোনাথন যখন কোমরে রশি নিয়ে টেবিলের নিচে বসে ক্রমাগত একজোড়া মায়াভরা চোখ খুঁজতো, সেই জোনাথন এখন এই বয়সে সেই মায়াভরা চোখ খুঁজে পেয়েছে। আমার সেই চোখজোড়া ও চিনে। আমরা দুজনের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, আমরা আসলে কী চাই দুজন দুজনের কাছে। দুইটা মানুষ একসাথে থাকার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু কি দরকার পরে শাহিদা ?

আমি বললাম- না, দরকার পরে না। ফোন রাখার পর আমি কাঁদলাম। কেন কাঁদলাম জানি না। নিরা-জোনাথন আমার কিছুই লাগে না। তারা নিজেদের মধ্যে ভালোবাসাবাসি করলে আমার কী? তাও কাঁদলাম। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিলো না, কেউ দেখেনি। নাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হতো। দুইজন প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের চোখের দিকে তাকিয়েই দুজনের সব বুঝে ফেলছে, জীবনের অদ্ভুত এক জটিলতা নিয়েও তারা বছরের পর বছর একসাথে আছে, এই বিষয় নিয়ে কান্নার কিছু নেই।

আমি কান্না বন্ধ করে নিরা সাতাশ নাম্বার ফাইলটা রেজিস্ট্রি করলাম। কোর্টে রেকর্ড দুইভাবে সংরক্ষণ হয়। ডিজিটাল এবং হার্ড ফাইল। পলিসি না পাল্টানো পর্যন্ত আমাদেরকে এইভাবে হার্ড ফাইল সংরক্ষণ করে যেতে হবে। নিরার ফাইলটার কোনায় আমি ছোট্ট করে বাংলায় লিখলাম 'মায়াবতী'। কেউ বুঝবে না, কেউ জানবে না, কেউ খেয়াল করবে না, কেউ হয়তো পড়তেই পারবে না... তবুও 'মায়াবতী' শব্দটি নিরার সাথে থাকুক...

লেখক পরিচিতি- সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা