![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/24/9o45DnnvOx1J38Kll4MZjLVVZUGx4lCpZsnBcI6Z.jpeg)
ফুটবল মাঠের মেসি এক অনন্য অনুপ্রেরণার নাম, ফুটবলভক্তদের কাছে মন ভালো করে দেয়ার ঔষধ। বাম পায়ের জাদুতে মেসি হাসান, মেসি কাঁদান, এল ক্লাসিকোতে শেষমূহুর্তের গোলে দলের জয় নিশ্চিত করে মেসি ছুটে যান কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছে, জার্সি খুলে দেখিয়ে দেন নিজের নামটা!
স্টিল ফ্যাক্টরির ম্যানেজার জর্জের মনটা ভালো নেই। ডাক্তারের চেম্বার থেকে আসছেন তিনি, ছোট ছেলেটার হরমোনের সমস্যা ধরা পড়েছে। সমবয়েসী আর দশটা ছেলের মতো সমানভাবে বেড়ে উঠছে না জর্জের তৃতীয় সন্তান। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, অনেক টাকার মামলা। জর্জের বেতন আহামরি কিছু নয়, সংসারের খরচ সামলাতে স্ত্রী সিলিয়াও কাজ করেন একটা চুম্বক তৈরীর কারখানায়। স্ত্রীকে খবরটা কিভাবে দেবেন বুঝতে পারছেন না জর্জ। হেলথ ইন্সুরেন্স করা আছে একটা, কিন্ত সেটা দিয়ে তো বেশীদিন এই চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব নয়।
ছেলেটার ধ্যানজ্ঞান সব ফুটবল। বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, নাওয়া নেই খাওয়া নেই, রাতে ঘুমের ঘোরেও ফুটবলটাই স্বপ্নে ভাসে। আকারে ছোট হলেও, প্রতিভায় মোটেই ছোট নয়। দারুণ ড্রিবলিং আর দুরন্ত গতিতে বড় ভাইয়ের বন্ধুদের নাকাল করে ফেলে বছর দশেকের ছেলেটা। ছয় বছর বয়সেই রোজারিও ক্লাবে যোগ দিয়েছিল, উনিশশো সাতাশিতে জন্ম বলে ওকে ডাকা হতো মেশিন অফ ‘৮৭’। রোজারিওতে ছয় বছর কাটিয়েছিলেন, করেছিলেন পাঁচশোর বেশী গোল। রোজারিওর সিনিয়র ডিভিশনের খেলাতেও এতো দর্শক হতো না, যত মানুষ দেখতে আসতেন ছেলেটার বাম পায়ের কারিকুরি!
দশ বছর বয়সে ধরা পড়লো ‘গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি’ নামের বিরল এই রোগটা। চিকিৎসা আছে, কিন্ত সেটা বহন করার সামর্থ্য তো পরিবারের নেই। প্রতিমাসে অন্তত এক হাজার ডলার দরকার, কিছুদিন চললো হেলথ ইন্সুরেন্সের টাকা দিয়ে, সেটাও ফুরিয়ে এলো একসময়। ক্লাব প্রথমে রাজী হয়েছিল সাহায্য করতে, পরে তারাও সরে গেল। বুয়েন্স আয়ার্সের ক্লাব রিভার প্লেটের স্কাউটেরা যোগাযোগ করেছিলেন, কিন্ত সেখানেও হলো না জায়গা। এক আত্নীয় থাকতেন স্পেনের কাতালুনিয়ায়, সেখানকার ক্লাব বার্সেলোনার একটা ট্রায়ালে যোগ দিতে গেল ছেলেটা।
বার্সেলোনার ফার্স্ট টীম ডিরেক্টর চার্লি রেক্সাচ ওর মধ্যে কি দেখলেন তিনিই তখন ভালো জানেন, হাতের কাছে থাকা টিস্যু পেপারে সই করিয়ে নিলেন ছেলেটাকে। বোর্ডকে রাজী করালেন এই আর্জেন্টাইন কিশোরের চিকিৎসার সব খরচাপাতি বহন করতে। আর সেদিন থেকেই ‘লিওনেল আন্দ্রেস লিও মেসি’ নামটা বার্সেলোনার!
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/24/AtNPV7ifTR5MoX014umSxS7c4xJi5YrmiAvPuiGX.jpeg)
স্মৃতির ডানায় চড়ে লিওনেল মেসি ফিরে যান ২০০০ সালের ডিসেম্বরে। বার্সেলোনা কথা রেখেছিল, সেই মাসের চৌদ্দ তারিখে অফিসিয়ালি কাতালান ক্লাবটার সঙ্গে গাটছাড়া বাঁধলেন। ‘লা মাসিয়া’য় প্রথম মৌসুমটা ঝামেলায় কেটেছে, শৈশবের ক্লাব নিওয়েল ওল্ড বয়েজ ক্লাবের সঙ্গে বার্সেলোনার চুক্তির ঝামেলায় মাঠে নামা হয়নি খুব একটা, কাতালান লীগ আর প্রীতি ম্যাচগুলোতেই সুযোগ পেতেন শুধু।
সদা চুপচাপ ছেলেটার মিশতেও সমস্যা হতো অন্যদের সঙ্গে, ছিলেন মৃদুভাষী, খানিকটা অন্তর্মূখী। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে মা ফিরে গেলেন আর্জেন্টিনায়, বাবার সাথে কাতালুনিয়ায় রয়ে গেলেন মেসি। হোমসিকনেসেও ভুগেছেন প্রথম বছরটায়। রক্তে ফুটবলটা মিশেই ছিল, পায়ে ছিল সক্ষমতা, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক চলতো আলোর বেগে। অপরিচিত যায়গায় মানিয়ে নেয়ার সমস্যা ঝেড়ে ফেললেন পরের মৌসুমে, সেস্ক ফ্যাব্রিগাস আর জেরার্ড পিকে নামের দুই সমবয়েসী টিমমেটের সঙ্গে হয়ে গেল দারুণ বন্ধুত্ব।
চৌদ্দ বছর বয়সে হরমোন সমস্যার চিকিৎসা শেষ হলো, মেসি তো এবার আরো দুরন্ত! জুনিয়র দলটাকে ‘ড্রীম টিম’ বানিয়ে ফেললেন, হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য। ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড তখন বার্সেলোনার কোচ, ন্যু ক্যাম্প মাতাচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার রোনালদিনহো। ওদের সঙ্গে ট্রেনিং সেশনে ডাক এলো, চলে গেলেন মেসি।
২০০৩ এর নভেম্বর, ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ষোল, মেসির বয়সটাও তখন সবে ষোল- মূল দলের হয়ে অভিষেক হয়ে গেল লম্বা চুলের খাটো এই তরুণের। বদলী হিসেবে পঁচাত্তর মিনিটে মাঠে নেমেছিলেন, দুটো শট নিলেন গোলে, দাপিয়ে বেড়ালেন সারা মাঠ, মুগ্ধ করলেন টেকনিক্যাল স্টাফদের। ট্রেনিং সেশনে মেসিকে প্রথম দিন দেখে রোনালদিনহো টিমমেটদের বলেছিলেন, “এই ছেলে আমার চেয়ে ভালো ফুটবলার হবে!” ফুটবলার রোনালদিনহো কতটা ভালো সেটা সবাই জানে, জহুরী হিসেবেও যে তিনি দারুণ, সেটাও জানা গেল!
লিওনেল মেসিকে নিয়ে আসলে কি লেখা যায়? কতটা লেখা যায়? সবকিছু লিখলে কয়েকখণ্ড শাহনামা হয়ে যাবে, তারপরেও মনে হবে কতকিছু বাকী রয়ে গেল! তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তিটি সম্ভবত লুইস ফিগোর, বার্সেলোনা-মাদ্রিদ দুই ক্লাবেই খেলা এই পর্তুগীজ কিংবদন্তীর কথাটা বাংলায় অনুবাদ করতে গেলে খানিকটা লজ্জা পেতে হবে, তাই ইংরেজীতেই দেয়া হলো- “For me, to watch Messi play is a pleasure. It’s like having an orgasm, it’s an incredible pleasure…”
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/24/pNKlhnSf87wTbNQjZjdD2rO7cTMrkiqDgunuCiiu.jpeg)
বার্সেলোনার মেসি মোটামুটি সব রেকর্ডই নিজের নামের পাশে লিখে নিয়েছেন, যেগুলো বাকী আছে সেগুলোও পায়ের দক্ষতায় জয় করে নেবেন, অপেক্ষা কেবল সময়ের। সম্ভাব্য সব ট্রফি জিতেছেন ক্লাবের হয়ে, তাও কমপক্ষে একাধিকবার করে! হয়েছেন সময়ের সেরা, টানা চারবার সহ মোট পাঁচবার জিতেছেন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি, এখনও পর্যন্ত যেটা সর্বোচ্চ। টিকিটাকার ছন্দে বার্সেলোনাকে নিয়ে গেছেন অন্যরকম উচ্চতায়, জাভি আর ইনিয়েস্তার সঙ্গে তাঁর জুটিটা তো ফুটবল রোমাঞ্চেরই একটা বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ছিল অনেকগুলো বছর ধরে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে তাঁর খেলোয়াড়ি দ্বৈরথটা তো রূপকথার জন্ম দিয়েছে ইওরোপিয়ান ফুটবলেই।
মেরুন জার্সিটা আকাশী নীল হয়ে গেলেই সমস্যার শুরু। স্পেনের হয়ে খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আর্জেন্টিনাকেই বেছে নিয়েছিলেন, যুব বিশ্বকাপ জিতেছেন দেশের হয়ে। জিতেছেন অলিম্পিক স্বর্ণপদকও। এরপর থেকেই দুর্ভাগ্যের সূচনা। আর্জেন্টিনার মেসি যেন এক দুঃখগাথার নামান্তর। ২০০৬-২০১০-২০১৪, টানা তিন বিশ্বকাপে জার্মানীর কাছে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে আর্জেন্টিনার। ২০১৪ সালে তো একক নৈপুণ্যে দলকে টেনেছিলেন, ফাইনালে সঙ্গী হয়েছে হারের বেদনা।
পরপর দুটো কোপা আমেরিকার ফাইনালে তুলেছেন দলকে, দুটোতেই পেনাল্টি শুটআউটে হার- ফুটবলবিধাতা বোধহয় খানিকটা নিষ্ঠুরও। নইলে আর্জেন্টিনার মতো দলে খেলে মেসি কেন বারবার ফিরবেন খালিহাতে, কখনও সতীর্থদের হাস্যকর ভুলে, কখনও বা নিজের ব্যার্থতায়! বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, সেরা হয়েছেন মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইতেও, কিন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপার ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরা হয়নি মেসির। ফিরেছেন নিঃশ্বাস দূরত্ব থেকে, চোখে হতাশা নিয়ে দেখেছেন প্রতিপক্ষের উল্লাস।
মেসি’র মনে পড়ে যায় ২০১২ মৌসুমের কথা, গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি, মৌসুমে ৯১ গোল করে! টিটো ভিলানোভার হাসি হাসি চেহারাটা ভাসে তাঁর মুখে, মানুষটা তাঁর প্রথম কোচ ছিলেন লা মাসিয়াতে। কোচ ছিলেন সেই মৌসুমেও। পেপ গার্দিওলার সাথে মেসির জুটিটা ভাঙল গার্দিওলা ক্লাব ছাড়ায়, সবাই ভেবেছিল মেসির ফুরিয়ে যাবার বুঝি সেটাই শুরু। মেসির উজ্জ্বল দ্যুতির অনেকটা কৃতিত্ব তো সবাই এই স্প্যানিশকেই দিতো। গার্দিওলা যাবার পরে মেসি আরো ভয়ঙ্কর, জার্ড মুলারের চল্লিশ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে জার্মান কিংবদন্তীকে বার্সেলোনার একটা জার্সি পাঠিয়েছিলেন তিনি, দশ নম্বর জার্সিটার গায়ে লেখা ছিল- "with respect and admiration"…
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/24/0pZUEiTEmUGCmI3ChbNfN4tCahLTEOG01L5oioyZ.jpeg)
মেসির মনে পড়ে ওয়েম্বলিতে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালের কথা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেই হেড থেকে গোল, ভ্যান ডার সারের বোকা চোখে তাকিয়ে থাকা! গার্দিওলার অধীনে এক মৌসুমে ছয় ট্রফি জয়টাকে তো মনে হয় এই সেদিনের কথা! অথচ ঘড়ির কাঁটায় সময় পেরিয়ে গেছে কত! বিশ-একুশের দুরন্ত দুর্নিবার মেসি এখন তেত্রিশে পা দিয়েছেন, সেদিনের চটপটে তরুণ এখন দু’টো চঞ্চল শিশুর বাবা, অথচ সময়ের সাথে বরং শাণিত হয়েছে মেসির পা জোড়া, বাম পায়ের জাদুতে পুড়েছে তাবৎ প্রতিপক্ষ। সিজার রড্রিগেজকে ২০১২ সালে টপকে হয়েছেন বার্সেলোনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা, স্প্যানিশ লীগে টেলমো জারার সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে সেখানেও নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেসি।
আজ তেত্রিশে পা দিলেন ফুটবল জাদুকর। চিকিৎসার খরচের আশায় এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাবে ছুটতে হয়েছিল যাকে, সামান্য দয়া দাক্ষিণ্যের আশায় যিনি দৌড়েছিলেন রোজারিও থেকে বুয়েন্স আয়ার্স, আর্জেন্টিনা থেকে বার্সেলোনা, সেই মানুষটা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়াবিদদের একজন। সবচেয়ে বেশী বেতন পাওয়া ফুটবলারের তালিকাতেও সবার ওপরে তাঁর জায়গা। পেলে-ম্যারাডোনার সাথে তুলনাটা যায় কিনা জানিনা, ক্রিশ্চিয়ানো সেরা না মেসি সেরা সেটা নিয়েও ভক্তদের মধ্যে আছে বিতর্ক। তবে আমাদের কাছে মেসি মানে অঞ্জন দত্তের গান, অঞ্জনের যেমন ‘তুমি’ না থাকলে সকালটা এতো মিষ্টি হতো না, তেমনই আমাদের ‘মেসি’ না থাকলে ফুটবলতাও এত রোমাঞ্চকর, এত সুন্দর হতো না।
ফুটবল মাঠের মেসি এক অনন্য অনুপ্রেরণার নাম, ফুটবলভক্তদের কাছে মন ভালো করে দেয়ার ঔষধ। বাম পায়ের জাদুতে মেসি হাসান, মেসি কাঁদান, এল ক্লাসিকোতে শেষমূহুর্তের গোলে দলের জয় নিশ্চিত করে মেসি ছুটে যান কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছে, জার্সি খুলে দেখিয়ে দেন নামটা- লিওনেল মেসি! তাঁকে ঘিরে থাকা বিতর্ক আর ফুরিয়ে যাবার অবান্তর আলাপগুলোকে মাটিচাপা দেন মাঠের বুকেই। শিরোপা হারানোর হতাশায় মেসি অবসর নিয়ে ফেলেন, সেই অবসর ভাঙাতে মেসির সমর্থকেরা “Don’t go Leo’ স্লোগানে প্রকম্পিত করেন বুয়েন্স আয়ার্সের পথঘাট, দেশের প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করেন তাঁকে ফিরে আসার। মাঠ আর মাঠের বাইরে লিওনেল মেসি এক অনুকরণীয় আদর্শের নাম। মেসি তো শুধু দারুণ একজন ফুটবলারই নন, অসাধারণ একজন স্বামী, দায়িত্ববান বাবা, সবকিছুই। বন্ধুত্ব আর ভাতৃত্ববোধের সবচেয়ে বড় উদাহরণও এই মানুষটা।
শুভ জন্মদিন লিও!