অথচ অবাক লাগে, এই কল্পিত দেশ বাদে বাকিসব দেশের মন্ত্রীরা কী বোকা! মানুষের কথা ভেবে, দেশের কথা ভেবে, এরা নিজেদের ক্ষমতাকে অবলীলায় রেখে আসে কর্তৃপক্ষের টেবিলে। ক্ষমতাকে মায়া না করে দেশকেই ভালোবাসেন তারা।
আজ কয়টা গল্প বলবো। ঈশপের গল্প। শিক্ষনীয় গল্প। তবে গল্পের আগে সতর্কতা সংকেত, এই গল্পের এক অংশের সাথে বাস্তবের মিল আছে। গল্পের আরেক অংশের সাথে বাস্তবের মিল নেই। কোন অংশের সাথে মিল আছে আর কোন অংশের সাথে নেই, সেটা গল্প পড়লেই ধরা যাবে।
'উই চ্যারিটি' নামের একটি দাতব্য সংস্থার তহবিলের অর্থ কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন কানাডার অর্থমন্ত্রী বিল মোর্নিয়াও। জানা যায়, সংস্থার কাজ দেখতে বিদেশে সফরের সময় তার মন্ত্রণালয়ের ৪১০০০ ডলার ব্যয় হয়। যে খরচ তারই বহন করার কথা ছিলো। কিন্তু তিনি করেননি। সে কারণে জাস্টিন ট্রুডোর সাথে বিরোধ হয়। ফলশ্রুতিতে তিনি পদত্যাগ করেন।।
এবার একটা কল্পিত দেশের গল্প শুনি। সে দেশের মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে তাদের গুষ্টিশুদ্ধ সবাই ঘুরে আসে পৃথিবীর বহু দেশে। মাসের পর মাস ধরে তাদের ভ্রমণ চলতেই থাকে। শেষ হয়না। প্রশ্ন আসতে পারে, এই ভ্রমণের খরচ কারা বহন করে? কারা আবার! জনগন বহন করে। তাদের ট্যাক্সের টাকায় চলে মন্ত্রী, আমলা ও তাদের পরিবারের বিশ্বভ্রমণ।
দেশটার নাম জানতে চান? বলা যাবেনা
করোনাভাইরাস চলাকালীন সময়ে পদত্যাগ করেছেন নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. ডেভিড ক্লার্ক। যে কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন, সে কারণও অদ্ভুত। দেশটিতে যখন লকডাউন, তখন একবার তিনি সাইকেল চালিয়ে বেড়িয়েছেন, আর দ্বিতীয়বার ডান্ডিনে নিজের বাড়ি থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে এক সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন সপরিবারে। যদিও এ ঘটনার জন্যে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন সবার কাছেই। তাও তিনি শেষে এসে পদত্যাগ করেছেন। চিলির স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেইমে মানালিসও করোনাপরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেন কিছুদিন আগে। মে মাসের দিকে পদত্যাগ করেন ব্রাজিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলাতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ভালো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, এই কারণে পদত্যাগ করেন তিনি।
এবার আবার সেই কল্পিত দেশে আসি। যে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী লকডাউনের মধ্যে বিশাল লটবহর নিয়ে ঘুরে বেড়ান দেশের এখানে ওখানে। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই তিনি সংবাদের শিরোনাম হন। দেশে কয়টা পিপিই আছে, কয়টা ভেন্টিলেটর আছে, কয়টা আইসিইউ কেবিন আছে, দেশে করোনাভাইরাসের কী অবস্থা, কিছুই জানেন না তিনি।
কোন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তিনি? বলা যাবেনা।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সোওলু পদত্যাগ করেন কিছুদিন আগে। তার পদত্যাগ করার কারণটাও সোজাসাপ্টা। লকডাউন ঘোষণার পর মানুষজন বাজার করার জন্য মাত্র দুই ঘণ্টা সময় পান। এতে করে বাজার করতে অনেক বেশি মানুষ ভিড় জমান এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়।করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সুলেমান সোওলু তার বিবৃতিতে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে নির্দেশ দেয়ায়, কারফিউ ম্যানেজমেন্ট যথাযথভাবে হয়নি এবং এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এবং এর পুরোটাই তার দায়, সেটা স্বীকার করে নিয়ে তিনি পদত্যাগ করে ফেলেন।
অথচ এবার একটি কল্পিত দেশের কথা বলি। সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেনই না, দেশে যানবাহনগুলো স্বাস্থ্যবিধি মানছে কী না। রাস্তায় মানুষজন জটলা করছে কী না। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কী না।
দেশের নাম? বলা যাবেনা।
মিসরের রাজধানী কায়রোতে গতবছরে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫ জন নিহত হন। দুর্ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন মিশরের পরিবহন মন্ত্রী।
অথচ, একটা কল্পিত দেশ আছে, যে দেশের পরিবহন মন্ত্রী ছিলেন শ্রমিক নেতা। কিছু হলেই রাস্তাঘাট বন্ধ। শ্রমিক অবরোধ। বাসের প্রতিযোগিতা। মানুষকে মেরে ফেলা। খোলামকুচির মতন মরেছে মানুষ। পদত্যাগ কী করলেন সে দেশের পরিবহন মন্ত্রী?
সেটা আর নাই বা বলি।
ইতালির শিক্ষামন্ত্রী নরেনজো ফিয়োরামন্তি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পদত্যাগের কারণ অদ্ভুত। মন্ত্রণালয়ের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশটির বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নের প্রতি জোর দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এজন্য যে কয়েক কোটি ইউরোর বরাদ্দ প্রয়োজন; সরকারের কাছ থেকে তা তিনি পাননি। ফলে তিনি পদত্যাগ করে সরে গিয়েছেন।
অথচ আমাদের সেই কল্পিত দেশে একটা সময়ে প্রশ্নফাঁস হয়েছে প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার। সেই দেশের শিক্ষামন্ত্রী সেই দায় তো মাথায় নেনই নি, বরং হাসিমুখে দায় চাপিয়েছেন অন্যের ঘাড়ে। শিক্ষা কাঠামোর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে নুলো করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোনো হেলদোল কখনো দেখিনি তার চোখেমুখে।
দেশটির নাম? বলা যাবেনা।
এই কল্পিত দেশের অনেক গল্প। এ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে করেছেন বিভিন্ন মুখরোচক মন্তব্য। 'কারো বেডরুমের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের দায়িত্ব না' থেকে শুরু করে 'উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।' তারা বহাল তবিয়তে তাদের সময়ে শাসন করেছেন। একটা ফুলের টোকাও পড়েনি তাদের গায়ে। তাদের পদত্যাগ? এগুলো বলাও তো পাপ!
সেই কল্পিত দেশের মন্ত্রণালয় এবং আমলাদের নিয়ে আরেক মহাকাব্য লেখা হয়ে যাবে। প্রতিদিনই যেখানে হয় বালিশ নিয়ে উপাখ্যান, দশ হাজার টাকার বটির রূপকথা, লাখ টাকা দামের পর্দার সায়েন্স ফিকশন, মেডিকেলের যন্ত্রপাতির আকাশকুসুম দামের নাটক! সাধারণ মানুষ যে দেশে সাধারণের চেয়েও সাধারণ। যে দেশে ক্ষমতাই আইন। ক্ষমতাই সংবিধান।
অথচ অবাক লাগে, এই কল্পিত দেশ বাদে বাকিসব দেশের মন্ত্রীরা কী বোকা! মানুষের কথা ভেবে, দেশের কথা ভেবে, এরা নিজেদের ক্ষমতাকে অবলীলায় রেখে আসে কর্তৃপক্ষের টেবিলে। ক্ষমতাকে মায়া না করে দেশকেই ভালোবাসেন তারা।
এই পুরো লেখায় যে কল্পিত দেশের নাম বারবার এলো, সেই দেশের নাম শুনতে চান? নিশ্চয়ই শুনতে চান আপনি। কিন্তু নাম বলা যাবেনা। কারণ, সে দেশেরই এক পাগলাটে লোক একবার বলে গিয়েছিলেন-
নাম বললে চাকরী থাকবেনা!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন