অমানুষগুলো এটা ভাবলো না, দুধ ভাই-বোনের অযৌক্তিক ফতোয়া দেয়ার চেয়ে মা হারা বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোটা বেশি জরুরী। যুক্তি ঢোকার মতো মগজ তো স্রষ্টা এদের মাথায় দেননি।

ধর্মান্ধ ইতরেরা যখন জিতে যায়, তখন মানবতা হারে, দেশ হারে, হেরে যায় মানুষ। আরও একবার, নতুন বছরের শুরুতে সেরকমই একটা হারের মুখ দেখতে হলো আমাদের। নষ্ট বিবেকবোধে আক্রান্ত কিছু অমানুষের তীব্র বিরোধিতার মুখে দমে গেল চমৎকার একটা উদ্যোগ। পাঁচশো এতিম শিশু আর চাকুরীজীবি বাবা-মায়ের সন্তানদের জন্যে যে হিউম্যান ব্রেস্ট মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, একদল অসভ্য জানোয়ারের ফতোয়াবাজির ঠেলায় সেটা বন্ধ হয়ে গেল আলোর মুখ দেখার আগেই।

পাঁচশো অনাথ শিশু ছাড়াও চাকুরিজীবী মায়েদের দুগ্ধপোষ্য সন্তানেরা, যারা মাতৃদগ্ধ থেকে বঞ্চিত, তাদের কথা ভেবেই এই মাতৃদুগ্ধ ব্যাংকের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ব্যাংকে ৫০০ লিটার মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণের পরিকাঠামোও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক মায়ের দুধ আলাদা ভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা কর হয়৷ সংরক্ষণের জন্য যন্ত্রপাতি আনানো হয় স্পেন থেকে। ১ ডিসেম্বর থেকে এই ব্যাংক পরীক্ষামূলক ভাবে চালুও হয়ে গিয়েছিল এই উদ্যোগ, বাকী ছিল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। কিন্ত তার আগেই বাধা দিয়ে থামিয়ে দেয়া হলো সেটিকে।

বাংলাদেশে শিশুর জন্মের পরেই মা মারা যাওয়ার প্রচুর নজির আছে, উদাহরণ আছে নবজাতক উদ্ধার হবার ঘটনারও। হয়তো সন্তানটিকে গ্রহণ করতে চান না বাবা-মা, ফেলে দেন ডাস্টবিনে, পত্রিকার পাতায় এমন খবর অহরহ পাই আমরা। চিকিৎসকেরাও মা হারা এমন অনেক অসুস্থ নবজাতককে হাতে পান, মায়ের শালদুধটা যার বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন হতে পারতো। সেইসব অভাগা শিশুদের কথা ভেবেই এই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগটা নেয়া হয়েছিল।

শত শত এতিম শিশুর জন্যে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হতে পারতো বড় একটি অন্ন সংস্থানের নাম

অনেক সন্তানহারা মা আছেন যারা হয়তো নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই বিপন্ন শিশুদের জন্য নিজের বুকের দুধ দিয়ে মানসিক শান্তি পেতে চান। তারা এই মিল্ক ব্যাংকে ডোনার হিসেবে থাকবেন- এরকমটাই ছিল পরিকল্পনা। শহুরে জীবন এখন কর্মব্যস্ত হয়ে গেছে, অনেক সময় দেখা যায়, সন্তান জন্ম দেয়ার পরে কর্মজীবী মায়ের হাতে খুব বেশিদিন ছুটি থাকে না, তাকে যোগ দিতে হয় কর্মস্থলে। সব অফিস-আদালতে বাচ্চাকে রাখার মতো ব্যবস্থাও নেই। আর তাই কর্মজীবী মায়েদের জন্যেও হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হতে পারতো বড় একটা ভরসার নাম। কিন্ত ধর্মান্ধ কিছু লোকের কারণে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে কোথায়?

তাফসীর পরিষদ নামের কোথাকার এক ভুঁইফোঁড় সংগঠন শুরু থেকেই এই মিল্ক ব্যাংকের বিরোধিতায় নেমেছিল। বাঙালি ধর্মান্ধের দল না বোঝে ধর্ম, না বোঝে বিজ্ঞান, কিন্ত সেক্স জিনিসটা খুব ভালো বোঝে, সেক্সের দন্ত্য-স শুনলেও তাদের কান খাড়া হয়ে যায়। তারা যুক্তি দিলো- ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক থেকে একই মায়ের দুধ পান করার মাধ্যমে বহু অজানা শিশু দুধ ভাই-বোনে পরিণত হবে, যাদের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক হবে হারাম। এদের মধ্যে নাকী নিজেদের অগোচরে বহু হারাম বিয়ে হওয়ার আশংকা থাকবে!’ আর সেটা নিয়েই অনলাইন গরম করা শুরু করলো তারা।

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের চমৎকার এই উদ্যোগটাকে নিয়ে সীমাহীন নোংরামী করেছে তারা, হাদীসের উল্টোপাল্টা রেফারেন্স হাজির করে ধর্মের নামে ফতোয়া জারী করে একরকম নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করে দিয়েছে মিল্ক ব্যাংকের ওপর। অথচ এই ধর্মান্ধরা ভুলে গেছে, যে পাকিস্তানের নামে এরা সারাদিন জিকির করে, সেই পাকিস্তানেও চালু আছে মিল্ক ব্যাংকের সিস্টেম। আছে ইরান, ইরাক কিংবা কুয়েতের মতো মুসলিম প্রধান দেশেও। অথচ ধর্মান্ধ ইতরের দল বাংলাদেশে সেটা হতে দিতে চায় না!

কেনিয়ার একটি মিল্ক ব্যাংক

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-এর যিনি সমন্বয়ক, সেই ডা. মুজিবুর রহমান বলছিলেন, "ধর্মীয় সব বিষয় মাথায় রেখে এবং ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেই এটা করা হয়েছে বিপন্ন শিশুদের কথা চিন্তা করে। কারণ অনেক সময় এমন মা-হারা অনেক বিপন্ন শিশু আমরা পাই মায়ের দুধ পেলেই তাদের বাঁচানো সহজ হয়।" কিন্ত কে শোনে কার কথা! ধর্মান্ধের দল হিসু করে পানি না নিলেও, মদ খেয়ে গলা ভেজালেও, সেক্সটা তাদের হালাল চাই। আর তাই মিল্ক ব্যাংক হঠাও! তথাকথিত সেই তাফসীর পরিষদের সঙ্গে পরে এই তালিকায় যোগ দিয়েছে কয়েকটি ইসলামী সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলও। সব রসুনের তো একই কোয়া!

অমানুষগুলো এটা ভাবলো না, দুধ ভাই-বোনের অযৌক্তিক ফতোয়া দেয়ার চেয়ে মা হারা বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোটা বেশি জরুরী। যুক্তি ঢোকার মতো মগজ তো স্রষ্টা এদের মাথায় দেননি। ‘ইসলামে এসব মিল্ক ব্যাংক হারাম’ টাইপের গা জোয়ারী কথাবার্তা বলার আগে তারা মিল্ক ব্যাংকের ডেটাবেজ নিয়ে কথা বলতে চাইলো না, একবারও খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলো না যে, মুসলিম কোন দেশে মিল্ক ব্যাংক সিস্টেমটা আছে কীনা, সেখানে তারা কীভাবে পুরো ব্যাপারটা অপারেট করছে। এই ধর্মান্ধদের কাছে ফতোয়াটাই বড়, মানবতা নয়!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা