কেউ কেউ বলে, কারো মুড সুইং হলে তাকে বোঝার চেষ্টা করো। কারো ডিপ্রেশন হলে তাকে চোখে চোখে রাখো। যারা এত সহজেই সমাধান দেন, তারা কি প্রতিনিয়ত সুখী থাকেন? তাদের জীবনে ঝুট ঝামেলা থাকে না?

মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে নাকি একটা ব্যাপার আছে। যদিও আজকাল এই ক্রাইসিসগুলো অনেকের জীবনে অনেক আগেই নেমে আসে। জীবনের সে পর্যায়ে মানুষ সমস্তরকম উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সব কিছুকে অর্থহীন মনে হয়। মনে হতে থাকে, সমস্ত জীবনটা বৃথা গেল। সব কিছু যদি আবার নতুন করে শুরু করা যেত। জীবন নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ঠিকঠাক আর কাজ করছে না, কোনো কিছু ভাবতেও আর মন চাইছে না। যাচ্ছে তাই একটা অবস্থা... 

এরকম সময়ে ঘনঘন মুড সুইং হতেই পারে। তখন মেজাজ মর্জি ঠিক থাকে না। জোর করে হাসার চেষ্টা করে খানিক পরেই মন অন্য কোথাও হারিয়ে যায়। নিজেকে ঠিকঠাক বুঝতে পারা যায় না। না ভাল লাগে একাকীত্ব, না ভাল লাগে কোলাহল। কিছু একটা করে মনটা ঠিকঠাক করে ফেলতে পারলে ভাল লাগত, কিন্তু সেই কিছু একটার খোঁজ পাওয়া হয় না। বরং, জীবনের প্রতি আরো বিতৃষ্ণা বেড়ে যায়, বিষণ্ণতার বাতাস ভারী হয়।

এরকম সময়ে জীবন হয়ে উঠে ড্রাইভার ছাড়া ছুটে চলা গাড়ির মতো। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গাড়ির গন্তব্য কোথায় সেটা নিয়েও ভাবতে ইচ্ছে করে না। এত বেশি যন্ত্রণাকর হয়ে ওঠে সবকিছু যে, এই গাড়ি নতুন করে দূর্ঘটনা কবলিত হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও যেন কিছু এসে যায় না। খারাপ সময়গুলো অনেক বেশি দীর্ঘায়িত হলে সেটাকে বোধহয় মনোবিদরা ডিপ্রেশন বলে।

অনেকসময় ডিপ্রেশনের কারণটা ঠিক বোঝা যায় না। সব কিছু এতো এলেমেলো লাগে যে, আলাদা করে সমস্যাটা কোথায় ধরা কঠিন। খুব আশাহত লাগে, ভাঙচুর চলতে থাকে মনের ভেতর। কারো সঙ্গ ভালো লাগে না। রাতের শেষ ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যায়, ঘুম আসে না। আবছা আলোর মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে ফকফকা আলো দেখলে ভয় লাগে।

জীবনে হুট করে ভাল কিছু ঘটে গেলেও, ভাল কোনো মানুষের দেখা পেলেও তখন অস্বস্তি হয়। কোথাও নিজেকে ফিট করা যায় না। সবার সাথে ক্রমশ একটা অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হয়। সবই আছে, অথচ কিছুই নেই একটা বোধ তীব্র হয়। একটু একটু করে ক্রোধ জমতে থাকে। মেজাজ ঠিক থাকে না। সব কিছুর শেষ দেখে ফেলতে ইচ্ছে হয়। জীবনের স্বাভাবিক সুর কেটে যায়। নিজেকে বড়ই বেমানান মনে হয়, হেরে যাওয়া মানুষ মনে হয়।

ইমোশনের ওঠা নামার তীব্রতায় কেউ কেউ বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়। ভয়ংকর আবেগতাড়িত হয়ে যেকোনো কিছুই করে বসতে পারে। প্রগাড় শূন্যতায় কিংবা বিভ্রমে অসহায় হয়ে পড়ে। তারা তখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা থিউরি বিশ্বাস করতে শুরু করে। মনে করে, নিজের ভেতরকার অবোধ্য যন্ত্রণাকে কমানো যাবে নিজেকে কষ্ট দিলেই। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করে। আত্মহত্যার কথা ভাবে, হাত কাটতে চায়, আগুন দিয়ে নিজেকে ছ্যাকা দিতে পারে, বড় বাড়ির ছাদে উঠে লাফ দিতে চাইতে পারে। রাস্তায় অসংলগ্ন ভাবে হাঁটে, ছুটে আসা বাসের হর্ণ তার কানে বাজে না। 

এই ব্যাপারগুলো সব মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু আছে। কেউ কেউ অল্পতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে, কারো হয়ত অনেক সময় লেগে যায়। কেউ হয়ত কখনো জীবনে আসা ধাক্কাগুলো আর কোনোদিন সামলাতেই পারে না। আবার কারো জীবনের অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর মনে হয়, গোটা জীবনটাই রঙ লাইনে চলে গেল... 

