নতুন কোচের অবহেলা, বোর্ডের অব্যবস্থাপনা, ক্লাব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক- কোনটা আসলে দায়ী মেসির বিদায়ের জন্য? রিলিজ ক্লজ, চুক্তির শর্ত- সবকিছু নিয়ে দুই পক্ষ এমনই অনড় অবস্থানে চলে গেছে যে, আদালতে যাওয়া ছাড়া সম্ভবত আর কোন উপায়ই নেই!

রাতে যাদের একটু তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস, তারা সকালবেলায় উঠে ফেসবুকের নিউজফিডে ঢুকে বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছেন নিশ্চিত। লিওনেল মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার যে গুঞ্জনটা বাতাসে ভাসছিল গতকাল থেকে, সেটা এক রাতের ব্যবধানেই একদম 'পাকা খবর' হয়ে গেল! স্বয়ং কার্লোস পুয়োলের মতো সাবেক বার্সা অধিনায়ক যেখানে টুইট করে মেসিকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে দেন, সেখানে তো জল্পনা কল্পনার আর কারণ থাকতে পারে না। 

মেসি বার্সেলোনা ছাড়তে চান, নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ক্লাবে পাড়ি জমাতে চান- সেটা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন ক্লাবকে। বার্সেলোনা মেসিকে ছাড়তে নারাজ, মেসিও এই ক্লাবে আরেকটা মৌসুম থাকতে নারাজ। এখন আলোচনা হচ্ছে চুক্তির বিভিন্ন শর্ত এবং রিলিজ ক্লজের অংকটা নিয়ে। তবে পর্দার অন্তরালে নাটক কিন্ত চলছেই, এমনও শোনা যাচ্ছে, ক্লাব প্রেসিডেন্ট বার্তামেউ পদত্যাগ করলে মেসি হয়তো বার্সায় থেকেও যেতে পারেন!

রোজারিও থেকে অসুস্থ একটা ছেলেকে তুলে এনে তাকে 'লিওনেল মেসি' বানিয়েছিল বার্সেলোনা, মেসিও পায়ের জাদুতে ক্লাবকে সমৃদ্ধ করেছেন, জাদুকরি পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে জিতিয়েছেন সম্ভাব্য সব শিরোপা, নিজে জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের তকমা। বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির বন্ধনটা যে কখনও ভাঙতে পারে, সেটা তো মেসির ঘোর বিরোধিরাও বিশ্বাস করতেন না। 'ওয়ান ক্লাব লেজেন্ড' বলে ট্রল করা হতো যাকে, সেই মেসির ক্লাব ছাড়ার এই ঘোষণায় তাই মেসি ভক্ত তো বটেই, ফুটবলপ্রেমীদের সবাই অবাক। 

বার্সেলোনা অধ্যায় শেষ হতে চলেছে মেসির?

কিন্ত মেসির এই সিদ্ধান্তের কারণ কি? লিওনেল মেসি এবং বার্সেলোনা- একে অন্যের সমার্থক ছিলেন, কেন মেসি আচমকা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলেন? অবশ্য, ব্যাপারটাকে আচমকা বলা ঠিক হবে না বোধহয়। দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাব কর্তৃপক্ষের নানা সিদ্ধান্তে বিরক্ত ছিলেন লিওনেল মেসি, বায়ার্নের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়ন লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বিধ্বস্ত হবার পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন তিনি, তারই জের ধরে নিয়ম অনুযায়ী ব্যুরোফেক্সের (প্রত্যায়ন পত্র) মাধ্যমে ক্লাবের কাছে আবেদন করেছেন, তাকে যেন বার্সেলোনা ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয়। শোনার পরেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে ক্লাব কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারা বসেছেন মেসির এজেন্ট এবং লিগ্যাল এডভাইজরদের সঙ্গে, মেসিকে বোঝানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন তারা। 

বার্সেলোনার মিডফিল্ডার আর্তুরো ভিদাল গতকাল একটা টুইট করেছেন, সেই টুইটের বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়- 'আপনি যখন একটা হিংস্র বাঘকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করবেন, সে কিন্তু হাল ছেড়ে দেবে না তখন। সে লড়াই করবে, ঘুরে দাঁড়িয়ে আক্রমণ করবে!' এখানে বাঘ বলতে যে মেসিকেই বুঝিয়েছেন ভিদাল, সেটা নিশ্চিত। ক্লাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মেসির মনমালিন্যের ব্যাপারটার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন তিনি, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। ভিদাল বার্সেলোনায় এসেছেন দেড় মৌসুম আগে, তিনিই যদি এত কিছু দেখে ফেলেন এই অল্প সময়ে, পুরো ঘটনা নিশ্চয়ই সুখকর কিছু নয়। 

চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে এভাবে বাদ পড়াটা গত কয়েক বছরে বার্সেলোনা বোর্ডের একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্তেরই ফল। আগের তিন মৌসুমেও ইউরোপ সেরাদের এই টুর্নামেন্ট থেকে লজ্জাজনক বিদায় হয়েছে বার্সার, ২০১৬ সালের পর আর ইউরোপিয়ান আসরে জেতা হয়নি শিরোপা। কিন্তু সেই ব্যর্থতা ঢাকতে বার্সেলোনার বোর্ড একের পর এক ভুল দলবদল করেছে। দলের কী প্রয়োজন, কোচ কী চান, সেসবকে মাথায় না রেখে একের পর এক তারকার দিকে ছুটেছে। বড় অঙ্কে, বিশাল বেতনে ফুটবলারদের কিনেও এসেছে। কিন্ত ফলাফল পাওয়া যায়নি। বার্সার আর্থিক সঙ্গতি তো হুমকিতে পড়েছেই, মাঠেও বার্সেলোনা হয়ে পড়েছে ভারসাম্যহীন এক দল। এত তারকা থাকার পরও দলটা কঠিন পরিস্থিতিতে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মেসির দিকেই তাকিয়ে থেকেছে সবসময়।

নতুন কোচের সঙ্গে মেসির সাক্ষাৎটা ঠিক 'সৌজন্যমূলক' হয়নি

নতুন কোচ রোনাল্ড কোম্যানেরও খানিকটা ভূমিকা আছে মেসির বিদায়ের সিদ্ধান্তে। ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘স্কোয়াডে মেসি যেসব বিশেষ সুবিধা পেতে, সেসবের দিন শেষ। তাকে এখন দলের জন্য সবকিছু করতে হবে। আমি এ ব্যাপারে অনড় থাকব। তাকে সব সময় ক্লাব নিয়েই চিন্তা করতে হবে।’ মেসি এখনও বিশ্বের সেরা ফুটবলার, ক্লাবের সেরা পারফর্মার, নেতৃত্বের আর্মব্যান্ডটাও তার হাতেই। নতুন কোচের এই কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব ভালো লাগেনি তার। কোম্যান এসেই সুয়ারেজকে বিক্রি করতে চাইছেন, জেরার্ড পিকে বা সার্জিও বুস্কেটসদের দলে জায়গা হবে না বলে জানিয়ে দিচ্ছেন, এটাও মেসির বিরক্তির বড় কারণ। 'হোম সুইট হোম' টাইপের অনুভূতিটা বার্সেলোনায় আর পাচ্ছিলেন না তিনি, সেকারণেই নাকি নতুন গন্তব্যের খোঁজে নেমেছেন তিনি। 

মেসি যদি সত্যিই ন্যু ক্যাম্প ছাড়েন, তার নতুন গন্তব্যস্থল কি হবে সেটা নিয়েও জল্পনা কল্পনা চলছে। তবে বেশিরভাগেরই মত, বার্সেলোনা থেকে মেসি যদি কোথাও যান, সেটা হবে ম্যানচেস্টার সিটি। কারণ মেসির মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের চাহিদা পূরণের সামর্থ্য যে অল্প কয়েকটা ক্লাবের আছে, তাদের মধ্যে সিটি সবার ওপরে থাকবে। তার চেয়ে বড় কথা, সিটির কোচ হিসেবে আছেন পেপ গার্দিওলা, যার সঙ্গে মেসির সম্পর্কটা গুরু-শিষ্যের চেয়েও বেশি কিছু। মেসিকে দলে ভেড়ানোর জন্য সিটি তো একসময় ব্ল্যাংক চেক নিয়েও বসে ছিল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পরে গার্দিওলার সঙ্গে দলবদল নিয়ে মেসির কয়েক দফায় আলাপ হয়েছে বলেও জানাচ্ছে স্প্যানিশ মিডিয়া। 

তবে মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার ব্যাপারটা এত সহজ হবে না। আইনি অনেক ঝামেলা আছে এখানে। বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির চুক্তির একটি শর্ত ছিল, প্রতি মৌসুম শেষে মেসি চাইলেই ক্লাব ছাড়তে পারবেন, আর ছাড়তে না চাইলে নতুন চুক্তি করবেন। ফলে নতুন মৌসুমে বার্সেলোনার অনিচ্ছায় মেসিকে কেউ নিতে চাইলে মেসির রিলিজ ক্লজ ৭০ কোটি ইউরো পরিশোধ করতে হবে নতুন ক্লাবটিকে। নেইমারের ক্ষেত্রে যেমন ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো রিলিজ ক্লজ দিয়েছিল পিএসজি। 

মেসি ও বার্তামেউ: সম্পর্কটা এখন তিক্ততার

এখানে আবার একটা ঘাপলা আছে। চুক্তিতে বলা ছিল, প্রতি মৌসুমের শেষে ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে মেসি ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন বার্সেলোনা বোর্ডকে। কিন্ত এবার করোনার থাবায় সবকিছুই পিছিয়ে গেছে, ফুটবল মৌসুম শেষ হয়েছে আগস্টের শেষ প্রান্তে এসে। চুক্তি অনুযায়ী মেসির ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানানোর সময়ও পার হয়ে গেছে এই মৌসুমের জন্য। কিন্ত মেসির আইনজীবিদের দাবী, এই সময়সীমাটা ৩১শে আগস্ট করা হোক, কারণ প্যান্ডেমিকের জন্য এবছর সবকিছুই পিছিয়েছে, ক্লাব ছাড়ার তারিখটা কেন পেছানো হবে না? আর এই অনুরোধ মানতে রাজী হচ্ছে না বার্সেলোনা, কারণ মেসিকে আটকে রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্র তো এটাই! 

দুই পক্ষই যদি অনড় অবস্থানে থাকে, তাহলে আদালতে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির যে হৃদ্যতার সম্পর্ক, সেখানে কোর্ট-কাছারিকে তারা টেনে আনবেন কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। একটা উপায় অবশ্য আছে এই ঝামেলা এড়িয়ে মেসিকে বার্সেলোনায় রেখে দেয়ার, সেটা হচ্ছে ক্লাব প্রেসিডেন্ট জোসেপ মারিয়া বার্তামেউর পদত্যাগ। মেসির সঙ্গে ঝামেলাটা মূলত তার, বার্তামেউ'র স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতি ফুটবলাররা বিরক্ত, তবুও তাকে সহ্য করতে হচ্ছে, কারণ তার মেয়াদ আছে ২০২১ সাল পর্যন্ত। এই সংকটের মুখে বার্তামেউর পদত্যাগই পারে বার্সেলোনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে। কিন্ত স্বার্থান্বেষী বার্তামেউ ক্লাবের জন্য নিজে থেকে পদত্যাগ করবেন- এমনটা বার্সেলোনার পাঁড় সমর্থকও বিশ্বাস করে না! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা