শুরু করা যাক ‘ডিয়ার জিন্দেগী’ ছবির সেই সেমিনার থেকে, যেখানে ডাঃ জাহাঙ্গীর খান রূপে অভিনেতা শাহরুখ খান কিছু কথা বলেন। কথাগুলোর সারাংশ অনেকটা এরকম– ‘আমরা আমাদের মস্তিস্ককে শরীরের অংশ মনে করি না। যখন আমাদের শরীরে কোন সমস্যা হয়, আমরা সবাইকে বলি, এই যে আমি অসুস্থ, হাসপাতালে আছি, আমাকে দেখে যাও। কিন্তু যদি মানসিক কোন সমস্যা হয়, তাহলে যেন প্রকাশ করতে লজ্জা পাই। এমনকি যারা এ সংক্রান্ত চিকিৎসক, তারা নিজেরা এবং সেই সাথে তাদের বাবা-মায়েরাও লজ্জা পায়, নিজেদের সন্তানদের এ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিতে। মানুষ নাকি পাগলের ডাক্তার বলে ক্ষ্যাপায়।'
মোঃ সাদরিল ইসলাম খান
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানসিকতা আমাদের এই উপমহাদেশে এরকমই অনেকটা। আমাদের দেশে এ নিয়ে অনেক অজ্ঞতা, তাচ্ছিল্য উপহাসমূলক উপাধি আছে। 'তার ছিড়া, স্ক্রু ঢিলা, এন্টেনায় সমস্যা, পাবনার টিকিট লাগবে ইত্যাদি। এ ধরনের মানসিকতা মূলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা আর অজ্ঞতাকেই বোঝায়।
কারণ আমাদের যখন শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন হৃদযন্ত্রে সমস্যা হয়, আমরা ওষুধ খাই কিংবা অপারেশন করাই। শরীরে যখন ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, কিংবা ডায়বেটিসে যখন সুগার লেভেল বেড়ে যায়, কত সাগ্রহে ওষুধ নেই। কিন্তু মস্তিস্ক, যা একজন মানুষকে সৃষ্টির উন্নততম জীব বানিয়েছে, যে কোটি কোটি নিউরন দ্বারা গঠিত, তার জন্য কোন যত্ন নেই? তার সমস্যা কি হতে পারে না?
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এদেশের মানুষ সাধারণত মধ্যমপন্থী কিছু ভাবতে পারে না। হয় একেবারে পাগল আখ্যা দিবে, অথবা এটিকে পাত্তাই দিবে না, বলবে ফালতু ঢং যতসব। আমরা যখন পায়ে ব্যাথা পেয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটি, তখন কি আমরা পঙ্গু? একইভাবে বিষন্নতা বা মানসিক সমস্যা মানে পাগলামি নয়।
দুঃখজনক হলো শারীরিক বা মানসিক যেভাবেই পঙ্গু হোক না কেন, তার পরিণতি যেন আমাদের দেশে ভয়াবহ। রাস্তায় যেই মানুষগুলোকে দেখা যায়, তাদের বড় সংখ্যক হয় মানসিক, নয়তো শারীরিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্থ। অথচ পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে এরকম বলা আছে যে এরা দেশের সাধারণ নাগরিক নয়।
আর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিকিৎসা বলতে মানুষজনের মানসিকতা আরো ভয়াবহ; অনেকটা এরকম- বেঁধে পেটাও, পাগলামি ছুটে যাবে। ওঝা, ঝাড়ফুঁক আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভিন্ন পদ্ধতি আজও আমাদের দেশে বিদ্যমান। দুঃখজনক যে, দেশের শিক্ষিত সমাজেও এ নিয়ে এক ধরনের অনীহা আর ইগো কাজ করে। আমরা পিছিয়ে থাকলেও কিন্তু উন্নত দেশগুলো এ নিয়ে নিয়মিতই কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি যুক্তরাজ্যে বিষন্নতার জন্য আলাদা মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়েছে।
সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্নহত্যা নিয়ে অনেক তোলপাড় হচ্ছে। তার এই সিদ্ধান্তের আসল কারণ সেই জানবে, যতই তদন্ত হোক। বিগত কয়েক মাস ধরে তিনি বিষন্নতার চিকিৎসা নিচ্ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। অনেকেই শুধু একটাই প্রশ্ন করছে, ‘এত খ্যাতি, উন্নতমানের ছবি, ভক্ত ইত্যাদির পরেও, কেন সুশান্ত, কেন?’ এই প্রশ্ন করাটাই আমাদের ভুল। পক্ষান্তরে অন্য মানুষরাও আছেন, যারা এরকম বড় ঘটনার পরে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু পরবর্তীতে সময়ের আবর্তে এর গুরুত্ব যেন ম্লান হয়ে যায়। আত্নহত্যা কখনোই কোন সমাধান নয়, কিন্তু বিকল্প সমাধানের সাথে পরিচিত তো হতে হবে।
একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। জীবনে অর্জন অথবা সফলতা এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে পূর্ন নির্ণায়ক নয়। জীবনের ঘটনাপ্রবাহ, পারিপার্শ্বিকতা, মস্তিস্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। তবে মানসিক স্বাস্থ্য যেহেতু অনেকটাই মস্তিস্কের উপর নির্ভরশীল, তাই এর রাসায়নিক প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শারীরিক সমস্যার যেমন বিভিন্ন মাত্রা থাকে, মানসিক স্বাস্থ্যেরও অনুরূপ থাকে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়।
এক হচ্ছে কাউন্সেলিং, আরেকটি হচ্ছে মেডিকেশন। অন্যান্য বিষয়ের উপর যেভাবে চিকিৎসা হয়, কোন মাত্রায় কেমন, এখানেও সেভাবেই হয়। একজন মনোবিজ্ঞানীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে তার সমস্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে তার জীবনের দর্শনকে মানবিক এবং ইতিবাককভাবে গড়ে তুলতে সাহাজ্য করা, জীবনের লক্ষ্য এবং বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যকে আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটা অনেক সময় সময়সাপেক্ষ হয়, কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে মানুষের আবেগ জড়িত। কিন্তু এ ব্যাপারটা মেনে নিয়ে চিকিৎসার সাথে মানিয়ে চললে নিয়মিত জীবনে সহজেই সক্রিয় থাকা যায়।
আমাদের দেশে যারা ভুক্তভোগী, তাদের মধ্যে অনেকের সচেতনতা বাড়ছে। কিন্তু তারা অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগে কারো সাথে তাদের এ চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ নিয়ে সচেতনতামূলক কিছু বললে বা লিখলেও মানুষ ভাবে, এই লোকের মনে হয় সমস্যা আছ। দেশের স্কুল কলেজের পাঠ্যতে এ নিয়ে সেভাবে গুরুত্বই নেই।
বাবা-মা'রা সন্তানের ঠান্ডা-জ্বর-পড়াশোনা নিয়ে অনেক ভাবেন, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কতটা ভাবেন? সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার সাবজেক্ট চয়েজে মনোবিজ্ঞান সাধারণত সবার নিচে থাকে, কোনমতেই যেন না পড়ে ভাগ্যে। দেশে এখনো এ সংক্রান্ত চিকিৎসকের অভাব আছে। প্রতিবছর অনেক ডাক্তার পাশ করলেও মানুষ পাগলের ডাক্তার বলে খ্যাপাবে অথবা আরো উচ্চভিলাষী ক্যারিয়ারের আশায় এ নিয়ে পড়তে চায় না। কিন্তু সবার আগে আগ্রহী তাদেরই হতে হবে। কারণ সবার আগে তারাই পারে মানুষকে সচেতন করতে।
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার সবক্ষেত্রেই জরুরি। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের মানসিকতা। ধ্যানধারণা বদলাতে হবে সবার আগে। যারা মানসিক সমস্যাতে ভুগেন আর যারা চিকিৎসা দেন, উভয়কেই সম্মানের সাথে মূল্যায়ন করতে হবে। সম্পূর্ণ বিষয়টাকে স্বাভাবিক আর বৈজ্ঞানিক উপায়ে দেখতে হবে। সচেতনতা পরের ধাপ, আগে না হয় মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বীকৃতিটা দেই অন্তত!
লেখক- শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
আরও পড়ুন-