বিজ্ঞানের ভাষায়, চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এসবের ব্যাখ্যা হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের অনুভূতিকে রাসায়নিক কিছু টার্ম দিয়ে তারা বুঝাতে চাইবেন। কেউ বলবেন, সেরোটোনিনের লেবেল কমে গেছে, হরমোনের ইমব্যালেন্স। মনোচিকিৎসকরা হয়ত ঔষধ লিখে দেবেন, থেরাপি দিবেন। কারো কারো কাজ হবে এতে।

তবুও, জীবনকে কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে আসলে চালিয়ে নেয়া যায় না। আমরা পৃথিবীতে এমন একটা সময়ে বাস করছি, আমাদের কাছে হাজার হাজার রিসোর্স। কতরকমের বই, আর্টিক্যাল আমাদের চারপাশে যেখানে বলা হয়, কীভাবে জীবনকে দেখলে সাফল্য পাওয়া যাবে। কীভাবে ব্যবসা করলে কোটিপতি হওয়া যাবে। কীভাবে ভালবাসলে সম্পর্ক অনেকদিন টিকবে।

এর বাইরে আমাদের মুরুব্বিরা তো বেঁচেই আছেন, প্রতিনিয়ত নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শুনাতে৷ এসবের মূল্য হয়ত অনেক, কিন্তু তাতে পৃথিবীতে সমস্যা কমে যায়নি। সত্যি বলতে সবার জীবন আলাদা। চয়েজগুলো আলাদা, ক্রাইসিসগুলো আলাদা৷ আমরা কারো দুঃখের কথা শুনলে তাকে উদাহরণ দিয়ে বলি, তার চেয়েও কোনো দুঃখী মানুষের গল্প। এভাবে আসলে কারো দুঃখ কমানো যায় না। প্রত্যেকের গল্প এত বেশিরকম স্পর্শকাতর যে, আমরা তার অল্পই বুঝতে পারি।

এসবের সমাধান হিসেবে কেউ কেউ খুব সহজে বলে দেন, মুভ অন করো। সময় সব ঠিক করে দেবে। কেউ কেউ বলে, কারো মুড সুইং হলে তাকে বোঝার চেষ্টা করো। কারো ডিপ্রেশন হলে তাকে চোখে চোখে রাখো। যারা এত সহজেই সমাধান দেন, তারা কি প্রতিনিয়ত সুখী থাকেন? তাদের জীবনে ঝুট ঝামেলা থাকে না?

একটা মেয়ের মুড সুইং হলে তাকে কীভাবে বুঝতে হবে এই নিয়ে শতশত আর্টিক্যাল আছে। যে ছেলে সেই মেয়েটার মুড বুঝবে সেই ছেলের কি মুড সুইং হতে পারে না? তাকে দেখবে কে?

মিড লাইফ ক্রাইসিস শুধু একজন পুরুষের আসে না, নারীরও আসে। নারীদের মিডলাইফ ক্রাইসিসকে আরো বেশি ভয়ংকর মনে হয়। কিন্তু, পুরুষরা যৌবনে যতটা নারীর মনকে গুরুত্ব দেয়, প্রচলিত সমাজে নারীর মিডলাইফে ততটাই তাকে অবহেলা উপহার দেয়।

জীবন হয়ত আসলে খুব জটিল না। কিন্তু এটাকে কোনো সরল ব্যাখ্যা দিয়ে আপনি বর্ডার টেনে দিতে পারবেন না কখনো। হয়ত জীবন একেবারে পানির মতোই সহজ, কিন্তু এর রং বুঝা তো কঠিন। যে পাত্রে যে থাকে, তার জীবনের রং সেরকম হয়ে যায়। বাইরে থেকে আমরা তাই পাশের মানুষটার কাছেও কখনো কখনো আউটসাইডার হয়ে থাকি।

তুমুল ভালবাসার পরে দুইজন মানুষ যখন দুই পাশে নির্জীব হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে যতটা নৈকট্য ততটা কি দূরত্ব থাকতে পারে না চিন্তার জগতে? দুইজন কি জানে তারা কতরকম চিন্তায় নিজেদের আরেকটা ভাবনার জগত সাজিয়েছে, যে জগতটার সন্ধান পাশের মানুষটা কোনোদিনও পাবে না...

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা