বায়ার্নের সাথে নাস্তানাবুদ হওয়ার পরেই গুঞ্জন উঠেছে, তাঁর ক্লাব ছাড়ার। কিন্তু দলের এ অবস্থায় ক্লাব ছাড়লে সমালোচনার তীর যে নানাদিক থেকে তাকে বিদ্ধ করবে, তা বলাই বাহুল্য। প্রতিপক্ষ রোনালদোর সাথেও ব্যবধান হয়ে যাবে দিনের আলোর মতন পরিষ্কার!

আগামী বছর শেষ হচ্ছে বার্সেলোনার সাথে লিওনেল মেসির বর্তমান চুক্তি। এখনো চুক্তি নবায়ন করেননি তিনি, বরং এ বছরই একবার চুক্তি নবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, নিজেই স্থগিত করে দিয়েছেন তা। ফলে সবার মনেই এখন প্রশ্ন, মেসি কি বার্সেলোনা ছেড়ে চলে যাবেন? অন্য কোনো লিগে পাড়ি জমাবেন 'নতুন চ্যালেঞ্জের সন্ধানে'? বিশেষত লিসবনে চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ৮-২ ব্যবধানে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর অনেকে যেন নিশ্চিতই হয়ে গেছেন, মেসি আর থাকবেন না কাতালান ক্লাবটিতে।

বায়ার্নের সাথে হারের পর বিপর্যস্ত মেসি  

কিন্তু বার্সাপ্রেমীরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, মেসি এত শীঘ্রই বার্সেলোনা ছাড়ছেন না। কারণ এই মুহূর্তে ক্লাব ছাড়াটা যে কতটা দৃষ্টিকটু হবে, তা মেসি নিজেও বোঝেন।

এই যে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দিলেন, তিনি কি রিয়ালে ব্যর্থ হয়ে ক্লাব বদলেছেন? তা তো না। বরং রিয়ালকে টানা তিনবারসহ মোট চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতিয়ে, রাজার বেশে ক্লাব ছেড়েছেন তিনি। এবং তার বিদায়ের পর থেকেই শুরু হয়েছে রিয়ালের সাময়িক অবনমন। তাই বার্নাব্যুজুড়ে এখনো কান পাতলে শোনা যায় রোনালদোর জন্য হাহাকার ধ্বনি।

অথচ বার্সেলোনার এখন কী অবস্থা? শুধু যে ৮-২ ব্যবধানে হেরে তাদের চ্যাম্পিয়নস লিগ যাত্রা থেমেছে, তা তো নয়। ১৯৬২ সালের পর এটাই তাদের ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বড় হার। সেবার ভ্যালেন্সিয়ার কাছে ইন্টার-সিটিস ফেয়ার্সে ৬-২ ব্যবধানে হেরেছিল তারা। সর্বশেষ এক ম্যাচে আট গোল তারা হজম করেছিল ১৯৪৬ সালে, সেভিয়ার বিপক্ষে ৮-০ গোলে হারের ম্যাচে। ছয় গোলের ব্যবধানে তাদের শেষ হারটাও এসেছিল সেই ১৯৫১ সালে, যেবার এসপানিওলের বিপক্ষে একটি লিগ ম্যাচে ৬-০'তে হেরেছিল তারা। ২০১৪-১৫ মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে বায়ার্নের কাছে পোর্তোর ৩৬ মিনিটে চার গোলের পর এটাই চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট ম্যাচে কোনো দলের দ্রুততম চার গোল হজম করা। আর সব মিলিয়ে ২০১৩-১৪ মৌসুমের পর প্রথমবারের মতো তাদের শোকেসে উঠছে না একটিও মেজর ট্রফি।

সুতরাং নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়, বার্সেলোনা এখন স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে অবস্থায় রয়েছে। নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে আর কখনোই এতটা বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েনি তারা। আর এই সবই হচ্ছে এমন একজন খেলোয়াড়ের উপস্থিতি সত্ত্বেও, যিনি অনেকের মতেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার।

এখন ভেবে দেখুন, কেউ কীভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হতে পারেন, যদি তিনি নিজের ক্লাবকে ভয়াবহতম অবস্থায় রেখে বিদায় নেন? এখন যদি মেসি অন্য কোনো লিগে অন্য কোনো ক্লাবের হয়ে খেলতে যান, সেটি কোনোভাবেই রোনালদোর মতো নতুন চ্যালেঞ্জ জয় করতে যাওয়ার সমতুল্য গৌরবের ব্যাপার হবে না। সেটি হবে নিতান্তই লজ্জার। ব্যর্থতা সইতে না পেরে পালিয়ে বাঁচার মতো। যেভাবে ২০১৬ কোপা আমেরিকার পরও তিনি পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণের মাধ্যমে।

এটিও নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, মেসির প্রস্থানে শোকের মাতমও উঠবে না ন্যু ক্যাম্পে, যেরকম উঠেছিল বার্নাব্যুতে রোনালদোর জন্য। কেননা মেসির উপস্থিতিতেই যে তাদের অবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে!

দুই প্রতিপক্ষ

তাহলে এখন মেসির সামনে কোন রাস্তা খোলা রয়েছে? কীভাবে তিনি নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেন? উপায় একটাই। এই দুঃসময়ে বার্সেলোনায় থেকে যাওয়া। তাকে বার্সেলোনায় থেকে যেতে হবে, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই সময়ে প্রকৃত নেতার মতো সামনে থেকে ক্লাবকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে, অবদান রাখতে হবে ক্লাবের পুনর্বিকাশে।

এবং তা মোটেই সহজ ব্যাপার হবে না। বার্সেলোনার এখন যে অবস্থা, তার রাতারাতি পরিবর্তন অসম্ভব। বায়ার্নের বিপক্ষে হারের ক্ষতই হয়তো এক মৌসুমে শুকোবে না। আগামী তিন বছরের মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের আশা করাকেও এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে দুরাশা। কিন্তু তারপরও, মেসিকে থাকতে হবে। ব্যালন ডি'অর কিংবা দলীয় সাফল্য, সবকিছু চুলোয় যাক। আগামী তিন বছর সব অকথা-কুকথা তাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হবে।

হয়তো সর্বকালের সেরা ফুটবলার তো নয়ই, এমনকি বর্তমান সময়ের সেরা ফুটবলার বিষয়ক আলোচনা থেকেও হারিয়ে যাবে তার নাম। কিন্তু সেসবে মাথা না ঘামিয়ে, তাকে নিজের কাজটা করে যেতে হবে। বর্ধিষ্ণু বার্সেলোনা শিবির থেকে তার সমবয়সী (তার নিজেরই এখন ৩৩ বছর) আর সবাই বিদায় নেয়ার পর, বর্তমান ম্যানেজার, ডিরেক্টর, প্রেসিডেন্ট সব পদে পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্লাবের অবকাঠামো ঢেলে সাজানো হলে, তাকে সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে তরুণদের সামনে সত্যিকারের আইডল হয়ে উঠতে হবে। তাদেরকে পথ দেখাতে হবে।

এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে, বার্সেলোনা ক্লাব হিসেবে আবারো ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ দলের কাতারে ফিরলে, তাকে শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। কেবল তাহলেই আবার তার পক্ষে পুনরায় সর্বকালের সেরা বিষয়ক আলোচনায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব।

কেননা তখন বায়ার্নের বিপক্ষে বার্সেলোনার ৮-২ ব্যবধানে হারটাও মেসির লিগ্যাসিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ কথা জোরের সাথে বলা যাবে, ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি ক্লাবকে আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন মেসি। তাই সর্বকালের সেরা হিসেবে তাকে বিবেচনা করা যেতেই পারে।

কিন্তু এই সব সম্ভাবনাই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, যদি মেসি এখন বার্সেলোনা ছাড়েন, পাড়ি জমান অন্য কোথাও। সেক্ষেত্রে রোনালদোর সাথে তার তফাতটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর কোনো সন্দেহই থাকবে না, রোনালদো যা পারেন, মেসি তা পারেন না!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা